দিনভর দুর্যোগ, মর্মান্তিক মৃতু্য বাবা ছেলের
আমিনুর রহমান, বর্ধমান, ২৭ মে– ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কৃষি প্রধান পূর্ব বর্ধমান জেলায় ফসল ও সবজি চাষ চিন্তার মধ্যে ফেলেছে চাষিদের৷ জেলার বিভিন্ন ব্লকে ঝড় ও বৃষ্টিতে কাঁচা সবজি বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে৷ অন্যদিকে আম এবং ফুল চাষের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো তাতে রীতিমত চিন্তার ভাঁজ চাষিদের কপালে৷ তবে বর্ষার ধান চাষে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন চাষিরা৷ চাষের জমির মাটি যেভাবে ফেটে গিয়েছিল সেই অবস্থায় মাটি ভিজে থাকায় বীজতলা তৈরিতে কিছুটা সুবিধা মিলতে পারে৷ একই সঙ্গে জমি চষার ক্ষেত্রে সমস্যা মিটবে৷ এদিকে যেভাবে সবজির ক্ষতি হয়েছে তাতে বর্ধমানের বাজারে এবার সবজির ঘাটতি হতে পারে বলে দাবি পাইকারি আড়তদারদের৷ বাড়তে পারে দামও৷ এমনটাই আশঙ্কা সকলের৷ অন্যদিকে সোমবার দুর্যোগের মধ্যেই বর্ধমানের পাল্লা এলাকায় বিদু্যৎ পৃষ্ট হয়ে বাবা ও ছেলের মৃতু্য হলো৷ সোমবার একটানা কখনও ভারি ও হালকা বৃষ্টিতে কার্যত জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পডে়৷ শহরের রাস্তায় যানবাহন চলাচল ছিল কম৷ যোগাযোগের সমস্যা থাকায় অনেকেই সপ্তাহের প্রথম দিনে কর্মস্থলে যেতে পারেন নি৷ বাজার হাট প্রায় বন্ধ ছিল, ক্রেতা বিক্রেতা কারোর দেখা মেলেনি৷ সূত্রের খবর সরকারি দপ্তরগুলিতে তুলনামূলকভাবে হাজিরা কম ছিল৷ রবিবার রাতের দিকে ঝড় ও বৃষ্টির সময় বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় বিদু্যৎ বিভ্রাট দেখা দেয়৷ সোমবার দুপুর পর্যন্ত ওই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়৷
রবিবার রাত থেকেই বর্ধমানের বিভিন্ন এলাকায় রেমালের দাপটে বৃষ্টি শুরু হয়৷ সোমবারও একটানা বৃষ্টি চলে৷ তার সঙ্গে ছিল ঝোড়ো হাওয়া৷ এরই মধ্যে বর্ধমানের মেমারি থানা এলাকার পাল্লা কুমোরপাড়া এলাকায় বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে একই সঙ্গে বাবা ও ছেলের মর্মান্তিক মৃতু্য হয়৷ বাডি় ঢোকার মুখে একটি কলা গাছ ঝডে় পডে়ছিল৷ সেই গাছ কেটে সরাতে গিয়ে ফরে সিংহ নামে স্থানীয় বাসিন্দা বিদু্যৎস্পৃষ্ট হন৷ ওই কলাগাছে বিদু্যতের তার জডি়য়ে ছিল বলে অভিযোগ এলাকায়৷ এদিকে বাবা দীর্ঘ সময় ঘরে না আসায় তার ছেলে তরুণ সিংহ বাইরে বের হয়ে দেখেন তিনি পডে় আছেন৷ বাবা উদ্ধার করতে গেলে ছেলেও বিদু্যৎস্পৃষ্ট হন৷ এরপর স্থানীয়রা বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ওই দুজনকে বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন৷ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে৷ এর পাশাপাশি বিদু্যৎ দপ্তরের গাফিলতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷
এদিকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় রবি ও সোমবার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন৷ বিশেষ নজরদারি ছিল জেলার বেশ কয়েকটি জায়গায়৷ যেখানে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল৷ বিভিন্ন এলাকায় রেমালের জন্য আগাম সতর্কতাও জারি করা হয়৷ রবি ও সোমবার এ নিয়ে জেলা প্রশাসন এবং দুর্যোগ মোকাবেলা দপ্তরের আধিকারিকরা কয়েক দফায় বৈঠকে বসেন৷ সব রকমের সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয় দিনভর৷ তবে সেভাবে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিভিন্ন অঞ্চলে বিপদের আশঙ্কা আছে এমন এলাকায় মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয় প্রশাসনের উদ্যোগে৷ এদিকে ঝড়ের দাপটে কালনা মহকুমায় ভাগীরথী নদীর জল উত্তাল হয়ে ওঠার পূর্বাভাস ছিল৷ তাই নদী পারাপারে দুর্ঘটনা এড়াতে রবিবার রাত ৭ টার পর কালনায় ভাগীরথীর ফেরি পারাপার বন্ধ করে দেয় প্রশাসন৷ সোমবারও সকাল থেকেই ফেরিঘাট বন্ধ ছিল৷ মহকুমা শাসক শুভম আগরওয়াল জানান সব রকমের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ তারই মধ্যে কালনা শহরে ১০ নং ওয়ার্ডের কিছুটা এলাকায় নদী বাঁধে ফাটল থাকায় ওই এলাকার মানুষজন রবিবার রাতভর দুশ্চিন্তায় কাটান৷ এরই মধ্যে অনেকের বাডি় ধসে গেছে৷ আতঙ্কে কয়েকটি পরিবার ঘর ছাড়ার কথা ভেবেছেন বলে জানা গেছে৷ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় রবি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত দুর্যোগ মোকাবেলায় ১২টি দল তৈরি আছে৷ তারা রবিবার থেকে কাজে নেমে পডে়ছে৷ এই দলে আছে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মীরা৷ এছাড়াও জেলার ২৩টি ব্লক ও ৬টি পৌরসভায় কন্ট্রোল রুম খোলা আছে৷ আছে কুইক রেসপন্স টিম৷ বিদু্যৎ দপ্তরের পক্ষ থেকে আগাম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়৷ এরই মধ্যে কালনা ও বর্ধমান শহরের নিচু এলাকাগুলিতে রবিবার রাত থেকেই জল জমে যায়৷ দুই শহরেই বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ বন্ধ ছিল সোমবার৷
ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে এবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়লেন রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমানের চাষিরা৷ যেভাবে কাঁচা আনাজ নষ্ট হয়েছে তাতে এখন মাথায় হাত চাষিদের৷ বর্ধমান শহর ছাডি়য়ে দামোদর নদ লাগোয়া গ্রামগুলিতে ফি বছর ব্যাপক সবজি চাষ হয়৷ কালনার পূর্বস্থলী ও কাটোয়া – ১ নং ব্লকের বিভিন্ন গ্রামেও এই সময়ে সবজি চাষ বেশি হয়৷ রবিবার রাতের কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ায় সবজির জমিতে সবই নষ্ট হয়ে গেছে৷ হিজলনা এলাকার এক চাষি ফজলে রাব্বে ফারুকী বলেন ‘রেমাল’ এর জন্য ঢঁ্যাড়স, পটল, ঝিঙে, উচ্ছে সবই প্রায় নষ্ট হয়েছে৷ ঝডে় পটলের জমিতে মাচা ভেঙ্গে পডে়ছে৷ ফলে নতুন করে আর ফলনের সম্ভাবনা নেই৷ বিভিন্ন ফসলের গোড়া পচে যাবে বলে আশঙ্কা ওই চাষিদের৷ জানা গেছে, দামোদর নদের পাড় বরাবর বিঘের পর বিঘে জমিতে এই সময়ে যে সবজি চাষ হয় বেশির ভাগ ক্ষতির মুখে৷ সবচেয়ে বিপদের মুখে তিল চাষিরা৷ ধারদেনা করে অনেকেই চাষে নেমেছিলেন৷ তারা এখন ধারদেনা কিভাবে শোধ করবেন তা নিয়ে আশঙ্কা৷ শুধুমাত্র দক্ষিণ দামোদর এলাকাই নয় কালনা, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, পূর্বস্থলী, মেমারি, জামালপুর সব এলাকায় ক্ষতির মুখে পডে়ছেন চাষিরা৷
জামালপুরে তিল চাষিরা এই দুর্যোগে চরম ক্ষতির মুখে পডে়ছেন৷ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ মেহেমুদ খান বলেন এখানকার জমিতে তিল গাছ প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে৷ একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি এলাকায় এখনও বোরো ধান মাঠে ছিল৷ সেই সব জমিতে ধান নষ্ট হবে৷ তিনি জানান এখানে যে সব এলাকায় দেরিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছিল সেই সব জমিতে এখনও ফসল রয়েছে৷ ধান কেটে ফেলার পরও জমি থেকে তোলা সম্ভব হয়নি৷ সেই ধান বৃষ্টির জলে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে৷ একই ক্ষতির কথা বলেন পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ভূতনাথ মালিক৷ তিনি বলেন আমরা যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় তৈরি ছিলাম৷ বলেন যেভাবে তিল অনান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে তাতে চাষিরা দিশেহারাই বলতে হবে৷ রায়ান গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক বিশ্বেশ্বর চৌধুরী জানান যেভাবে এই এলাকায় সবজির ক্ষতি হয়েছে তাতে ছোট বড়ো সব চাষিই সমস্যার মুখোমুখি হলেন৷ এদিকে রেমালের আগাম সতর্কতা জারি হওয়ার ফলে পূর্বস্থলীতে চাষিরা কাঁচা অবস্থায় আম তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ ফলে সেখানেও ক্ষতি৷ যেটুকু আম গাছে ছিল সেটা ঝডে়র তান্ডবে ঝরে গেছে৷ একই সঙ্গে ওই এলাকার ফুল চাষিরা দিশেহারা৷ কারণ বিঘের পর বিঘে ফুল জলে নষ্ট হয়ে গেছে৷ বর্ধমানের শহর লাগোয়া দক্ষিণ দামোদর এলাকায় ফুল চাষের জমিতে ফুল গাছ মাটিতে পডে় গেছে৷ জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মেহেবুব মন্ডল চাষিদের বার্তা দেন দুর্যোগ কমলেই জমির জমা জল দ্রুত বের করার ব্যবস্থা করতে হবে৷