রাজতন্ত্র ফেরাতে এবং নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার দাবিতে ফের অগ্নিগর্ভ নেপাল। শুক্রবারের পর শনিবারও রাজধানী কাঠমান্ডু-সহ বিভিন্ন এলাকায় রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ২ জনের মৃত্যু হয়। আহত শতাধিক। এই ঘটনার জেরে অচল পরিস্থিতি দেশের বিস্তীর্ণ অংশে। শুক্রবার কাঠমান্ডুর তিনকুনে এলাকায় রাজতন্ত্র সমর্থকদের এক সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শনিবারও কাঠমান্ডু-সহ বিভিন্ন শহরে কার্ফু ও সেনার টহলদারি চলে।
কয়েকদিন ধরেই নেপালে ফের রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্র দিবসে প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ এক ভিডিও বার্তায় সমর্থনের আবেদন করেছিলেন। তারপর থেকেই রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে উত্তাল হয়েছে নেপাল। এই আবহে শুক্রবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড পাল্টা রাজতন্ত্র বিরোধী সভা করে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেই অশান্তি আরও ব্যাপক আকার নেয় বলে অভিযোগ। সেই আন্দোলন ক্রমশ হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। ‘রাজা আও দেশ বাঁচাও’, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার নিপাত যাক’, ‘আমরা রাজতন্ত্রে ফিরতে চাই’ – একাধিক স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে বিভিন্ন এলাকা। শুক্রবার তিনকুনেতে একত্রিত হন কয়েক হাজার রাজতন্ত্র সমর্থক। সমাবেশ শেষ হওয়ার আগেই রাজতন্ত্রের সমর্থকেরা পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক বাড়ি, যানবাহন, সংবাদমাধ্যমের অফিস, সরকারি অফিসল, দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং জলকামান ব্যবহার করে। এর ফলে আহত হন এক বিক্ষোভকারী। হামলার মুখে পড়তে হয় দমকল কর্মীদে্রও। হিংসার জেরে আহত হন ১২ জন পুলিশ আধিকারিক। পুলিশের অভিযোগ, এঁদের অনেকেই সশস্ত্র ছিলেন। লুপ্ত হয়ে যাওয়া রাজতন্ত্র এবং ‘রাজধর্ম’ ফেরানোর দাবি তোলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি এবং বিরোধী দলনেতা প্রচণ্ডের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা।
এরপরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনকুনে, সিনামঙ্গল, কোটেশ্বর এলাকায় কার্ফু জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক, পুলিশের ডিজি দীপক থাপা, এবং কাঠমান্ডুর প্রধান জেলা আধিকারিক ঋষি রাম তিওয়ারির উপস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অন্যদিকে কাঠমান্ডুর ভৃকুটিমণ্ডপ এলাকায় প্রজাতন্ত্রের সমর্খদের এক সমাবেশ হয়। সেখানে হাজির ছিলেন হাজার হাজার প্রজাতন্ত্র সমর্থক। প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক, রাজতন্ত্র নিপাত যাক-এমন স্লোগান দেন তাঁরা। সিপিএন-মাওবাদী, সিপিএন-ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্টের মতো রাজনৈতিক দলগুলি এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। এই জনসভায় যোগ দেন প্রচণ্ড-সহ অন্যান্য মাওবাদী নেতারা।
প্রসঙ্গত, নেপালে নতুন করে অশান্তির শুরু হয় চলতি মাসের শুরু থেকে। নেপালের পশ্চিমাঞ্চল সফর শেষে জ্ঞানেন্দ্র কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন বিপুল সংখ্যক জনতা। জ্ঞানেন্দ্রকে আবার রাজপ্রাসাদে বসবাস করতে দেওয়ার দাবিও ওঠে। সেই সঙ্গে দাবি তোলা হয় নেপালকে আবার ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ঘোষণার। প্রসঙ্গত, প্রায় দু’দশক আগে নেপালে রাজতন্ত্র ছিল, শেষ রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। ২০০৬ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এর পরে ২০০৮ সালের মে মাসে সংবিধান সংশোধন করে ২৪০ বছরের পুরনো রাজতন্ত্র ভেঙে নেপালে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ২০১৫ সালে নতুন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান অনুমোদন পায়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জ্ঞানেন্দ্র নেপালের সাধারণ নাগরিক হিসাবে বাস করেন। তাঁর কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। রাজপ্রাসাদে যাওয়ারও অনুমতি নেই তাঁর। কোনওরকম সরকারি সুযোগ সুবিধেও তিনি পান না।
নেপালে যখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই সময়ে নেপাল ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসাবেই পরিচিত ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে নেপালকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা হয়। পরে দেশের সংবিধানেও সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।