‘আমি পদত্যাগ করিনি,  আমিই এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ – হাসিনার কথোপকথনে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত বাংলাদেশে 

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ভারতে পালিয়ে আসেন।  তাঁর বিরুদ্ধে শুরু থেকেই কড়া মনোভাব দেখিয়ে এসেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এখনও তিনি ভারতেই রয়েছেন। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক বসবাসের মেয়াদ শুক্রবার ৪৫ দিন পেরিয়ে গেছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি যে ভারতে থাকবেন, তা আগেই স্পষ্ট করেছিল দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রক। হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তে সব দল সায় দিয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার চেয়েছে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হোক।

এদিকে হাসিনার একটি টেলিফোনের কথোপকথন নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। কথোপকথোনে ধরা পড়েছে হাসিনার দাবি করেছেন, ‘আমি পদত্যাগ করিনি। বিশেষ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা আধিকারিকদের পরামর্শে আমি দেশ ছেড়েছি। আমিই এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ তাঁর এই বিতর্কিত দাবি নিয়ে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে।  হাসিনা নিজেকে এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করলেও এই নিয়ে নিশ্চুপ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনূস। শেখ হাসিনার পদত্যাগ না করার দাবি নিয়েও রা কাড়েনি বাংলাদেশ সরকার। আওয়ামী লিগের তরফে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে থাকলে তাঁর পদত্যাগপত্র  প্রকাশ করুক সরকার। দু’দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পদত্যাগপত্রের ছবি ভাইরাল হয়। যদিও সেটি সরকারের তরফেই প্রকাশ করা হয়েছে, তেমন দাবি করা হয়নি। অন্যদিকে, আওয়ামী লিগের দাবি, ওই পদত্যাগপত্র ভুয়ো।

হাসিনার দাবি নিয়ে এখন নুতন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, হাসিনাকে দেশত্যাগের পরামর্শ কে দিয়েছিল ? তিনি পদত্যাগ করে থাকলে প্রশাসনের তখন আর তাঁর নির্দেশ শোনার কথা নয়। তাহলে কার নির্দেশে বিমান বাহিনীর বিমান তাঁকে ভারতে পৌঁছে দেয় ? প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। তাঁকে দিল্লিতে পৌঁছে দেয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমান। সরকারের একাংশের দাবি ছিল, তাড়াহুড়োর মধ্যে হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেছেন। যদিও তাঁকে বহনকারী বিমানটির উড়ানসংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর আবাস ‘গণভবন’ যখন ছাত্র ও জনতার দখলে ছিল তখনও হাসিনা ও তাঁর বোন ঢাকায় ছিলেন। বেলা ৩টে ১১ মিনিটে তাঁর বিমান ঢাকা থেকে নয়া দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন।


এইসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছেন হাসিনা আসলে পদত্যাগ করেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই সেনাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ভারতে পৌঁছে দিতে। সেনা সেই নির্দেশ পালন করে।

হাসিনাকে ভারতে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমান। সেটির স্কোয়াক কোড (যা উড়ানের আগে প্রতিটি বিমানের জন্য বরাদ্দ হয়) এজিএএস ১৪৩১-এর ফ্লাইট ডিটেলস রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে, সেটি ঢাকা থেকে সরাসরি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয় বিকাল ৩’টা ১১ মিনিটে।

বাংলাদেশ প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল, হাসিনা ঢাকা থেকে প্রথমে সেনা হেলিকপ্টারে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় যান। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি  বিমানে তিনি দিল্লি রওনা হন। জানা যাচ্ছে ঢাকার একটি সেনা বিমান বন্দর থেকে তাঁর ফ্লাইটটি ওড়ে। গণভবনেও তখন লুঠতরাজ চলছে।   মিডিয়াতেও খবর খবর ছড়িয়ে পড়ে হাসিনা পালিয়েছেন। কিন্তু বিমানের রিপোর্ট অনুযায়ী , তিনি দেশ থেকে পালিয়েছেন বলে খবর  ছড়িয়ে পড়ার পরও অন্তত দু-আড়াই ঘণ্টা ঢাকাতেই ছিলেন তিনি । হেলিকপ্টার তাঁকে গণভবন থেকে সেনা বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল।

৫ আগস্ট হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে ৮ আগস্ট  রাত ৮’টা পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনও সরকার ছিল না। সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর সরকারিভাবে তিনিই প্রথম দেশবাসীকে জানান।

হাসিনার দেশত্যাগ এবং তাঁকে বিমানে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি কে দিয়েছিল সেই [প্রশ্নে সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি জানতেন না  । প্রশাসনিক মহলের বক্তব্য, বিমান বাহিনীর প্রধান এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কারণ আর্মি চিফ ওয়াকার-উজ-জামান বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান। আলঙ্কারিক হলেও সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি। ফলে তাঁর পক্ষেও হাসিনাকে দেশত্যাগের অনুমতি দেওয়া সম্ভব ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালালেও হাসিনার কথোপকথন নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করল। এই বিতর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ইউনূসের মৌনতা কবে ভাঙবে সেদিকেই তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক মহল।

প্রশাসনিক মহলের বক্তব্য, সেনা বিমানের দেশের সীমা অতিক্রম করে পড়শি দেশে যেতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি লাগে। হাসিনার

জানা যাচ্ছে, হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমায় থাকাকালে সেটির ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করা ছিল। এই যন্ত্র অফ করা থাকলে বিমানকে আকাশে লোকেট করা যায় না। শুধু এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। পাইলটের এই সিদ্ধান্ত থেকে ধারণা করা হচ্ছে, দেশের ভূখণ্ডে হাসিনার বিমান নিরাপদ বোধ করেনি। মনে করা হচ্ছে, হাসিনাকে বহনকারী বিমানটির নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।