তামিনাড়ুর রামেশ্বরম মন্দিরে গেলে পেরতে হয় আদম সেতু বা রাম সেতু। সে গল্প আমাদের সবারই জানা। কিন্তু আমাদের এই বঙ্গেও যে রামেশ্বর মন্দিরে যেতে এই রকম সেতু পেরতে হবে, জানা ছিল না। সুবর্ণরেখার বুক চিরে চলে গেছে সাঁকো। রীতিমত রোমাঞ্চকর এই যাত্রা। স্বর্ণ নদীর এই রূপ আগে দেখিনি।
না আমি খুব ধার্মিক নই, প্রকৃতির টানেই যাই এদিক সেদিক। শীত ফুরোতেই তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম জঙ্গলমহলের উদ্দেশ্যে। খড়গপুর ছেড়ে এগিয়ে চলেছি। কালো কার্পেট বিছানো হাইওয়ের দু’ধারে শাল, মহুয়া, পিয়া শাল, পলাশ, আকাশমণি গাছের অরণ্যভূমি। বিদায়ী শীতের শীতল হাওয়ায় যেন দোলা লেগেছে গাছের ডালে ডালে, কৃষ্ণচূড়া ও পলাশের গায়ে। আগত বসন্তের আলোর চূর্ণীতে যেন নতুন সাজে সেজেছে জঙ্গলমহল। বন-মরালের দল ডানা মেলে ভেসে পড়েছে নীল আকাশের কোল ঘেঁষে।
এই ব্যস্ততার জীবনে, সময় বার করা খুবই দুষ্কর। তবুও তারই মধ্যে আজকের এই দ্বীপ্রহর বহুদিন দেখিনি। চারিদিকের ঝলমলে রৌদ্রের মধ্যেও কেমন স্নিগ্ধতা আর মায়া ছড়ানো। বাতাসে ভেসে আসছে পাহাড়ের নিমন্ত্রণ।
ঝাড়গ্রামের নিকটবর্তী লোধাশুলি মোড় থেকে হাইওয়ে ছেড়ে, বাঁদিকের রাস্তা রগড়া হয়ে ৩৭ কিমি পথ অতিক্রম করলেই পৌঁছে যাবেন রামেশ্বর মন্দিরে। হুম, পেরতে হবে ওই সেতু সুবর্ণরেখার উপর। সকালের সূর্যোদয় চাক্ষুষ করলে পৌঁছে দেবে এক অচিন পুরে। খড়গপুর থেকে জঙ্গলকন্যা সেতু পেরিয়ে কেশিয়ারি, নয়াগ্রাম হয়ে ৭০ কিমি পথ উজিয়ে যাওয়া যায়।
দেউলবাড়ে সুবর্ণরেখা নদীর তীর লাগোয়া ৫ একর জায়গা জুড়ে, রয়েছে মাকড়া পাথরে তৈরি প্রাচীন রামেশ্বর শিব মন্দির। মন্দির চত্বর থেকে নদী উপত্যকার অপরূপ শোভা দেখা যায়। মন্দিরের গর্ভগৃহে একসঙ্গে রয়েছে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ রামেশ্বর। উৎকল শৈলীর এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কেউ বলেন, এই মন্দিরটি ত্রেতাযুগের। বনবাসকালে সীতার শিবচতুর্দ্দশীর ব্রত উদযাপনের জন্য রামচন্দ্রের অনুরোধে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা মন্দিরটি তৈরি করেন। নয়াগ্রামের রাজা চন্দ্রকেতু কর্তৃক মন্দিরটি ১৬ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে নির্মিত বলে অনুমান করা হয়।
রামেশ্বর মন্দিরটির গঠন অনেকটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতো। এক সময় নয়াগ্রাম এলাকাটি ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ পরগনার অধীনে ছিল। পুরাতত্ত্ব গবেষকদের একাংশের মতে, একাদশ-দ্বাদশ শতকে ওড়িশার চোল গঙ্গদেব রাজাদের আমলে মন্দিরটি তৈরি হয়। এই মন্দিরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের প্রথম কিরণ মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে, চারপাশ আলোকিত করে তোলে। মন্দিরের পাশে থাকা ৫০০ বছরের পুরনো কাঁঠাল গাছটিও পূজিত হয়।এই মন্দিরের মুখ্যদেবতা হলেন শিব। শিবরাত্রিতে মেলা বসে এখানে।
এই সময়ে হাজার হাজার পূর্ন্যার্থী এখানে সম্মিলিত হয়ে শিবের আরাধনা করে। রামেশ্বর মন্দির থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণে সুবর্ণরেখা নদীর ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে অপরূপ সুন্দর এক জায়গা– তপোবন। এমনিতেই অপরূপ এই জঙ্গল। সবুজের ভিন্ন ভিন্ন রং দেখতে বর্ষায় আসতে পারেন। তার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটা সরু খাল। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানেই নাকি মহর্ষি বাল্মীকির তপোবন ছিল। এখানেই সীতাদেবী যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। জায়গাটায় রয়েছে বেশ কিছু উইয়ের ঢিবি। বাল্মীকির সমাধির পাশে সীতার আঁতুড়ঘরও আছে। এখানে বেশ কয়েকটা মাটির কুটির আছে। কয়েকজন সন্ন্যাসীও থাকেন। তাঁরা এক একটা কুটির দেখিয়ে, এক এক রকম ব্যাখ্যা দেন। একটি অখণ্ড ধুনি জ্বলছে। তাতে কাঠ দেওয়ার রীতি আছে।
তপোবনের আশপাশের গ্রামগুলোয় লোধারা থাকেন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তপোবনে পৌঁছোনোর অভিজ্ঞতা বেশ রোমাঞ্চকর। বাল্মীকির আশ্রম পর্যন্ত গাড়িতে যাওয়া যায়। তবে নিজস্ব বা ভাড়া গাড়িতে করে আসা ছাড়া এ পথে কোনও যানবাহন নেই। গাড়ির ব্যবস্থা না থাকলে হাঁটতে হবে। আমাদের বাড়তি পাওনা জঙ্গলের পাতা ঝরার মরশুমের রূপ, পলাশ, শিমুলের হাতছানি। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরলাম। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এলে দেখতে পাবেন গোপীবল্লবপুর-সহ এই অঞ্চলে পলাশের সমারোহ। সেই সময় হাতিবাড়ি ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের বনবাংলোতে থাকতে ভুলবেন না।