অমলতাসের সন্ধানে

পার্থময় চট্টোপাধ্যায়

কতকাল ধরে আমি পথ চলছি৷ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর থেকেই আমার এই পথচলা৷ কখনো পাহাড়ে চড়েছি, কখনো জঙ্গলে হেঁটেছি, কখনো সমুদ্রে দুলেছি, কখনো নদনদীতে ভেসেছি আবার কখনো গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছি৷ যেখানেই গেছি সেখানেই একটা করে গাছ লাগিয়েছি৷ আমি ছুটেছি পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, শালবনির পথে পলাশের দর্শনে৷ মেতেছি ডোরান্দার জঙ্গলে মহুয়ার গন্ধে৷ এতদিন জানতাম না আমলতাসেরও যে একটা আকর্ষণ আছে ৷

ফাগুনের শেষে চলে এলাম লাল মাটির দেশে দেখলাম গ্রীষ্মের প্রবেশ ও যাতনা৷ প্রকৃতির কাছে চারটি আবদার নিয়ে এসেছিলাম ৷ প্রথম আবদার কুর্চি ফুলের গন্ধ নিতে, দ্বিতীয় আবদার মহুয়া ফলের ফলন দেখতে, তৃতীয় আবদার কালবৈশাখীর রূপ দেখতে আর চতুর্থ ও শেষ আবদার আমলতাসের গড়ন দেখতে৷ হাওড়া থেকে সকাল ১০.০৫ এর শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চেপে আমরা চারজন চলে আসলাম বোলপুরে৷ বোলপুর আসি সাধারণত গাড়িতেই তবে এবার ব্রাম্হনীর আবদারে ট্রেনে আসতে হলো৷ বোলপুরের ট্রেনে বিনে পয়সায় বাউল গান শোনা যায়, বহুরূপী দেখা যায় আর মুহুর্মুহু মশলা মুড়ি, চা, কফি বিক্রেতাদের আনাগোনা… এটা ওনাকে বেশ আনন্দ দেয়৷


এই সব খুশি গুলো পেতে আমরা চারজন বোলপুর রওনা দিলাম ট্রেনেই৷ দুপুর ১২.৩০ তে শান্তিনিকেতন বোলপুর স্টেশনে নামলাম৷ টোটো স্ট্যান্ড পৌঁছালাম৷ গরম বেশ ভালোই, তবে ছায়াতে বেশ শান্তি লাগে৷ টোটো ধরে সোজা চলে এলাম পিয়ারসন পল্লীর অতি সাধারণ অথচ অতন্ত্য সুস্বাদু ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার দোকান, ঘোষদার বা হারুদার হোটেল৷ বাঙালি ঘরের পরিচিত খাবার অর্থাৎ ভাত ডাল, আলু ভাজা, শাক ভাজা, লাউ চিংড়ি, দেশি মাছের ঝোল আমের চাটনি আর হারুদার বিখ্যাত টক ও মিষ্টি দই৷ ১৯৭৪ সালে এই দোকান চালু হয় তার আগে থেকেই ঘোষদার দই বোলপুরে খুব জনপ্রিয় ছিল৷ খাবার প্লেট ১০০ থেকে ১২০ তবে পেট চুক্তি ৷ এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা থাকার হোটেলে উঠলাম৷ দুপুরের ঘুম ভাঙলো মেঘেদের চিৎকারে৷ ঘরের বাইরে বেরোতেই মনটা নেচে উঠলো বোলপুরের এই রূপ দেখে৷ কালো মেঘে ঢেকে গেছে বোলপুরের তপ্ত আকাশ, বিদু্যতের রশ্মি যেন মহাদেবের জটার মতো আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসছে৷ কুর্চি ফুলের মিষ্টি গন্ধ চারিদিক (ভরে) গেছে৷ কৃষ্ণচূড়া, জারুল, খিরিস আর রাধাচূড়া গাছেরা ঝড়ের তান্ডবে, যেন ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে৷ মন খারাপ লাগছিলো যখন দেখলাম রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়ার আর অমলতাস ফুলের মৃতদেহ গুলো বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে৷ আমি এই আমলতাসের টানে এবারের বোলপুর এসেছি৷

কবি গুরু রবিঠাকুর এই হলুদ আভায় মাখা ফুলটির নাম দিয়েছিলেন অমলতাস৷

যার আসল নাম সোনালু ফুল  বা বানরলাঠি গাছ৷ সোনার মতো হলুদ এর ফুল৷ গরমের সময় এই ফুল ফোটে৷ শীতের সময় গাছ গুলো একদম ন্যাড়া হয়ে যায়, বসন্তে কচি পাতা আসে সাথে ফুলের কলি৷ গ্রীষ্মে গাছের শাখা-প্রশাখা জুডে় ঝুলন্ত মঞ্জুরিতে সোনালী হলুদ রঙের ফুল ফোটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে গ্রীষ্ম কাল পুরো সময় জুডে়৷
এই গাছ সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু হয়ে থাকে৷ ফুল থেকে গাছে ফল হয়, ফলের আকার দেখতে গোল লাঠির মতো, ফল লম্বায় প্রায় এক ফুট, প্রথমে সবুজ ও পাকলে খয়েরি রঙ ধারণ করে৷ এর ফল বিদেশে ইকবানার কাজে রপ্তানি হয়৷ এই গাছের ডাল, পাতা, ছাল ও ফলের শাঁস ভেষজ হিসেবে ব্যবহূত হয় ৷
আমার বিষয় এই হলুদ থোকা থোকা ফুলের বাহার নিয়ে লেখার৷ কিছু ফুল আমার ভীষণ প্রিয়, এদের দেখে পাগল হয়ে যাই৷ পলাশ, কৃষ্ণচূড়া জারুল, অমলতাস আর রডোড্রেনডন এই ফুলেরদের গন্ধ নেই, যদি এদের গন্ধ থাকতো তবে প্রকৃতি প্রেমী মানুষ গুলো আর ঘরে ফিরত না৷
বৃষ্টি সবে থেমেছে, লাল বাঁধের পাড় ধরে হাঁটছি, নাকে ভেজা মাটির একটা মিষ্টি গন্ধ৷ হাঁটছি, কখনো কৃষ্ণচূড়ার লাল রং গায়ের মাখছি, কখনো জারুলের নীল আভায় শরীরে ভিতর দোলা দিচ্ছে৷ কখনো সারি সারি আমলতাসের হালকা হলুদ রঙে যেন গায়ে হলুদ হচ্ছে৷ আমলতাসের রঙটা ভীষণ শীতল এক অনুভূতি, উষ্ণতায় আমলতাসের নরম হলুদ রঙের ছোঁয়াতে এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করছি৷ জীবনে প্রথম আমলতাসের (অম্লমধু) রূপের স্বাদ পাচ্ছি৷ ফুল গুলো সব আরও বেশি বেশি ঝুলে পড়ছে শুধু আমায় স্পর্শ করবার জন্য৷ প্রকৃতির কাছে এসে প্রকৃতিকে হূদয় দিয়ে অনুভব করতে হয় তবেই একটা আলাদা অনুভূতি শরীরের আসে৷
একদল মানুষ এই প্রকৃতিকেই হত্যা করে চলেছে৷ জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষজনের জঙ্গলের প্রতি অধিকার ও ভালোবাসা দুটোই আছে৷ ইদানিং দেখা যাচ্ছে কিছু শয়তান মানুষ জঙ্গল সাফ করছে৷ সারা বাংলা জুড়ে এই প্রকৃতির প্রতি অত্যাচার চলছে৷ উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, সুন্দরবন এলাকা জুড়ে এই চুরি আবাদে চলছে৷ মুখ্যমন্ত্রী একজন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ তাই তার উচিত অবিলম্বে এই প্রকৃতির সম্পদ চুরি বন্ধ করে প্রকৃতি ধ্বংস বন্ধ করুন আর সাথে সাথে এই বৃক্ষ চোর গুলোকে কঠিন শাস্তি দিন৷ রাজনৈতিক মদত ছাড়া এই এত বড়ো দুর্নীতি রাজ্য জুড়ে হতে পারেনা৷ কয়লা চুরি, বালি চুরি, পাথর চুরি এবার আসবে গাছ চুরির গল্প৷ বন্ধ হোক, এটা নিজের ও পরবর্তী প্রজন্মের সর্বনাশ ডেকে আনা হচ্ছে৷
যাবেন কিভাবে সেটা আগেই বলেছি তবুও শেষে বলি যে শান্তিনিকেতন যাবার সব থেকে ভালো গাড়ি সকল ১০.০৫ এর হাওড়া থেকে শান্তিনিকতান এক্সপ্রেস৷
এ ছাড়াও অজশ্র ট্রেন আছে প্রতি দুঘন্টা অন্তর৷
সস্তায় সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জায়গা শ্যামবাটির বীরভূম গেস্ট হাউস, ১০০০ টাকায় অ্যাটাচ বাথ সহ ২/৩ জন থাকতে পারেন আর এ সি ঘর ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায়, এ ছাড়া শান্তিনিকেতন ও বোলপুরে ১০০ এর উপর হোটেল আছে ভাড়া ৭০০ থেকে শুরু করে ২০০০ টাকার মধ্যে পাবেন৷