দিল্লি, ২৫ জুলাই – কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে উত্তাল বাংলাদেশ। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, তার পরিণামে মৃত্যু, অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। সেই আন্দোলন ও সংঘর্ষের কারণে নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছেন বহু পরিবার। আর এই সংঘর্ষের পরিণামেই একমাত্র সন্তানকে হারালেন এক দম্পতি। ছোট্ট রিয়া গোপ, বছর সাড়ে ছয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় থাকত। বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় যখন বিদ্রোহের আগুন, সেই আগুনের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জেও। গত শুক্রবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিল ছোট্ট রিয়া। কিছু ক্ষণ পরই অশান্ত হয়ে ওঠে ওই এলাকা। রিয়াদের বাড়ির সামনে শুরু হয় সংঘর্ষ । আতঙ্কিত হয়ে পড়েন দীপক কুমার গোপ এবং তাঁর স্ত্রী বিউটি। কন্যাকে ছাদ থেকে নিয়ে আসার জন্য প্রাণপণে ছুট দেন ছাদের দিকে। দীপক ছোট্ট শিশু কন্যাকে কোলে নিতেই রাস্তা থেকে ছোড়া একটি গুলি এসে লাগে রিয়ার মাথায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপক দেখেন তাঁর জামা রক্তে লাল। মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা । দীপকের কাঁধে মাথা রেখে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল ছোট্ট রিয়া। কন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন দীপক। বাড়ির কাছেই একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় রিয়াকে। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। দ্রুত অস্ত্রোপচারও করা হয় । চিকিৎসকেরা আশ্বস্তও করেছিলেন গোপ দম্পতিকে।
তবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা সম্ভব নয় । শুক্রবারের পর করে কেটে যায় তিন দিন । রিয়ার আঙুলের নড়াচড়া দেখে আশার আলো জাগে গোপ দম্পতির মনে । কিন্তু সব আশা নিভিয়ে দিয়ে বুধবার হাসপাতালেই মৃত্যু হয় রিয়ার। হাসপাতালে রিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা হয়েছে ‘গানশট ইনজুরি’। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে দিশাহারা হয়ে পড়েন মা- বাবা।
বুধবারই রিয়ার দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। হাসপাতালের মর্গের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন দীপক। মর্গের সামনে দাঁড়িয়েই দীপক বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, “কোথা থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝি নাই। আমার কোলেই মেয়ের মাথা থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছিল।” তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলেন আত্মীয়েরা। কিন্তু চিৎকার করে দীপক বলতে থাকেন, “আমার ছোট মা-রে, তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলি। তোরে ছাড়া আমরা কেমনে বাঁচব।”
দীপক এবং বিউটির একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া। স্থানীয় একটি দোকানে কাজ করেন দীপক। বিয়ের পাঁচ বছর পর তাঁদের কন্যাসন্তান হয়। এই বছরই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিয়াকে ভর্তি করেন গোপ দম্পতি। নয়নের মণি রিয়াকে হারিয়ে শোকে- দুঃখে পাথর হয়ে গেছেন তাঁরা।
কাঁদতে কাঁদতে একসময় বোধহয় চোখের জলও শুকিয়ে যায় । একা একাই বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিলেন, “কোথা থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আমার কোলেই মেয়ের মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।” এরপরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সদ্য কন্যাহারা বাবা। বাংলাদেশে অশান্তির আবহে এই প্রথম এত ছোট কোনও শিশুর প্রাণ গেল, সন্তানহারা হলেন হতভাগ্য দম্পতি ।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে ঢাকার রাজপথে এখনও জারি রয়েছে পুলিশি টহলদারি। মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনী এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের জওয়ান। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, বুধবার পর্যন্ত অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগে গোটা দেশে ১৭৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে । ধৃতদের তালিকায় রয়েছেন বিএনপি ও জামাতের বেশ কয়েক জন নেতাও।
আংশিক শিথিল হলেও বাংলাদেশে এখনও জারি রয়েছে কার্ফু। মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনের সাধারণ ছুটির পর, তা আর বাড়ানো হয়নি। বুধবার থেকেই ঢাকা-সহ চার জেলায় সাত ঘণ্টার জন্য কার্ফু শিথিল করা হয়েছে। চার ঘণ্টার জন্য খুলেছে অফিস-কাছারি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এখনই খুলছে না বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে হাসিনার সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যেই দুশো ছাড়িয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, বৃহস্পতিবার সকালে পাওয়া খবরে জানা যায় সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও বিক্ষোভ পরবর্তী সংঘাতে মৃত্যু হয়েছে ২০১ জনের ।