ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমিয়েছে সুন্দরবন। এর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও ৩ থেকে ৪ ফুট কমিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি। ঝড়টি ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার গতিবেগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত করে আর এটি বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় আঘাত করে ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার গতিবেগে।
কিন্তু তার আগেই সুন্দরবন এর শক্তি কমিয়ে দেয়। ফলে এই ঝড়ে যে পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে উপকূলের মানুষ ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে।
২২ মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। এই সময়ে আবারও সুন্দরবন প্রমাণ করল এটি বাংলাদেশের জীববৈচিত্রের সবচেয়ে বড় আধারই শুধু না, তা আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচও। দুর্যোগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে কলকাতা শহরে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান যে তান্ডব চালিয়েছে, একই পরিণিত হতে ঢাকাসহ আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর।
গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ২১ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢাকায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার, আর কলকাতায় ছিল ১১২ কিলোমিটার। তাই সুন্দরবন না থাকলে ঢাকাতেই ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতি নিয়ে ঝড়টি চলে আসত।
এই ঝড়ের কারণে সুন্দরবনের বেশ ক্ষতি হয়েছে। বনবিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার মতো এবারও সুন্দরবনের মিষ্টি পানির উৎস ৬৫ টি পুকুর, বন বিভাগের ১৮ টি টিনের তৈরি ফাঁড়ি, ২৮ টি জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছও ভেঙে পড়েছে।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। মোট ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে চার সদস্যের একটি কমিটিও করেছে বন বিভাগ। এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, বনের মধ্যে যেসব পুকুর লবণাক্ত হয়ে পড়েছে সেগুলো শুধু বন বিভাগের কর্মীদের মিষ্টি পানির প্রধান উৎস না, বনের বাঘ, হরিণ, বানর ও অন্যান্য বন্য প্রাণী সেখান থেকে খাবার পানি পায়। ফলে আমরা দ্রুত পুকুরগুলো লবণপানিমুক্ত করার পরিকল্পনা করছি।
তবে প্রতিবারই সুন্দরবন নিজে ক্ষত সয়ে আমাদের রক্ষা করছে। গত বুধবার বেলা তিনটায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপে আঘাত করে। এরপর আম্ফান পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপকূলের দিকে রওনা হয়। ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথে ছিল সুন্দরবন।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঝড়টি বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলের ১০০ কিলোমিটারের কাছে আসার সময় এর বাতাসের গতি ঘণ্টায় ছিল ২২০ কিলোমিটার। কিন্তু সুন্দরবন অতিক্রমের পর বসতি এলাকায় আঘাতের সময় এর গতি কমে আসে ১৫১ কিলোমিটারে।
অন্যদিকে সরকারের কন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে ঝড়টির সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা থাকার কথা ১৫ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু তা উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমে আসে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের জলোচ্ছাসের উচ্চতা ৩ থেকে ৪ ফুট কমিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন।
তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগে ১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৮ সালে বুলবুল ও ২০১৯ সালের ফণী এবং এ বছর আম্ফানের গতি থমকে দিয়েছে সুন্দরবন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ মাকসুদ কামাল বলেন, বঙ্গোপসাগরে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দিকে আঘাত করেছে, সুন্দরবন প্রতিবারই এগুলোর গতি কমিয়েছে। ফলে আমাদের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে, সেখানে মানুষের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। আর উপকূলের পুরো অংশে বনায়ন করতে হবে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট ‘সুন্দৰ্বনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছিল। তাতে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪৮৫.২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ বাঁচিয়েছিল। গবেষকেরা বলছেন, ৬ লাখ ৩ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতো।