• facebook
  • twitter
Sunday, 22 December, 2024

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের প্রকৃত ছবিটি কি মনে রেখেছে বাংলাদেশ?

ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল জামায়েতে ইসলামী বা জামাত ও তার সহযোগী সংগঠনগুলি। এই জামাতপন্থীরা এতকাল মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী 'রাজাকার' হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ চুক্তির মুহূর্তে। ফাইল চিত্র

সৈয়দ হাসমত জালাল

ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত কিনা, তা আজ অবশ্যই ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আজ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এর কারণ, সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের  অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীপন্থী। কেউ কেউ সরাসরি জামাতের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত। আওয়ামী লীগ- বিরোধিতাকে তাঁরা ভারত-বিরোধিতার সমর্থক করে তুলতে সফল হয়েছেন।

ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল জামায়েতে ইসলামী বা জামাত ও তার সহযোগী সংগঠনগুলি। এই জামাতপন্থীরা এতকাল মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী ‘রাজাকার’ হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। এদের পক্ষপাত স্পষ্টতই ছিল পাকিস্তানের অর্থাৎ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি। এই মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগের প্রধান তখন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকায় গিয়ে অবিস্মরণীয় ভাষণটি দিয়েছিলেন, তাকেই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বলে ধরা হয়। যদিও সরকারিভাবে ওই মাসেরই ২৬ তারিখ অর্থাৎ ২৬ মার্চ শেখ মুজিবের নির্দেশে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি বিবৃতি পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। তিনি তখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক। এরপরই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র আক্রান্ত হয় এবং কলকাতার বালিগঞ্জে ‘আকাশবাণী কলকাতা’র সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এর উদ্দেশ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ এবং আদর্শ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া।

তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধে ভারত মিলিটারি ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্য থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে যে সহযোগিতা করেছিল, আজকের বাংলাদেশ তা কি ভুলে যাবে! সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়েও বাংলাদেশের মানুষের এই গণযুদ্ধকে সফল করে তোলার পেছনে ছিলেন সেদিনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করলে সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত। আর মাত্র ১৩ দিনেই স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের তৎকালীন জেনারেল নিয়াজী প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সহ সমর্পণ করেন ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর কাছে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা ময়দানে, এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সমর্পণ চুক্তি করেছিলেন নিয়াজী। সেদিনকার সেই ছবি কি ভুলে গেছে এই বাংলাদেশ!

যখনই কোনও ধর্মীয় মৌলবাদী দল কোনও দেশের ক্ষমতায় আসে, তারা তখন উগ্র জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে দেশের মানুষকে খেপিয়ে তুলে নিজেদের প্রতি সমর্থন ধরে রাখে। এই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সবসময় অন্য কোনও রাষ্ট্র বা জাতিকে শত্রু হিসেবে প্রবলভাবে তুলে ধরা হয়। আর সেই বিরোধী রাষ্ট্র বা জাতির প্রতি তুমুল বিদ্বেষ প্রচারের মধ্যে দিয়েই জাতীয়তাবাদ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এই জাতীয়তাবাদের খেলাটি এখন খেলছেন বাংলাদেশের নেতা ও নেতৃস্থানীয় মানুষেরা। আর তার দ্বারা প্রভাবিত দেশের অধিকাংশ মানুষ। এখন বাংলাদেশের যে কোনও টেলিভিশন চ্যানেল খুললেই দেখা যাবে শুধু ভারত বিদ্বেষী আলোচনা। আসলে এই তীব্র ভারত-বিরোধী চিৎকার করে তাঁরা সেদেশের মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে চাইছেন। সবচেয়ে বড় কথা এই জাতীয়তাবাদের কাছে, রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘সত্য, দয়া, মঙ্গল সমস্ত নিচে তলাইয়া যায়’। এখন সত্য নয়, মানুষের প্রতি সহানুভূতি নয়, মঙ্গল কামনা নয়, এখন সেখানে সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভারত-বিরোধিতা। আর তাই সেখানে আক্রান্ত সংখ্যালঘু হিন্দুরা।

তার প্রভাব এসে পড়েছে আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানকার হিন্দু-নিগ্রহকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও রাজনীতি শুরু হয়েছে, তাও একেবারেই কাম্য নয়। সম্প্রতি ভারতের বিদেশ সচিব ঢাকা সফরে গিয়ে সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে এসেছেন। সেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলে তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথাও বলে এসেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। ভারত কখনোই বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটিও নেওয়ার কথা উচ্চারণ করেনি। অথচ বাংলাদেশের নেতাদের মুখে শোনা যাচ্ছে, ভারত আগ্রাসন চালালে বা চট্টগ্রাম দখল করতে এলে তাঁরা কলকাতা দখল করবেন। কেউ বলছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়বেন। এতে সুর মেলাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তারাও। মজার কথা, খালেদা জিয়ার বিএনপি দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভি আবার বাংলা-বিহার-ওড়িশা দখলের কথা ঘোষণা করেছেন। খুবই হাস্যকর এসব তর্জন-গর্জন। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন তাঁরা। আসলে এসব বলে বিএনপি এখন জামায়েত ইসলামীর চেয়েও নিজেদের বেশি দেশপ্রেমী প্রমাণ করতে চাইছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিএনপি তো একসময় বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় ছিল। আর তার প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ছিল তাদের শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক। রিজভি কি সে কথা ভুলে গেলেন?

এই ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হল ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। বাংলাদেশের মানুষ কি ভুলে গেলেন, ১৯৭১-এর এই সময়েই পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। আর এইসব বুদ্ধিজীবীদের চিনিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানপন্থী জামাতের লোকেরাই। আর তাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জামাতপন্থী উপদেষ্টাদের নির্দেশে ১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ নিয়ে কোনও আলোচনা সভা কোথাও হয়নি। কারণ এ বিষয়ে আলোচনা হলে সেদিন জামাতের কী ভূমিকা ছিল, সে প্রসঙ্গ তো উঠতই। তাই শুধুমাত্র পুষ্পার্ঘ প্রদানের মধ্যেই সীমিত থাকল উদযাপন।

১৯৭১ সালের পর থেকে কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন করে এসেছে। কিন্তু এবছর বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এই যৌথ উদযাপনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক উদযাপিত বিজয় দিবসে অংশগ্রহণ করবে, কিন্তু তা নিছকই নিয়মরক্ষা মাত্র। আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতের সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে কি পেছনে ঠেলে দিতে চাইছে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার! কিন্তু মনে রাখা দরকার, ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থানই বাংলাদেশের মানুষের জন্যে যেমন মঙ্গলের, তেমনই ভারতের পক্ষেও তা গভীর স্বস্তির। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সবসময়ই চেয়েছেন। ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, খাদ্য সব মিলিয়ে হাজার বছরের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছেন দুই বাংলার মানুষই। ওপার বাংলার অর্থাৎ বাংলাদেশের সাধারণ সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষের চাওয়াও এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। তাই এই ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতি দ্রুত বন্ধ হওয়াই কাম্য।