পুলক মিত্র
দেশজুড়ে এখন গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উৎসব চলছে৷ ইতিমধ্যে একাধিক পর্বের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে৷ ৪ জুন কেন্দ্রে কারা সরকার গড়বে, তা নিয়ে এখন নিরন্তর বিভিন্ন মহলে চর্চা চলছে৷ এই ভোটপর্বের মধ্যেই নজর কেড়েছে রাজ্যে রাজ্যে তাপপ্রবাহের দাপট৷ আবহাওয়া দফতর ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশে তাপপ্রবাহ নিয়ে সতর্কতাও জারি করেছে৷ এই পর্যন্ত যা ভোট হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তীব্র অস্বস্তিকর গরম আর তাপপ্রবাহের কারণে অনেক ভোটদান কেন্দ্রে ভোটারদের আশানুরূপ ভিড় হয়নি৷
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দুই দফার ভোটের প্রাথমিক হার যেমন ছিল, তৃতীয় দফাতেও তার বিশেষ হেরফের হয়নি৷ ৭ মে ১০ রাজ্য ও ২ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৯৩টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়৷ বিকেল ৫টা পর্যন্ত এসব আসনে ভোট পড়েছে ৬০ দশমিক ১৯ শতাংশ৷ বিহার (৫৬), মহারাষ্ট্র (৫৩), গুজরাট (৫৫) ও উত্তর প্রদেশের (৫৫) ভোটের হার এই দফায়ও আশানুরূপ নয়৷ তবে এই দফাতেও যথারীতি আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে ভোট বেশি পড়েছে৷
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে আসামে, ৭৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ৷ সবচেয়ে কম মহারাষ্ট্রে, ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ৷ পশ্চিমবঙ্গের হার প্রায় ৭৪ শতাংশ৷
গত ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার ভোটের পর নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, ভোটের গড় হার ৬০ শতাংশ৷ ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার ভোটের পর বলা হয়, ভোট পড়েছে ৬০ দশমিক ৯৬ শতাংশ৷ অথচ ৩০ এপ্রিল কমিশন সংশোধিত হার পেশ করে জানায়, প্রথম দফায় ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং দ্বিতীয় দফায় ৬৬ দশমিক ৭১ শতাংশ৷ ভোট পড়েছে৷ ভোটের হার আচমকাই ৬ শতাংশ করে বেড়ে যাওয়ার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে৷
যাই হোক, ফিরে আসি তাপপ্রবাহের কথায়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোপার্নিকাস ক্লাইমেট সার্ভিসেসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-এর এপ্রিল ছিল এ যাবৎকালের মধ্যে উষ্ণতম মাস৷ পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ধারাবাহিক উন্নয়ন নিয়ে নানা বিতর্ক, আলোচনার মধ্যেই যে প্রশ্নটি উঠে আসছে, তা হল, জলবায়ু পরিবর্তন ভারতের নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কেন ভারতের মানুষের কেন উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে? অতীতের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে যে তথ্য সামনে এসেছে, তা হল, ২০২৩ সাল ছিল উষ্ণতম বর্ষ৷ ভারতের আবহাওয়া দফতরের সতর্ক বার্তা অনুযায়ী, চলতি বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে৷ দেশের কোনও কোনও জায়গায় তাপমাত্রার পারদ ইতিমধ্যেই ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছে৷ ভারতীয় আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১০ থেকে ২০ দিন তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে পারেন দেশবাসী৷
গবেষণা সংস্থা ক্লাইমেট ট্রেন্ডস জানাচ্ছে, “মারাত্মক তাপপ্রবাহের নিরিখে ভারতকে অতি উচ্চ স্তরের বিপজ্জনক পর্যায়ে রেখেছেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা৷ আরও চিন্তার হল, বর্তমানে যে হারে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, সেই ধারা বজায় থাকলে, তাপপ্রবাহের মাত্রা ৬ গুণ বাড়তে পারে, ২০৫০ সালের মধ্যে যার কবলে পড়বেন ১০০ কোটি মানুষ৷”
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা আক্ষেপ করে বলছেন, “গত বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতে তাপপ্রবাহের দাপট চললেও, জলবায়ু পরিবর্তন নির্বাচনে কোথাও কোনও আলোচনা নেই৷ তাপপ্রবাহ মোকাবিলা নিয়ে আমাদের কোনও নীতিও নেই৷ অথচ আমরা এখন এমন অবস্থায় নেই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়কে উপেক্ষা করতে পারি৷
গত এক দশকে আমরা বেশ কিছু উষ্ণতম বছর দেখেছি৷ ২০১৪ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছিল ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ ২০১৯ সালে তা পৌঁছে যায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে৷ নাসার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়ে হয়েছে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ১৪৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এই তাপপ্রবাহের কথা মাথায় রেখে ভারতের নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলিতভাবে টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে৷ তীব্র গরমে ভোটারদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, পানীয় জল সহ অন্যান্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশন ৬ মাসের মধ্যে যে কোনও সময় ভোট করাতে পারে৷ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একদিনও যাতে বিলম্বিত না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হয় কমিশনকে৷
এছাড়া ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ভোট করার অন্যতম সমস্যা হল, সেসময় স্কুল-কলেজগুলিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়৷ পাশাপাশি শিক্ষাবর্ষের যে চক্র রয়েছে, তা নিয়েও কমিশনকে ভাবতে হয়৷ তবুও তাপমাত্রা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে, তবে তা নিয়েও ভাবতে হবে৷
প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও পি রাওয়াত বলেন, “সংসদীয় নির্বাচনের জন্য ৬ মাসের সময়সীমা থাকে৷ বর্তমান সরকারের মেয়াদ অনুযায়ী, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে ১৬ জুন ২০২৪-এর মধ্যে যে কোনও সময়ে ভোট করা যেত৷ যেহেতু নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে, তাই ২-৩ মাসের বিরতি রেখে মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করা হয়৷” তাঁর কথায়, “এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে ২-৩ মাস দেরিতে রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন শেষ করে তারপর ৬ মাসের সময়সীমার মধ্যে আগে লোকসভার ভোট সম্পন্ন করার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷”
তবে কি আগামী লোকসভা নির্বাচন থেকে সময়সূচিতে বদল আনা উচিত? এর পরের লোকসভার ভোট হবে ২০২৯-এ৷ সেই হিসেবে ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুনের মধ্যে যে কোনও সময়ে ভোট করা যেতে পারে৷ ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস হল, ভোট করার আদর্শ সময়৷ কিংবা আইন সংশোধন করতে হবে, যাতে নির্বাচন কমিশন বিধানসভাগুলির ভোট আগে সেরে ফেলতে পারে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের৷