২০২৪-এ সাহিত্যে নোবেল হান কাং-এর, প্রথম কোরিয়ান সাহিত্যিক হিসেবে নোবেল

সম্প্রতি রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি ঘোষণা করল ২০২৪-এ সাহিত্যে নোবেলজয়ীর নাম। দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যিক হান কাং সম্মানিত হলেন এই পুরস্কারে। নোবেল কমিটির বিবৃতি অনুযায়ী, ‘তাঁর তীব্র কাব্যিক গদ্য, যা ঐতিহাসিক ট্রমার মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং মানবজীবনের ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরে’- এই কারণে তাঁকে এই বছর বেছে নেওয়া হয়েছে নোবেল পদকের যোগ্য অধিকারী হিসেবে।

হানের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে, ১৯৭০ সালে। ৯ বছর বয়সে তিনি সপরিবারে চলে আসেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহর সিওলে। তাঁর বাবা হান সেউং ওন-ও একজন সাহিত্যিক। ফলে, কম বয়স থেকেই সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি, যা তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতের লেখিকা হওয়ার বীজ বুনে দিতে সাহায্য করেছিল। তাঁর ভাই হান দং রিম-ও লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত।

১৯৯৩ সালে ‘লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি’ পত্রিকায় কিছু কবিতা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা হয়। ২০১৬ সালে ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসের জন্য আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি। ২০০৭-এ প্রকাশিত তিনটি পর্বের এই উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়ং-হিয়ে এক দুঃস্বপ্ন দেখে নিরামিষাশী হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক জগতে কী কী প্রভাব পড়ে, তাই তুলে ধরেছেন তিনি।


চিত্রকলা-স্থাপত্য-সঙ্গীতশিল্পের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা এবং চর্চা তাঁর লেখায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। ‘ইয়োর কোল্ড হ্যান্ডস’ (২০০২) উপন্যাস তাঁর শিল্পের প্রতি ভালোবাসার এক জ্বাজ্জল্যমান উদাহরণ। এই উপন্যাসে এক স্থপতির কথা রয়েছে, যে নারীদেহের প্লাস্টারের ছাঁচ বানানো নিয়ে রীতিমতো মোহাবিষ্ট।

হানের লেখায় দেহ এবং মন, জীবিত ও মৃতের মধ্যে এক অনন্য সংযোগ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর কাব্যিক, পরীক্ষামূলক, আঁভা-গার্দ লেখনশৈলীর কারণে সমকালীন গদ্যরচনার ঘরানায় তিনি বিশেষ উল্লেখযোগ্য আসন দখল করেছেন। মানসিক ও দৈহিক যন্ত্রণা, বেদনা, ট্রমা – মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মধ্যে তিনি তৈরি করেছেন যোগাযোগের এক অভূতপূর্ব সাঁকো, যার মধ্যে প্রাচ্যের দর্শন রয়েছে পরতে পরতে।

প্রসঙ্গত, তিনি প্রথম এশীয় মহিলা সাহিত্যিক, নবম এশীয় সাহিত্যিক এবং দ্বিতীয় কোরিয়ান নাগরিক যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন। ইতিপূর্বে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম দে-জুং ২০০০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। এশীয় বা এশীয় বংশোদ্ভূত সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৩), জাপানি সাহিত্যিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাটা (১৯৬৮), কেনজাবুরো ওই (১৯৯৪), চিনে বংশোদ্ভূত ফরাসি সাহিত্যিক গাও শিংজিয়ান (২০০০), ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভি. এস. নইপল (২০০১), তুরস্কের সাহিত্যিক ওরহান পামুক (২০০৬), চিনে সাহিত্যক মো ইয়ান (২০১২), জাপানি বংশোদ্ভূত ইংরেজ সাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরো (২০১৭) – এই ৮ জন হানের আগে নোবেল পেয়েছেন। ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পান নরওয়ের সাহিত্যিক জন ফসে।

এখনও পর্যন্ত শারীরবিদ্যা বা মেডিসিন বিভাগ (যুগ্মভাবে ভিক্টর অ্যাম্ব্রোস এবং গ্যারি রুভকুন), পদার্থবিদ্যা (যুগ্মভাবে জন জে. হপফিল্ড এবং জিওফ্রে ই. হিন্টন), রসায়নবিদ্যা (তিনজন একসঙ্গে – ডেভিড বেকার, দেমিস হাসাবিস এবং জন এম. জাম্পার) এবং সাহিত্য – এই চারটে বিভাগেই ২০২৪ সালে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর ৬টি বিভাগে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় – সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, শান্তি, অর্থনীতি এবং শারীরবিদ্যা বা মেডিসিন। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেরার সেরাদের। ১৯৬৯ সালের আগে পর্যন্ত অর্থনীতি বাদে বাকি ৫টি বিভাগে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৬৯ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সভেরিগেস রিকসবাঙ্ক-এর উদ্যোগে অর্থনীতিতেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। বিজয়ীরা অ্যালফ্রেড নোবেলের চিত্র-খোদিত স্বর্ণপদক, শংসাপত্র এবং ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোন (আনুমানিক ৯ কোটি ভারতীয় টাকা) পেয়ে থাকেন।