গতকাল বাড়ির সকলে গেছে দুদিনের জন্য কাছে পিঠে একটা জঙ্গলে, যেখানে আমি সদ্য ঘুরে এসেছি। তাই আমিও নির্ঝঞ্জাটে সকাল ৬ টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনে ১৬৪ কিলোমিটার পেরিয়ে সকাল সাড়ে দশটায় ঢুকলাম আমার ভালোবাসার শহর বোলপুরে। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে চলে এলাম সোনাঝুরির কাছে। শনিবারের এই হাটে দলে বহুবার এসেছি, তবে আজ এসেছি একা।
লোকে বলে সোনাঝুরির হাট। যারা বলে তারা ভুল বলে না। যদিও আমি ইদানীং ডাকি আকাশমণি হাট নামে। সোনাঝুরি নামটাতে কেমন একটা মাদকতা আছে আর আকাশমণি নাম আমার কাছে একটা স্নিগ্ধতা একটা সরলতায় ভরা। কেউ কি সোনাঝুরি ফুল দেখেছেন? ঠিক যেন ফুলঝুরির মতো দেখতে।
একটা আশঙ্কা কাজ করে এখন এই সোনাঝুরিকে ঘিরে। যে-ভাবে এই বনরাজি ধ্বংস শুরু হয়েছে, তাতে মনে হয় না এই জঙ্গল আর বেশিদিন থাকবে। সেদিনের সেই সরল আকাশমণি হাট, আজ বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে। শুধুই বেচাকেনা চলছে- যেখানে শিল্প নেই, সংস্কৃতিরও মৃত্যু হয়েছে কিছু চটকদারি আধুনিক বাউল গানে। সত্যি সোনাঝুরি পাল্টে গেছে। সময় হয়তো এই পরিবর্তনটাই চেয়েছিল। তাই নগরায়নের ফলে সবই পরিবর্তশীল।
সোনাঝুরির হাটে বর্তমানে পর্যটকদের সুবিধার জন্য চালু হচ্ছে ক্যারাভ্যান পরিষেবা। মূলত মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। বীরভূম জেলা পরিষদ, এই ক্যারাভ্যান পরিষেবা চালু করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোবাইল উয়োমেন ফেসেলিটি কর্নার’। এই ক্যারাভ্যান পর্যটকদের নানা সুবিধা দিচ্ছে। শৌচালয় থেকে পোশাক বদলের স্থান ছাড়াও, শিশুদের স্তন্যপান করানোর জায়গাও থাকবে এই ক্যারাভ্যানে। উন্নয়ন পুরোদমে চলছে।
মেলা জমে উঠেছে। গয়না, ব্যাগ, শাড়ি চাদর, ঘর সাজানোর জিনিস— কী নেই সেখানে! জমে উঠুক ক্ষতি নেই কিন্তু সোনাঝুরির প্রাকৃতিক রূপ যেন বহাল থাকে, এটুকুই চাওয়া। সোনাঝুরির আশ্রয় বড়ো শান্ত ও স্নিগ্ধ। সারাদিন কত ব্যস্ততা এর ছায়ায়, কত লোকের আনাগোনা। কত মানুষের শান্তির আশ্রয় এই সোনাঝুরি জঙ্গল। আমি এর রূপে অভিভূত হয়েছি কত অলস দুপুরে, পূর্ণিমার স্নিগ্ধ আলোতে। আবার মাঝে মাঝে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে জোনাকির ভিড়ে সোনাঝুরিকে।
তাই ঠিক করলাম সোনাঝুরিকে আরও একবার দেখে আসি। এখন যেন সোনাঝুরি গাছগুলোকে লুট করছে সবাই। আমি দুঃস্বপ্ন দেখি পুড়ে যাচ্ছে সোনাঝুরির জঙ্গল, আর মনে মনে প্রার্থনা করি এই দুঃস্বপ্ন যেন সত্যি না হয়।
হয়তো সভ্যতার কাছে একদিন হার মানবে প্রকৃতি। একদিন সত্যিই হারাতে হবে প্রিয় এই সোনাঝুরির জঙ্গলকে। তাই এবার যাওয়ার আগে ওকে চুপি চুপি বলে যাই, আমি আসব আবার তাড়াতাড়ি। এই বসন্তের শেষে। তখন আসব পলাশের টানে, মহুয়ার আকর্ষণে, অমলতাসের ছায়ায়। আর আসব আকাশমণির আশ্রয়ে।