আবার এলাম সেই সোনার দেশ বাংলাদেশে৷ সল্টলেক-করুণাময়ীর বাসডিপো থেকে ভোর সাড়ে ৬টায় শ্যামলী পরিবহনের ভলভো ভি.ডি.ও. কোচ বাস ছাড়ল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উদ্দেশ্যে৷ ভ্রমণপ্রিয় মন আমার, সময় এবং সুযোগের মিলন ঘটলেই বেড়িয়ে পড়ি বিশেষ স্থানে৷ এবার ঢাকায় কবি জসিমুদ্দিনের বাড়িতে জাতীয় কবি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনে আয়োজকদের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়েই উদ্যোগ নিলাম ঢাকা যাওয়ার৷ এর আগেও এখানে এসেছি, এবার আরও চার জায়গায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে আর ঘোরাও হয়ে যাবে৷ বাসের নির্দিষ্ট সিটে বসে দু’পাশের দৃশ্য দেখতে থাকি৷ কলকাতার, বারাসতের জ্যাম পেরিয়ে বাস ছুটে চলে হর্ন বাজিয়ে৷ রাস্তার দু’ধারে উঁকি মারতে লাগল ছোট-বড় নানান ঘরবাড়ি, সারি সারি নারকিল, সুপারী গাছ, ধানক্ষেতে সূর্যের আলো ঝলমল করে উঠেছে, কোথাও বা পুকুরে ছোট ছেলেমেয়েদের সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা, সরু খালের আাঁকাবাঁকা চলা, কৃষকদের চাষের জমিতে গরু চড়ানো— এক স্নিগ্ধ গ্রাম্য ছবি পরিস্ফুট হতে না হতেই বাস তার গতি আরও দ্রুত বাড়িয়ে দিল৷ হিমেল হাওয়ার বিদায় সংকেতে বসন্তের আগমন বার্তায় দোল খেতে খেতে পেট্রাপোল বর্ডার ও বেনাপোল বর্ডারে লাইন দিয়ে পাশপোর্ট চেকিং, লাগেজ চেকিংয়ের ফর্মালিটিস পূরণ করে বাস আমাদের নিয়ে ছুটল গন্তব্যস্থলের দিকে৷ দেড় ঘণ্টার মধ্যেই যশোরে নেমে এক বড় রেস্টুরেন্টে সবাই যে যার পছন্দমতো লাঞ্চ পর্ব শেষ করল৷ এরপর বাস সোজা গোয়ারতুলী ঘাটে গিয়ে পৌঁছতেই চারধারে চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ জলরাশি, কিংবদন্তী সেই পদ্মা! অপেক্ষারত স্টিমারে চড়ে দোতলার রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে ডি.জি. ক্যামেরাতে অনেক ফটো ক্যামেরা বন্দি করলাম৷
জেলেরা ঝুড়িভর্তি ইলিশ নিয়ে যাত্রীদের হেঁকে চলেছে কেনাকাটার জন্য৷ ছোটবেলায় মা’র মুখে শুনেছিলাম যে তখন জেলেরা ঘরের জানালায় এসে হাঁক দিত— এক টাকায় তাজা ইলশা আছে, নেবেন নাকি মা? আর এখন দাম শুনে চোখ কপালে উঠ৷ হাজার টাকায় তিনটে, পদ্মার তাজা ইলিশ বলে কথা! নাঃ, মাছ আর কেনা হয়নি, তবে গরম ডিম সেদ্ধ খেয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম৷ সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা৷ পদ্মার রুপোলি ঢেউয়ের মাঝে ভেসে চলেছে স্টিমার৷ চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওপারে গিয়ে আমাদের বাসে উঠে পড়লাম৷ তখনও পদ্মার নৈসর্গিক অবর্ণনীয় শোভা উপভোগ করার আনন্দ বুকের ভেতর ভ্রমর গুঞ্জন সৃষ্টি করে চলেছে৷
ঢাকার বিখ্যাত যানজট কাটাতেই ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল৷ আমরা ঢাকার ‘বিউটি বোর্ডিং লজে’ তিনদিন ছিলাম৷ এই ঐতিহ্যপূর্ণ লজে বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, এমনকি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও কিছুদিন বসবাস করেছিলেন৷ এহেন প্রাচীন গৌরবান্বিত লজে আমরা অধিষ্ঠান করতে পেরেছি ভেবে ধন্য হয়েছি৷
পরদিন সম্মেলনে বহু বিশিষ্ট গুণীজনের সমাবেশে অনুষ্ঠান যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পর্বে সরগরম হয়ে ওঠে৷ রাতের ডিনার পর্ব ওই লজেই সেরে নিলাম৷ সকাল হতেই মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে, শুভ পয়লা বৈশাখের শুভ অবসর৷ বাংলাদেশের বিখ্যাত এক শুভ দিন৷ আগের দিন রাত বারোটার পর সমস্ত যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়৷ পদব্রজেই রুম পার্টনার গার্গীদি আর আমার মেয়েকে নিয়ে রমনার বটমূলের দিকে এগোতে থাকি৷ সেখানে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের চল্লিশজন শিল্পী নতুন শাড়ি, ফুল, চন্দনে সজ্জিত হয়ে একের পর এক সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে পরিবেশকে আনন্দমুখর করে তুলছে৷ বিখ্যাত সংগীত শিল্পী সঞ্জিদা খাতুনের পরিচালনায়৷ মিলিটারি, র্যাফদের দ্বারা সুপরিকল্পিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় জনগণ নতুন পোশাকে সেজে রমনাপার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাচ্চারা আনন্দ উপভোগ করছে৷ পার্কের প্রবেশদ্বারে প্রত্যেকের হাতে ভলান্টিয়াররা সুন্দর সুন্দর পাখা ধরিয়ে দিচ্ছে৷ রাস্তার দু’ধারে নানান পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বেচাকেনায় ব্যস্ত৷ আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটি, নজরুল সমাধি, রবীন্দ্র সরোবর প্রভৃতি দেখে বিশাল শোভাযাত্রায় সামিল হলাম৷ মুখোশধারী লোকেরা ঢাক, ঢোল, ভেঁপু বাজিয়ে নাচার ছন্দে এগিয়ে চলেছে, তাদের দেখার জন্য রাস্তার দু’ধারে ভিড় উপচে পড়ছে৷ এর মধ্যে চায়ের তেষ্টা ছুটিয়ে নিয়ে গেল এক কফিশপে৷ চায়ের পরিবর্তে কফিই পান করতে হল৷ সেখানে লম্বা লাইন দিয়ে কলেজের ছেলেমেয়েরা ফুটপাতের ধারে বসে মনের আনন্দে পান্তা-ইলিশ খাচ্ছে৷ এক প্লেট চারশ টাকা৷ ওই দিনের বিশেষ মেনু৷
বেলা বারোটার পরে কিছু রিক্সা চোখে পড়ল৷ উঠলেই একশ টাকা, এমনিতে সেদিন তো সবকিছুই অগ্নিমূল্য৷ রিক্সা নিয়ে নিউমার্কেট ঘুরে বেড়ালাম৷ একটা ঢাকাই জামদানি শাড়ি কিনে হোটেলে ফিরলাম৷ বাংলাদেশের বিখ্যাত পয়লা বৈশাখ দেখার সৌভাগ্য হল৷ দিনটা আনন্দেই কেটেছে৷ পরদিন রুমেই ব্রেকফার্স্ট সেরে ‘গুলিস্থান’ বাস ডিপো থেকে ‘ারাম’ লোকাল বাসে চড়ে বিক্রমপুরের শ্রীনগর উপজেলার রাঢি়খালে পেঁৗছলাম৷ মাত্র এক ঘণ্টার পথ৷ বাস থেকে নামতেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ইনস্টিটিউশন ও কলেজ দৃষ্টি আকর্ষণ করল৷ বিজ্ঞানীর পৈতৃক ভিটে৷ গেটের ভিতরে প্রবেশের মুহূর্তে শরীরে যেন শিহরণ খেলে গেল৷ জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানীর আশি একর জমির উপর স্কুল, কলেজ, বিশাল কমপ্লেক্স, পার্ক, উদ্যানে বেষ্ঠিত এক মনোরম পরিবেশ৷ কলেজের শিক্ষক, প্রিন্সিপাল, সকলের সঙ্গে পরিচয় হলো৷ লেকচারার সুমন্ত রায় আমাদের বিজ্ঞানীর মিউজিয়াম দেখালেন, যেখানে তাঁকে লেখা বিশ্ব প্রসিদ্ধ মনীষীদের রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, কেলভিন, রোমারোঁলার চিটি, সার্টিফিকেট ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে, বিজ্ঞানীর ব্যবহূত যন্ত্রপাতি সব সংরক্ষিত রয়েছে৷ বিস্মিত মুগ্ধ চিত্তে প্রিন্সিপালের রুমে প্রবেশ করলাম৷ ওখানে ঢাকা থেকে আনা বিরিয়ানি, মিষ্টি দই দিয়ে আমাদের জন্য লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে৷ রঙ্গিন পলাশ,বকুল, অশোক, শিমূলের ঘেরাটোপে সে এক বিশাল সাম্রাজ্য— ফেরারপথে মন নরম হয়ে এল৷
কলেজের গেট থেকে ট্রেকার ভাড়া করে চললাম মুন্সীগঞ্জ৷ পথের দু’পাশে ঘন সবুজ গাছের ঝোপ, মৌমাছি, রঙিন প্রজাপতিদের উড়ে বেড়ানোর মাতামাতি, পুকুর পাড়ে কলসী মাথায় মেয়ে-বউদের ঘরে ফেরার তাড়া৷ স্নিগ্ধ মনোরম দৃশ্য শেষ হতেই পৌঁছে গেলাম মুন্সীগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজের প্রাঙ্গণে৷ ওই কলেজের প্রফেসর আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন৷ তিনি তাঁর কলেজ পরিদর্শন করালেন৷ কলেজের মধ্যেই বিশাল এক পুকুর, তার পাড় ঘেঁষে সিমেন্টের ছাতার নীচে বসে আমরা চা, নাস্তা সারলাম৷ শিক্ষকদের অমায়িক, মার্জিত ব্যবহার ভোলার নয়৷ প্রফেসর সফিক স্যারের নির্দেশে আর এক শিক্ষক তাঁর নিজস্ব গাড়িতে মুন্সীগঞ্জের কিছু বিখ্যাত স্থান পরিক্রমা করালেন৷ শ্রী অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান, পাশে বিশাল বৌদ্ধমন্দির, অপূর্ব কারুকার্য মণ্ডিত সে মন্দির, রাজা শ্রীনাথ সিনহা চৌধুরীর (জমিদার) টেনিস ক্লাব, হাইকোর্ট সবকিছু ক্যামেরাবন্দি হল৷ কলেজে ফিরে সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে বাসে চড়ে ঢাকায় ফিরলাম৷
রাত্রে নিদ্রাদেবী গায়েব ছিল৷ কারণ পরেরদিন ভোর পাঁচটায় আমাদের কুষ্ঠিয়া রওনা হতে হবে৷ সেই টেনশনে ঘুম উধাও৷ হোটেলের নীচেই গাড়ি হাজির৷ কুষ্ঠিয়া থেকে দৈনিক বাংলাদেশ বার্তার সম্পাদক আবদুর রশিদ চৌধুরী গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ পাঁচ ঘণ্টা অনবদ্য জার্নির পর আমরা কুষ্ঠিয়ার এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হস্টেলে উঠলাম৷ সম্পাদক নিজে আমাদের ফুলের বু্যকে দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন৷ ওনার পত্রিকার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে পরদিন সকাল ন’টা থেকে পুরসভা অডিটোরিয়ামে বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল৷ ভারত, বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে কবি, সাহিত্যাবাসরে বিশাল অনুষ্ঠান৷ অতিথিদের সাদর বরণ, মঞ্চে ক্রেস্ট প্রদান, গান, কবিতা পাঠ, সাহিত্য সম্বন্ধীয় আলোচনা, সবশেষে ওই হলেই লাঞ্চ সেরে সদলে ভি.ডি.ও কোচে বাসে, শিলাইদহ যাত্রা করলাম৷ আমি, আমার মেয়ে ক্রেস্টা করোলা গাড়িতে ছিলাম৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদার বাড়ি দেখার সৌভাগ্য হল৷ জমিদারবাড়ি যাবার পথে দু’ধারে গড়াই নদী, নাম না জানা অনেক নদনদীর সম্মুখীন হলাম৷ চারদিকের শান্ত প্রকৃতির মাঝে নদীর শীতল জলে পালতোলা নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার ভেসে বেড়াচ্ছে মৃদু গতিতে৷ জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত৷ দ’ধারের সবুজ বনানী ভেদ করে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে ব্রিজের উপর দিয়ে৷ এক সময় শিলাইদহে কবির কুঠিবাড়িতে গাড়ি থামল৷ প্রবেশপথে টু্যরিস্ট সেন্টার৷ টুকিটাকি শপিং সেরে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করলাম৷ দোতলা দুগ্ধফেননিভ সুন্দর রাজবাড়ি৷ কবিগুরুর শয়নকক্ষে তাঁর ব্যবহূত খাট, আলমারি, চেয়ার, টেবিল, বহু মনীষীদের ফটো, সব টাঙানো রয়েছে৷ ছাদে রয়েছে তাঁর ব্যবহূত নিজস্ব স্টিলের নৌকা৷ যে নৌকায় চড়ে তিনি পদ্মার বুকে ভেসে কবিতা, গল্প রচনা করতেন৷ সঞ্চয়িতার কিছু অংশ এই নৌকার বুকেই লিখেছেন৷ কুঠিবাড়ির সংলগ্ন এক স্বচ্ছ বিশাল পুকুর৷ চারপাশে গাছগাছালির নিখুঁত মেলা৷ ওই পুকুর পাড়ে বসেও কবি কাব্য সৃষ্টি করতেন৷
রবীন্দ্রকুঠি দেখে আমরা গেলাম লালন একাডেমি৷ মীর মুশারফের মাজার, লালনের মিউজিয়াম দর্শন করলাম৷ দেখি, লালনের ব্যবহূত একতারাটি কাচের শো-কেসে বিদ্যমান৷ একাডেমির ছাত্রছাত্রীরা বাউল সংগীত পরিবেশন করলেন একতারা বাজিয়ে৷ একাডেমির পক্ষ থেকে আমাদের প্রত্যেককে একতারা আর লালনের জীবনভিত্তিক বই উপহার দেওয়া হল৷ ওই সময় মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল৷ বৃষ্টি থামতেই কিছুটা পায়ে হেঁটে এক বড় চাইনিজ রেস্তরাঁয় ডিনার সেরে কুষ্ঠিয়ার হস্টেলে ফিরলাম৷ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি হূদয় ছুঁয়ে গেল৷
পরদিন আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছলাম৷ ঢাকা পৌঁছে ওখান থেকে টু্যরিস্ট বাসে পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ জার্নির পর চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক মাটি স্পর্শ করলাম৷ দু’ধারে সবুজ ঘনগাছের সাড়ি মাথা তুলে পরস্পর আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় লম্বা টানা গাছের গুহার মধ্য দিয়ে পিচ ঢালা কালো সর্পিল রাস্তা ভেদ করে বাস ছুটছে৷ কাঁঠালের গুচ্ছে ভরা রাশি রাশি গাছ সহজেই মনকে পুলকিত সুমধুর ডাকে আকাশ বাতাস মুখরিত৷ পুকুরে শাফলা, পদ্মের বাহার, হাসনুহানার সুবাসিত গন্ধ— প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে কখন যে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলা টের পেলাম না৷ হোটেলে ফ্রেশ হয়ে গরম পরোটা, আর সুস্বাদু চা খেলাম, যা মুখে লেগে রইল৷
পরদিন মিউনিসিপ্যাল হলে সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিলাম৷ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সচিব, আর্মি জেনারেল, দেশি-বিদেশি অনেক কবি, সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন৷ যে যাঁর বক্তব্য পেশ করলেন৷ সকলকেই সম্বর্ধনা দেওয়া হল৷ সগৌরবে অনুষ্ঠান শেষে সদলে লোকাল বাসে দেড়ঘণ্টা পথ অতিক্রম করে কক্সবাজার পৌঁছে গেলাম৷ স্থানীয় এক টু্যরিস্ট লজে সেদিন আমাদের থাকতে হল৷ রুমে মালপত্র রেখেই রিক্সা নিয়ে ছুটলাম পৃথিবীবিখ্যাত কক্স বাজারের তীরে৷ দীর্ঘতম সমুদ্রবিচ, ঢেউয়ের উত্তাল, মাতাল তাণ্ডব, আাকাশে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা৷ ঝাঁপিয়ে পড়লাম অনন্ত জলরাশির মাঝে৷ সকলের বারণ আমার কর্ণপাত হয়নি৷ মেয়েও ভাল সুইমার, মা-মেয়ের ঢেউয়ের তালে নির্ভীক কমপিটিশন৷ এর মধ্যেই স্পিড বোট ভাড়া করে মাঝ সমুদ্র অবধি রাউন্ড মেরে এলাম৷ ফটো তোলার বিরাম নেই৷
অনন্ত সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে লজে ফিরে রাতে ডিনার সেরে— সে রাত্রেই টিকিট কেটে ঢাকাগামী বাসে চড়ে বসলাম৷ তার আগে হোটেলের রুমে বসে সুস্বাদু আম আর বিরিয়ানি খেয়ে রসনার তৃপ্তি হল৷ চট্টগ্রাম চারবার পরিক্রমায় মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসির মঞ্চ, সেই কারাগার যেখানে শহিদদের কারাবাসে থাকতে হতো, মেয়রের অফিস, চট্টগ্রাম বইমেলা প্রভৃতি এবং বহু বিখ্যাত শহিদদের যেমন নেলি সেনগুপ্ত, যতীন সেনগুপ্ত, মাতঙ্গিনী হাজরার মর্মর মূর্তি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি৷
সৌন্দর্যের আনন্দবলয়কে পিছনে রেখে ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি, শাফলা চত্বর, সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং, স্টেডিয়াম, নজরুলের সমাধিস্থল অনেক কিছুই নজর কেড়ে নিল৷ গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা, পদ্মা মায়ের মতো, মাতৃস্নেহে যেন আগলে রেখেছে৷ বিষণ্ণ বদনে বাংলাদেশকে ছেড়ে আসতে হয়৷ অশান্ত হয়ে ওঠে অবুঝ মন৷ বিশেষত, ওনাদের সৌজন্যমূলক অমায়িক ব্যবহার, আন্তরিক আতিথেয়তা মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়৷ শিকড়ের সন্ধানে শস্যশ্যামলা বাংলা মায়ের হাতছানির অপেক্ষায় থাকি কবে হবে আবার সৌভাগ্য সেই তীর্থভূমিতে বিচরণ করার, ভাবতে গিয়ে দু’চোখ জলে ভরে যায়৷