ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত মায়ানমার এক মৃত্যুপুরীর চেহারা নিয়েছে। শেষ পাওয়া খবরে ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজার ৬৪, আহত ৩ হাজার ৪০৮ জন। নিখোঁজের সংখ্যা ১৩৯। এর মধ্যে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে অন্ততপক্ষে ৭৮ জনের খোঁজ মিলছে না।প্রকৃতির তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককের একাংশ। মৃতের পাশাপাশি আহতের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি। ভূমিকম্পে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মায়ানমার ও ব্যাঙ্ককে ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে ভারত। ১৫ টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে অপারেশন ব্রক্ষ্মার অধীনে ভারতের পাঠানো প্রথম দফার ত্রাণ পৌঁছে গিয়েছে মায়ানমারে। মায়ানমারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সহায়তা পাঠিয়েছে রাশিয়া এবং চিনও। শনিবারও আফটারশক অনুভূত হয়েছে।
শনিবার রাতে মায়ানমারে ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ হাজার ৬৪৪ জন। গুরুতর জখম প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। জুন্টার তরফে জানানো হয়েছে, নিখোঁজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৯-এ। শনিবার সকালে সে দেশের সামরিক জুন্টা সরকারকে উদ্ধৃত করে এক সংবাদ সংস্থা জানিয়েছিল, অন্তত ৬৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ভূমিকম্পের কারণে। আহতের সংখ্যা ১৬৭০। পরে মায়ানমারের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানায়, মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০০২। আহত হয়েছেন ২ হাজার ৩৭৬ জন। নিখোঁজ ৩০ । কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, লাফিয়ে বেড়েছে মৃত্যুসংখ্যা। এখনও দেশের বিভিন্ন এলাকায় উদ্ধারকাজ চলছে জোরকদমে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা। মায়ানমারে বর্তমানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এই কঠিন সময়ে অন্যান্য দেশের কাছে সাহায্য চেয়েছে মায়ানমার।
ভারতের পাশাপাশি চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইরান, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া-সহ বিভিন্ন দেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। চিন থেকে ৮২ জনের একটি উদ্ধারকারী দল মায়ানমারে পাঠানো হয়েছে ।দক্ষিণ কোরিয়া ২০ লক্ষ ডলারের ত্রাণ পাঠাচ্ছে। মায়ানমারে ৪৯ জনের উদ্ধারকারী দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালয়েশিয়া। পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছে ইরান এবং ইন্দোনেশিয়া।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্স-এ পোস্ট করে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এও জানান যে, ভারত সবরকম সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। বিদেশ মন্ত্রককে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে বলেও মোদী জানান।
শুক্রবার সকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ১৫ বার কেঁপে উঠেছে ভারতের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার। রিখটার স্কেলে প্রথমে মাত্রা ছিল ৭.৭। শুক্রবার ভারতীয় সময় ১১টা ৫০ মিনিটে প্রথম ভূমিকম্পটি হয় মায়ানমারে। উৎপত্তিস্থল সেদেশের সাগাইং শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এর ১০ ঘণ্টার মধ্যে ১৪টি ‘আফটারশক’ অনুভূত হয়েছে। ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবচেয়ে শক্তিশালী ‘আফটারশক’টি হয়। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৬.৭। উভয়ক্ষেত্রেই কম্পনের উৎসস্থল ছিল মাটি থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। এই দুই কম্পনে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর বাকি ‘আফটারশক’গুলি আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি জানিয়েছে, শুক্রবার রাত ১১.৫৬ মিনিটেও এক বার ভূমিকম্প হয়েছে মায়ানমারে। তার তীব্রতা ছিল ৪.২। ‘আফটারশক’গুলি উদ্ধার কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
সেই সময় কম্পন অনুভূত হয় বাংলাদেশের ঢাকা-সহ একাধিক জায়গায়। এর প্রভাব পড়ে ভারতেও। কেঁপে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হাওড়া, হুগলি-সহ একাধিক জেলা ও সিকিমও। কম্পন অনুভূত হয় দিল্লিতেও।
মায়ানমারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডও। সেখানকার রাজধানী শহর ব্যাঙ্ককে নির্মীয়মাণ ৩০ তলা ভবন ধূলিসাত হয়ে গিয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার বিকালে একটি ভেঙে পড়া আবাসনের ভিতর থেকে ৩০ বছর বয়সের এক মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘রেড ক্রস’-এর আশঙ্কা ছিল, ওই আবাসনের মধ্যে অন্তত ৯০ জন আটকে থাকতে পারেন। একই আশঙ্কা করছে মায়ানমারের জুন্টা সরকারও। ভেঙে পড়ে একের পর এক বহুতল, ব্রিজ। ভূমিকম্পের একাধিক ভিডিও ভাইরাল হতে থাকে সমাজ মাধ্যমে। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির খবর।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, শনিবার ভোরে উত্তরপ্রদেশের হিন্ডন বায়ুসেনা স্টেশন থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার সি১৩০জে বিমান ১৫ টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মায়ানমারের উদ্দেশে রওনা যায়। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মায়ানমারে পাঠানো হয়েছে খাবার, কম্বল, তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, সৌরবিদ্যুত চালিত বালতি, সোলার ল্যাম্প, জল পরিশোধক, জেনারেটর সেট এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।
ভূমিকম্পে মায়ানমারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মান্দালয় শহর। সেখানে একটি মসজিদ ভেঙে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ভেঙে গিয়েছে ২টি সেতু এবং একাধিক বাড়ি। রাতে জুন্টা প্রধান মিন আং লাইং মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক এলাকায় এখনও বাড়ি ভেঙে পড়ে রয়েছে। আমরা সাধ্যমতো উদ্ধারকাজ চালাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্যও আবেদন জানাচ্ছি।’ গৃহযুদ্ধে দীর্ণ মায়ানমারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুন্টা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেই সমস্ত এলাকায় ভূমিকম্পের ফলে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি বলেই মনে করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ছ’টি প্রদেশে শুক্রবার জরুরি অবস্থা জারি করেছে জুন্টা সরকার।
ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত এলাকার হাসপাতালগুলিতে রক্তের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এখানে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা।