সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদী মুখ হিসেবে চিন্ময় প্রভুকে বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের হিন্দুরা

রংপুরে হিন্দুদের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন চিন্ময় প্রভু। ফাইল চিত্র

বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা যেমন আক্রান্ত হয়েছেন, ঠিক তেমনি নাগরিকদের দুর্বল অংশ সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়ে চলেছে। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও সেই হিংসা কম-বেশি এখনও অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মৌলবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তির আক্রমণে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। নষ্ট করা হচ্ছে বহু সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

সংখ্যালঘুদের বহু হিন্দু মন্দির ও মূর্তি ভাঙচুর, বাড়ি ও দোকানে লুটপাট, এমনকি আগুন ধরিয়ে দেওয়ার খবর সামনে এসেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। এই অঞ্চলগুলি হল চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর ঠাকুরগাঁও, চাপাই নবাবগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত ও মফস্বল অঞ্চলে। বাদ নেই ঢাকা ও ঢাকার শহরতলি এলাকাগুলিও। এই ধারাবাহিক অত্যাচারের জন্য মূলত অভিযোগ উঠেছে খালেদার নেতৃত্বাধীন বি এন পি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি) এবং জামাত-ই-ইসলামির বিরুদ্ধে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জামাত-ই-ইসলামির মৌলবাদী শক্তির হিংসা ও লালসার শিকার হয়েছেন এই আক্রান্তরা। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রায় ৩০টি জেলাতে হিংসার ঘটনা বেশি ঘটছে।

এ ব্যাপারে গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হিউমান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশী মাইনোরিটিস (এইচ আর সি বি এম)-এর বাংলাদেশ ন্যাশনাল চ্যাপ্টার সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এই সংস্থা বাংলাদেশে অত্যাচারিতদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। সেই তালিকায় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেশি হলেও রয়েছেন আওয়ামী লীগের সদস্যরাও। আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণের যে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে, সেবিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে সরব হয়েছেন। এব্যাপারে তাঁরা বেশ কিছু মিথ্যা অভিযোগের নথি তুলে ধরেছেন। যদিও আদালতে অত্যাচারিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে মামলা লড়ার কোনও সাহস দেখাচ্ছেন না কোনও আইনজীবী।


এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশের জেলাগুলিতেও ‘সাইলেন্ট ভায়োলেন্স’ চলছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে হিন্দু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক এবং ভয় দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলা আদায় করা হচ্ছে। সেই টাকা যাচ্ছে জামাত ও বিএনপি-র আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীদের পকেটে। দেশের সংখ্যালঘুদের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এককথায় তাঁদের কণ্ঠরোধ করছে এইসব স্বৈরাচারী শক্তি। শাসকদলের নেতারা ফতোয়া জারি করেছে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারবে না। কেউ ভারতের পক্ষে কথা বলতে পারবে না। বাজারে বাজারে ভারতীয় পণ্য বর্জনের নির্দেশ দিচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এই নির্দেশ না মানলে সাধারণ মানুষকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সরকারি চাকরিরত সংখালঘুরাও বিভিন্ন হুমকির শিকার হচ্ছেন। তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, হয় চাকরি ছেড়ে চলে যাও, নাহলে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে যাও। বাংলাদেশের বাগেরহাটের একটি স্কুলে এরকমই এক হুমকির শিকার হয়েছেন এক শিক্ষিকা। ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি তাঁকে নির্দেশ দেয়, চাকরি ছেড়ে দিতে। কারণ তাঁরা চান না ওই স্কুলে কোনও সংখ্যালঘু চাকরি করুক।

ক্রমাগত এই অত্যাচার বাংলাদেশের হিন্দুরা এতদিন মুখ বুজে সহ্য করে আসছিলেন। কিন্তু তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে একজন সাহসী নেতাকে সামনে চাইছিলেন, যিনি এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের হয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভু ছিলেন সেই মুখ, যাঁর নেতৃত্বে তাঁরা একজোট হয়ে রাস্তায় নেমে মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করার সাহস দেখিয়েছিল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এই সন্ন্যাসী নেতা বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি করে শাসকদলের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রকাশ্য প্রতিবাদ সভায় সামিল হয়েছিলেন দেশের সংখ্যালঘু মা-বোনেরা। তাঁরা প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান তুলেছিলেন, ‘আমার মাটি, আমার মা, এই দেশ ছাড়বো না।’ যা সারা পৃথিবীতে আলোড়িত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশও বাংলাদেশে হিংসার বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।

আর দেশের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে স্লোগান দিতেই দেশের স্বৈরাচারী শক্তি আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে যায়। তারা এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে হিন্দুদের নেতৃত্বদানকারী মাথাগুলিকে নিষ্ক্রিয় করতে তৎপর হয়ে ওঠে। সেই তালিকায় প্রথমেই চলে আসে ইসকনের প্রাক্তন সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর নাম। তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা সহ একাধিক ধারায় অভিযুক্ত করে জেলে ভরে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রশাসন। গত ২৫ নভেম্বর তাঁকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিযোগ, এই হিন্দু নেতার প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এবার চিন্ময়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে মহিলাকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ সামনে এসেছে। তাঁকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে একটি পোস্ট। যেখানে মোট তিনটি ছবি শেয়ার করা হয়েছে। ছবিগুলিতে একটি গাড়ির ভিতরে গেরুয়া পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি একজন মহিলাকে অশালীনভাবে স্পর্শ করছেন। ছবি তিনটি শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময়কৃষ্ণ দাস একজন মহিলাকে গাড়ির ভিতরে শ্লীলতাহানি করছেন। যা সম্পূর্ণ ভুয়ো বলে জানা গিয়েছে। সম্প্রতি ইলিয়াস হোসেন নামে বাংলাদেশের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী চিন্ময়কৃষ্ণের নাম করে একটি ভিডিও ও ছবি শেয়ার করে দাবি করেছেন, “প্রভু পাদ চিন্ময়ের গাড়ির চিপায় নারী পাদ।”

যদিও পরে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ভারতের একটি জাতীয় সংবাদ সংস্থার ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাইরাল ছবির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও হিন্দু ধর্মগুরুর যোগ নেই। ভাইরাল হওয়া ওই ছবির গেরুয়া পোশাক পরিহিত ব্যক্তি আসলে রাজস্থানের সিকার জেলার কেশত্রপাল মন্দিরের পুরোহিত বাবা বালকনাথ। তিনি গত ২০ অক্টোবর এক কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তও হয়েছেন।