অরুণাভ সেন
১৯৪৬ সালের প্রথম দিকের ঘটনা পাটনার জহর রায় নিজের ভাগ্য পরীক্ষা দিতে চলে আসলেন কলকাতায় উঠছেন মামার শ্বশুড়বাড়িতে মাখন সেন, জহর রায়ের মামা খুব ভাল টেলারিং মাস্টার, পাটনায় নিজের দরজির দোকান ব্যাচেলার মানুষ, নিউ মার্কেটের অর্ডার সাপ্লাই দিতে হিমসিম খেয়ে যান কিন্তু ব্যাচেলার মামার আবার কিভাবে শ্বশুরবাড়ি হয়! আশ্চর্যের বিষয়! রহস্য উন্মোচন করলেন জহর স্বয়ং ‘মামা আমাদের অবাক করে এক মামিকে ঘরে এনেছেন এনেই পাটনার দোকানপাট বিক্রি করে বৌয়ের হাত ধরে শ্বশুড়ের বাড়িতে উঠে এসেছেন কারণ শ্বশুর মৃত এবং তাঁর বাড়ি বিষয়সম্পত্তি এবং শাশুড়িকে দেখাশোনা করার জন্য কলকাতায় স্থায়ীভাবে না এলে শাশুড়ি বিপদে পড়বেন কারণ মামিই তাঁর একমাত্র সন্তান তাই মামা এখানেই শ্বশুরবাড়ির নিচের তলায় টেলারিং এর দোকান খুলে বসেছেন দিব্যি চলছে’
অপরজন সাহিত্যিক অভিনেতা বসুশ্রী থেকে সদ্য দেখে ফিরেছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী ‘ অদ্ভুত ভাল লেগেছিল উচ্ছ্বসিত হয়ে বাড়িতে অনুজ সাংবাদিককে জরুরী তলব বললেন এমন মরা ব্যাঙ, জলের ওপর পোকা-মাকড়ের খেলা, কাশবন, অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়া রেলের লাইন সবকিছু যেন জীবন্ত তার চেয়েও জীবন্ত ছবির মানুষগুলো এতকাল সিনেমার পর্দায় সাজা-মানুষ দেখে এসেছি, নিজেও যা করেছি সব সাজা- মানুষ এই ‘পথের-পাঁচালী’ ছবিটা দেখিয়ে দিল আমরা কত ব্যাক ডেটেড একই মানুষ ‘দেশ’ পত্রিকায় যখন লিখেছেন ‘যখন পুলিশ ছিলাম ‘ পাঠকদের প্রশংসা পেয়েছেন মুক্তকণ্ঠে মজার বিষয় তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র অনেকে আড়ালে-আবডালে বলেছেন ওটা ধীরাজ ভট্টাচার্যের লেখা নয় প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর বন্ধু, নিশ্চয়ই তিনি লিখে দিয়েছেন পেমেন মিত্তিরের কানে একথা পৌঁছতে হাসতে হাসতে বলেছিলেন তিনি কুঁড়ের বাদশা তাঁর থেকে লেখা আদায় করতে লোকেদের কালঘাম ছুটে যায়, তিনি কিনা ধীরাজকে অতবড় লেখা লিখে দেবেন! প্রেমেন্দ্র মিত্রের অভিমত লোকে সমালোচনা করে, ওরকম মানুষ চিরকাল থাকে ধীরাজ ভট্টাচার্য ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এর পরে লিখেছেন ‘যখন নায়ক ছিলাম ‘
পাটনার কদমকুঁয়া ড্রামাটিক ক্লাবের সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় নাট্য পরিচালক সতু রায়ের ছেলে জহর
তাঁর ভাল লাগে ক্যারিকেচার পাটনায় তখন জহর রায়ের ক্যারিকেচার বিশেষ আকর্ষণ নব প্রতিষ্ঠিত পাটনা আর্ট স্কুলের নাচ ও জহরের ক্যারিকেচার ভীষণ জনপ্রিয় হয় আরা থেকে বখতিয়ার পুর দানাপুর থেকে ভাগলপুর জহর তখন ‘গানেওয়ালা লাল্টু ছাড়াও জগদ্বিখ্যাত চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবিতে হিটলারের ভূমিকার ক্যারিকেচার এভাবেই জহরের দিনগুলো ভালই কেটেছে একদিন সাগর দত্ত লেনে এসে দেখা করলেন সাহিত্যিক, চিত্র নাট্যকার নবেন্দু ঘোষের সাথে নবেন্দু বাবু জিজ্ঞেস করলেন কবে এলে?
জহর বললেন ‘ভাগ্য পরীক্ষা করতে কলকাতায় এসেছি’
ভাগ্যপরীক্ষা! তার মানে?
জহর খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন ‘কলকাতায় ভাঁড়ামি করে রোজগার করা যায় কি না সেই খোঁজে’
তখন নবেন্দু ঘোষ তাঁকে বললেন, ‘তাঁর বাবা সতুদা কি সম্মতি দিয়েছেন’?
জহর হেসে বলল ‘না দিয়ে উপায় কি? আই এ ফেল করার পর (যদিও বেশিরভাগ লেখক লিখেছেন পাটনার বি এন কলেজ থেকে আই. এ পাশ শুরু করেছিলেন স্নাতক স্তরের পড়াশোনাও কিন্তু শেষ করেননি কিছুটা অভিনয়ের নেশায়) বাবা বুঝলেন যে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণের উত্তরাধিকারী হওয়ার চেষ্টা করাই আমার পক্ষে একমাত্র পথ, তাই সম্মতি দিয়েছেন এখন কলকাতাতেই ক্যারিকেচার দেখানোর চেষ্টা করব’
পরবর্তী কালে জহর বাংলা চলচ্চিত্রের কমেডিতে বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন সেই ইতিহাস সবার জানা পর্দায় তাঁকে দেখলেই এখনও হেসে ফেলে দর্শক
জহর রায় গর্ব করে বলতেন তাঁর অভিনয় গুরু চার্লি চ্যাপলিন, তিনি একলব্য৷ সত্যজিৎ প্রথমে ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোট্ট রোল দিয়েছিলেন, পরেশ দত্তের চাকর ভজহরি দশ বছর পরে হাল্লার মন্ত্রী ঋত্বিক ঘটকও তাই প্রথমে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে কনস্টেবলের এক চিলতে রোল সাত বছর বাদে ‘সুবর্ণ-রেখা’র অনেকখানি জুড়ে ফাউন্ড্রি ওয়র্কশপের ফোরম্যান মুখুজ্জে তিনশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন
১৯৭৭-র ১১ অগস্ট, মেডিকেল কলেজ থেকে একটা শোকমিছিল এগোচ্ছিল বিধান সরণি ধরে বেথুন কলেজের সামনে এসে থেমে গেল মিছিলটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ি থেকে নামলেন সুচিত্রা সেন ধীর পায়ে লরিতে উঠলেন সেখানে তখন নিথর শুয়ে জহর রায় সুচিত্রা কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্রিয় সতীর্থের দিকে অস্ফুটে বললেন, ‘’তুমি চলে গেলে চার্লি!’’
অন্যদিকে অভিনেতা ধীরাজ সিনেমার পর্দায় খলনায়ক হয়েছেন আবার প্রেমিকের চরিত্রে দিব্যি অভিনয় করেছেন জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন যশোরের পাঁজিয়া গ্ৰামে সুদর্শন চেহারা, একমাথা ঘন কোঁকড়ানো চুল, চাওনিতে মাদকতা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ম্যাডান কোম্পানির নির্বাক ছবি ‘সতীলক্ষ্মী’তে সুযোগ পেলেন পিতৃদেব শিক্ষক মানুষ ছেলের অভিনয় মোটেও ভালচোখে নিলেন না ধীরাজকে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিতে হল প্রথম পোস্টিং চট্টগ্রাম তবে বেশিদিন পুলিশের চাকরি করতে পারলেন না অন্য চাকরি খুঁজছেন, মনের মত কাজ না পেয়ে আবার সিনেমার জগৎকে বেছে নিতে হয় নির্বাক ছবির পরে সবাক যুগে ধীরাজের প্রথম ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ পরে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন কিন্তু একঘেয়ে চরিত্রে অভিনয় করে নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন
ওই সময় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘শহর থেকে দূরে’, ‘মানে না মানা’ ছবিতে রোমান্টিক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছবি ‘নতুন খবর’ এ ধীরাজ ভট্টাচার্য যশুরে ভাষার সংলাপে কামাল করেছেন এরপর ‘কালো ছায়া’ ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় ক্রমেই মরণের পরে, হানাবাড়ি, ডাকিনীর চর, রাত একটা, ধূমকেতু, এসব ছিল তাঁর অভিনীত ছবি ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকে হাজারি ঠাকুরের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন মানুষটি একবার দুঃখ করে বলেছিলেন তারা যখন অভিনয় করেছেন তখন সিনেমা, অভিনেতা এসব মানুষ খুব ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখত না অভিনয় করেন বলে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না, পাড়ায় ঢুকলে অন্য বাড়ির জানালা বন্ধ হয়ে যেত কি অদ্ভুত না!