মণিপুরে হিংসা রুখতে নিরাপত্তাবাহিনীকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে ‘দ্বিধামুক্ত’ ভাবে কাজ করার নির্দেশ দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সরকারি কার্যালয়, নেতাদের বাসভবন, ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কঠোর করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গত এক সপ্তাহ ধরে ফের জাতিদাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার রাজ্যের কুকি সংগঠনগুলি চূড়াচাঁদপুর জেলায় এক প্রতীকী ‘কফিন মিছিলের’ ডাক দেয়। জঙ্গি তকমা দিয়ে সিআরপিএফ বাহিনীর ১০ জন কুকি-জো যুবককে খুনের প্রতিবাদে এই মিছিলের ডাক দেয় কুকি ছাত্র সংগঠনগুলি। দশম শ্রেণির উপরে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কালো জামা পরে মিছিলে অংশ নিতে বলে জোমি স্টুডেন্টস ফেডারেশন, কুকি স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন এবং হমার স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর মতো সংগঠনগুলি।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ মণিপুরের মেইতেই নাগরিক সমাজ। একটি বৈঠকে তারা একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকার কঠোর পদক্ষেপ না করলে তারা চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেবে বলে হুমকি দিয়েছে।
এদিকে মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার রাতে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং। এনডিএ জোটের ৩৮ জন বিধায়কের মধ্যে ২৭ জন সেই বৈঠক করেন। কিন্তু ১১ জন সেই বৈঠকে যোগ দেননি। গরহাজিরার কোনও কারণও জানাননি। বৈঠকের পর কেন্দ্রের কাছে একাধিক দাবি জানান বিধায়করা। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় একাধিক মহিলা খুনের ঘটনায় এনআইএ তদন্তের দাবি জানান তাঁরা। জিরিবাম জেলায় মেইতেই খুনের ঘটনায় কুকি জঙ্গিদের বেআইনি বা নিষিদ্ধ করার দাবিও তোলা হয়। আগামী ৭ দিনের মধ্যে তাঁদের এই দাবি পূরণ না হলে রাজ্যবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে এনডিএ বিধায়করা সিদ্ধান্ত নেন। বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর জবাবে মেইতেই সম্প্রদায়ের মণিপুর সংহতি সংগঠনের মুখপাত্র বলেন, রাজ্যের মানুষ সরকারের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট নয়। এটা শুধু জিরিবাম জেলার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গতবছর মে মাস থেকে হামলা চালাচ্ছে জঙ্গিরা। মণিপুর শান্তি চুক্তির সময় যে যে গোষ্ঠীর সঙ্গে অস্ত্র সংবরণের কথা হয়েছিল, তাদের সকলের সঙ্গে কথা বলা উচিত সরকারের। এই সরকারের স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় মণিপুরের মানুষ।
শনিবার বরাক নদী থেকে উদ্ধার হয় উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ৩ জনের দেহ। তারপরই আছড়ে পড়ে জনরোষ। হামলা শুরু হয় রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী ও বিধায়কের বাড়িতে।মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের বাড়িতেও হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা।এরপরই রাজ্যজুড়ে লাগু করা হয় কার্ফু। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। বন্ধ হয়ে যায় বাজার, দোকান। গত সোমবারও জিরিবামে অসম সীমানা লাগোয়া অঞ্চল থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ৬ জনকে। অভিযোগের তির ছিল কুকি গোষ্ঠীর দিকে। নদীতে দেহ মেলার পর থেকেই দিকে দিকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে মেইতেই গোষ্ঠী। রবিবারও জিরিবাম জেলার জিরি নদীতে দেহ ভাসতে দেখা যায়। তার মধ্যে ছিল এক ষাটোর্ধ্ব মহিলার এবং বছর দুয়েকের এক শিশুর দেহ। শিশুটির দেহ ছিল মুণ্ডহীন। রবিবারই মেইতেই গোষ্ঠী মণিপুর সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি অভিযুক্তদের ধরা না হয়, বিক্ষোভ আরও জোরালো হবে।
এদিকে নদী থেকে উদ্ধার হওয়া পাঁচ দেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে । রবিবার জিরিবামেরই জিরি নদী থেকে যে বৃদ্ধার দেহ উদ্ধার হয় তিনিই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ষষ্ঠজন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এখনও তাঁর লাশ শনাক্ত হয়নি।
জিরিবাম জেলায় রবিবার পর্যন্ত মোট ছ’টি দেহ উদ্ধার হয়। মেইতেইদের ধারণা, ওই ছ’টি দেহ জিরিবাম থেকে অপহৃত তিন মহিলা এবং তিন শিশুর। অন্যদিকে একটি অংশের দাবি, নদীতে আরও কিছু দেহ ভেসে আসতে দেখা যায়। অর্থাৎ নিহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ইম্ফলের বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে রাজ্য বিজেপির সদর দপ্তর ও রাজভবন এলাকায় একনাগাড়ে টহলদারি চলছে।