ভারতের জন্য দারুণ এক বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছে আমেরিকা। ‘বন্ধু’ মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর এমনটাই জানালেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারতীয় সময় হিসেবে শুক্রবার ভোররাতে শেষ হয় মোদী-ট্রাম্প বৈঠক। মোদীকে দীর্ঘদিনের ভাল বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করেন ট্রাম্প। মোদীকে উপহার দেন বই। মোদীর সঙ্গে দীর্ঘসময় করমর্দন করতেও দেখা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। ট্রাম্প বলেন, ‘সবচেয়ে সেরা একটি বাণিজ্য পথ তৈরি করার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছি আমরা। আমাদের তেল, গ্যাস, প্রচুর পরিমাণে কিনছে ওরা। ভারত এবং আমেরিকার জন্য দারুণ বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছি।’
ফ্রান্স সফর শেষ করে ভারতীয় সময় বুধবার রাতে আমেরিকায় পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওয়াশিংটন ডিসি-র হোয়াইট হাউসে পৌঁছতেই তাঁকে জড়িয়ে ধরেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ বুকে টেনে নিয়ে মোদীকে বলেন, ‘আপনাকে মিস করেছি৷’ শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বইটি উপহার দিয়েছেন তাতে লেখা, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, আপনি গ্রেট।’ সেখানে সই করেছেন ট্রাম্প। এই ছবি এক্স-এ পোস্ট করেছেন মোদী। বইটির প্রচ্ছদে লেখা, ‘আওয়ার জার্নি টুগেদার’ অর্থাৎ ‘আমাদের একসঙ্গে পথচলা’৷
কী কী বিষয়ে আলোচনা মোদী-ট্রাম্প বৈঠকে
৪১ লক্ষ কোটির বাণিজ্য চুক্তি—
হোয়াইট হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে ট্রাম্প জানান, ভারতের সঙ্গে দারুণ বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছে আমেরিকা। এই বাণিজ্য চুক্তির রূপরেখা জানিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা ইতিহাসের অন্যতম সেরা বাণিজ্য পথ ধরে কাজ করতে সম্মত হয়েছি। এই বাণিজ্য পথ ভারত থেকে শুরু হয়ে ইজরায়েল, ইটালিকে ছুঁয়ে আমেরিকায় আসবে।’ সড়ক, রেল এবং সমুদ্রগর্ভের পথে চলা এই বাণিজ্য দুই দেশের সহযোগী দেশগুলিকেও ছুঁয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। মোদী জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দুই দেশের বাণিজ্যের অর্থমূল্য হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় এই অর্থমূল্য ৪১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর মোদী বলেন, আমেরিকার নাগরিকরা MAGA (মেক আমেরিকান গ্রেট এগেন) সম্পর্কে জানেন। ভারতবাসীও ২০৪৭ সালের মধ্যে বিকশিত ভারতের পথে এগোচ্ছে। তবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও সেখানে শুল্ক যুদ্ধ চলবে কি না তা স্পষ্ট হয়নি।
পারস্পরিক শুল্ক আরোপ—
ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমেরিকা থেকে ভারতে আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ক কমানো, আরও বেশি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে খনিজ তেল এবং সামরিক বিমান কেনার চুক্তি হবে। ট্রাম্প বলেন, ‘তেল-গ্যাস, এলএনজি বিক্রির মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই ঘাটতি পূরণ করতে পারি প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং আমি শক্তির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি, যা আমেরিকাকে ভারতে তেল ও গ্যাসের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে পুনরুদ্ধার করবে।’
শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনায় মোদীর প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেছেন, ‘উনি আমার চেয়ে আরও কঠিন এবং ভাল মধ্যস্থতাকারী। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতে পারে না। প্রসঙ্গত, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ আমেরিকা থেকে ভারতে রপ্তানি হওয়া পণ্যের তুলনায় ভারত থেকে সে দেশে রপ্তানি হওয়া পণ্যের পরিমাণ বেশি। সেই অসামঞ্জস্য দূর করতে ভারত আরও বেশি খনিজ তেল আমেরিকা থেকে কেনার আশ্বাস দিয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প।
মোদীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই পারস্পরিক শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। এই শুল্কের অর্থ হল, যে দেশ আমেরিকার পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করবে, সেই দেশের পণ্যের উপরেও পাল্টা কর চাপাবে আমেরিকা। ভারত আমেরিকার পণ্যে শুল্ক চাপালে দিল্লিকেও যে ছাড় দেওয়া হবে না, বৃহস্পতিবার সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘ভারত যে হারে শুল্ক চাপাবে, আমরাও সেই হারে শুল্ক চাপাব।’
মুম্বই হামলার চক্রীকে ভারতে প্রত্যর্পণ—
বাণিজ্য চুক্তি পাশাপাশি মুম্বই হামলার মূলচক্রী তথা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তাহাউর রানাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। দীর্ঘদিন ধরেই ২৬/১১ হামলার মূলচক্রী তাহাউর রানাকে হাতে পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল ভারত। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ছিল তাহাউর রানার প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে শেষ ভরসা। গত ২৫ জানুয়ারি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, ২৬/১১ হামলার মূলচক্রী তাহাউর রানাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ভারতের দাবি ছিল, এই দেশের বিচারব্যবস্থায় তাহাউর রানার বিচার হওয়া উচিত। ভারতের দাবি মেনেই তাহাউরের প্রত্যর্পণে সায় দেয় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক শেষে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, তাহাউরকে ভারতে পাঠানো হবে।
ভারতকে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান—
কেবল ২৬/১১ হামলার চক্রীকে ভারতে ফেরানোই নয়, দিল্লির হাতে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তুলে দেওয়ার ঘোষণাও করেছেন ট্রাম্প। যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে মোদীকে পাশে নিয়েই ট্রাম্প জানান, ভারতকে সমরাস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করবে আমেরিকা। ট্রাম্প জানান, এফ-৩৫ জেটগুলি বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক । লড়াইয়ে টিকে থাকার ব্যাপারে এগুলি খুব শক্তিশালী বিমান হিসেবে পরিচিত। ট্রাম্প বলেন, ‘এই বছর থেকে আমরা ভারতে অনেক বিলিয়ন ডলার সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বৃদ্ধি করব।’
বাণিজ্য ঘাটতি ভারতকে আমেরিকা থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান-সহ সামরিক সরঞ্জাম, তেল-গ্যাস সরবরাহ করবে এমন কথা বললেও উঠছে বেশ কিছু প্রশ্ন। এই যুদ্ধবিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করবে এমন কথা ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ বললেও, উঠে আসছে অন্য প্রশ্নও। প্রশ্ন উঠছে ‘ব্যবসায়ী’ মনোভাবাপন্ন ট্রাম্প কি এই যুদ্ধবিমান দেওয়ার কথা বলে অন্য উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাইছেন? অনেকেই এক্ষেত্রে ‘ব্যবসায়ী’ ট্রাম্পের কৌশল দেখতে পাচ্ছেন। শুল্ক চাপানোর হুমকির পাশাপাশি রোজগার বাড়ানোর লক্ষ্যে এটি ট্রাম্পের একটি চাল বলে মনে করছেন অনেকেই। তাই ভারতের মতো দেশ যদি ‘স্বাবলম্বী’ হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে বড় বাজার হাতছাড়া হতে পারে। সেকথা মাথায় রেখেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট এফ-৩৫ ভারতের হাতে তুলে দিতে চাইছেন এই প্রশ্ন উঠছে।
এফ-৩৫ শক্তিশালী এই যুদ্ধবিমান পঞ্চম প্রজন্মের। এমন যুদ্ধবিমান ভারতের কাছে বর্তমানে নেই। এফ-৩৫-এর অন্তর্ভুক্তি ভারতীয় বায়ুসেনার প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। কিন্তু সত্যিই কি এই বিমান ত্রুটিমুক্ত? যুদ্ধক্ষেত্রে বহুমুখী দক্ষতা থাকলেও এর রাডারের ত্রুটি, ল্যান্ডিংয়ের সমস্যা নিয়েও কথা হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে, ২৮ জানুয়ারি আলাস্কায় মহড়ার সময় ভেঙে পড়েছিল একটি এফ-৩৫এ লাইটনিং ২ ফাইটার জেট। এর আগেও মাঝে মাঝেই এই বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এমন এক যুদ্ধবিমান পেয়ে কি আদৌ কোনও লাভ হবে ভারতের, সেই প্রশ্ন উঠছে।
এছাড়াও উন্নত প্রযুক্তির এই যুদ্ধবিমানের দাম আকাশছোঁয়া। আমেরিকার সামরিক খাতের ব্যয়ের সঙ্গে তা মানানসই হলেও ভারতের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত দামি। প্রধানমন্ত্রী মোদী বারবার ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে ওঠার ডাক দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে এত দাম দিয়ে আমেরিকার থেকে যুদ্ধবিমান না কিনে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনও বিমান নির্মাণের পরিকল্পনা কেন করা হল না উঠছে এই প্রশ্ন।