মিয়াও ও নোয়া ডিহিং

ফাইল চিত্র

মিয়াও আসার আগে আমি পূর্ব অরুণাচলের আরও অনেক পাহাড় জঙ্গল নদী জনপদ দেখতে দেখতে এসেছি। এ আমার একলা ভ্রমণের আনন্দ। কী অপূর্ব এই পূর্ব অরুণাচলের রোয়িং, আনিনি, তেজু, ওয়ালং, ডং ভ্যালি, কাহো ভিলেজ, পরশুরাম কুণ্ড। দিবাং নদী, লোহিত নদীর শোভা দেখে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। গত দশ দিন ধরে এই দুর্গম সব পাহাড় জঙ্গলের পথে পথে ঘুরে নামসাই চলে আসি।

নামসাইতে এক রাত ছিলাম। এখানেই প্রথম ডিহিং নদীর কথা শুনতে পাই। নামসাই বাজারে চাচির হোটেলে ডিনার করতে গিয়ে পরিষ্কার বাংলায় চাচি বললেন, ‘তুমি তো বাঙালি আছো। ডিহিং নদীর টাটকা ছোট মাছ দিয়ে ভাত খাও।’ চাচি বিহারের মানুষ। নামসাইতে অনেক বছর ধরে রয়েছেন। বাজারে পথের ধারে এই চাচির হোটেল সবাই চেনে। আর আছে বৌদির হোটেল। সেও খুব ভালো। চাচির হোটেলে ডিহিং নদীর টাটকা ছোট ছোট বাটা মাছের ঝোল ভাত, সে রাতে মনকে মাতিয়ে দিয়েছিল।

পরের দিন সকালে নামসাই থেকে প্রথমে নামচিক চলে আসি শেয়ার গাড়িতে। পথ বেশি নয়। দু’ঘন্টার সুন্দর সফর। নামচিক থেকে মিয়াও আসারও শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু আমি এই পথটুকু একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে চারপাশের সব কিছু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে এসেছি। গাড়ির ছোকরা ড্রাইভার ছিল বেশ সমঝদার। ওর নাম পবন ছেত্রী। অসমে বাড়ি। কিন্তু নেপালি। বাংলা বলতে পারে। ওর মুখে মিয়াও-এর বহু গল্পকথা শোনার সুযোগ হয়ে গেল।


অসম সীমান্ত জাগুন থেকে মিয়াও মাত্র পঁচিশ কিমি পথ। আমি ফিরব সে পথ দিয়ে তিনসুকিয়া হয়ে ডিব্রুগড়। এখন আমি নামচিক থেকে মিয়াও চলেছি। প্রথমেই পেলাম মিয়াও-এর বড় এক জনপদ খারসাং। দূরে পাহাড়ের রেখা চোখে পড়ল। বিরাট পাহাড় নয় কিন্তু এ পাহাড় নাকি খুব দামী পাহাড়। এই পাহাড়ে কয়লা ও তেলের ভান্ডার আছে পবন বলল।

খারসাং এর পর রাস্তার দু’ধারে একাধিক স্কুল ও চার্চ চোখে পড়ল। এই পথটা খুব সুন্দর সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। চোখের আরাম হয়।
মিয়াও উপজাতি, জনজাতি ও শরণার্থী মানুষদের নিয়ে এক সুন্দর জনপদ। এখানকার উপজাতি-জনজাতিরা হলেন তাংসা, খামতি, সিম্ফু, লিসু। আর শরণার্থীরা হলেন চাকমা ও তিব্বতিরা। তাই মিয়াওতে আমি দুটো শরণার্থী শিবিরের অন্তর্গত সুন্দর সুন্দর গ্রাম দেখেছি।
মিয়াও পৌঁছে শহরের কাছাকাছি পেয়ে গেলাম সুন্দর এক পান্থনিবাস- দাফা ভ্যালি গেস্ট হাউস। এখানে তিনরাত ছিলাম। মিয়াওকে কেন্দ্র করে চারপাশের অনেক কিছু ঘুরে দেখেছি। নিজের মতো করে সময় কাটিয়েছি। এই শান্ত সুন্দর জনপদে দিন-রাত্রিগুলো বড় মনোরম লাগে।

মিয়াও-এর সেরা আকর্ষণ নোয়া ডিহিং। টুরিস্ট লজে পৌঁছে চটজলদি তৈরি হয়ে নিয়ে নদীর ধারে চলে গেলাম। নোয়া ডিহিং বড় শান্ত নদী। কুল কুল করে বয়ে চলেছে। এ নদীর উৎস দাফা বুম ( সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গ) থেকে। নদীকে কেন্দ্র করে চারপাশে সবুজ পাহাড় ও ছোট ছোট গ্রাম রয়েছে। চারপাশের পাহাড়গুলো বড় পাহাড় নয়। আকাশ ছুঁতে পারে না। এখানে নীলিমার নীল দূষণহীন, বড় স্নিগ্ধ। এই নদীর ধারে এসে মন সত্যিই প্রসন্ন হল। মানুষজন নেই বললেই চলে। উপজাতি কয়েকজন নদীর জলে মাছ ধরছে। নদী পেরিয়ে যাতায়াত করছে। জীবন এখানে বড় ধীর গতিতে বয়ে চলেছে।

মিয়াও শহরে একটা মিনি জু ও মিউজিয়াম রয়েছে। এখানকার উপজাতিদের বাজারটা ঘুরে দেখে বেশ ভালো লেগেছে।
মিয়াও থেকে নামদাফা সামান্য পথ। গেটওয়ে অফ নামদাফা বলা হয় মিয়াওকে। মাত্র দশ কিমি দূরেই অরুণাচলের জাতীয় অরণ্য। এই নামদাফার অরণ্যে রয়েছে M’PEN Chakma Village, তাদের স্কুল, মন্দির ও বৌদ্ধ গুম্ফা। ১৯৬৪ সাল থেকে চাকমারা এখানে রয়েছে।
অরুণাচলে প্রথম চাকমা গ্রামের নাম Patturu Turu। বেড়াতে বেড়াতে চলে গেলাম M’ PEN। ছোট ছোট বাড়ি ঘর নিয়ে চাকমা গ্রামগুলো কেমন নীরব নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। কোনও কোলাহল নেই। বড় শান্ত লেগেছে। তাদের বাড়ি-ঘর মূলত বাঁশ, খড় ও টিন দিয়ে বানানো। মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে ঘরগুলো। হাতির ভয় এখানে নেই। কিন্তু অন্য আরও অনেক বন্যপ্রাণীর ভয় রয়েছে। এখানকার সবাই কৃষিকাজ ও নোয়া ডিহিং নদীর মাছ ধরেই জীবনযাপন করে। নিজের চোখে এত কাছ থেকে চাকমাদের এই গ্রামগুলো ও ওদের সহজ জীবনযাপন দেখার অভিজ্ঞতা এক বড় প্রাপ্তি। গ্রাম ভ্রমণ শেষ করে চাকমাদের স্কুলেও চলে গিয়েছিলাম। সরকারী সহায়তাপ্রাপ্ত আপার প্রাইমারি স্কুল। ছাত্র ছাত্রী ১২৮ জন। শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন ৫ জন।

মিয়াও এর খুব কাছে আরও এক শরনার্থী গ্রাম হল Choephelling Tibetan Settlement TR Camp। তিব্বতি শরনার্থীদের এই গ্রামটি বেশ উন্নত। একদম নিজেদের পাকাপোক্ত বাসভূমির মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে তিব্বতিরা। চারপাশে উড়ছে রংবেরং ধর্মপতাকা (লুংদার)। বাড়ি ঘরগুলোও যথেষ্ট ভালো ও সুন্দর। এখানে স্কুল, খেলার মাঠ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অতিথি ভবন, মনাস্ট্রি, চোর্তেন রয়েছে।
মিয়াও থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি ভাড়া করে একবেলার একলা ভ্রমণে চলে গেলাম সুন্দর পাহাড়ি জনপদ- নামপং। এপথে পড়ল জয়রামপুর গ্রাম। রিমা নদী। ছোট ছোট অনেক চা বাগান আর দারুণ সুন্দর নিসর্গ। পথও খুব সুন্দর। নির্জনতা ও অরণ্যের শোভা এপথের বড় প্রাপ্তি। চলার পথে পেয়ে গেলাম ওয়ার্লড ওয়ার ২ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে এই মেমোরিয়াল। নামপং থেকে পাংসু পাস পর্যন্ত যেতে পারলাম। এরপর যেতে হলে বিশেষ অনুমোদন দরকার। কারণ মায়ানমার বর্ডার সামনেই।
নামপং থেকে ফেরার পথে খারসাং পেরিয়ে এসে ওল্ড চাম্পো ভিলেজের বড় গুম্ফার কাছে গাড়ি থামালাম। আজ এখানে আছে তাংসা উপজাতিদের বিশেষ উৎসব- Kathina Cibara Dana।

তাই গুম্ফাকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পুজো হয়েছে, প্রার্থনা হয়েছে। গ্রামের তাংসা সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের নিজস্ব পোষাকে সজ্জিত হয়ে এসেছে। চারপাশ রঙিন ও আনন্দমুখর দেখে ভালো লাগল। আমাকে আপ্যায়ন করে নিয়ে যাওয়া হল ওঁদের ধর্মগুরুর কাছে। সাদর সম্ভাষণ করে বসালেন ওঁরা। লিকার চা-বিস্কুট দিলেন সাজিয়ে। টুকিটাকি কিছু কথা বললাম ধর্মগুরুর সঙ্গে হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে।
আজই সফরের শেষদিন। আগামীকাল সকালে মিয়াওকে গুডবাই জানিয়ে ফিরে যাব পাটকাই, ডিগবয় হয়ে ডিব্রুগড়। মিয়াওতে তিনটে দিনের স্মৃতি বড় সুন্দর হয়ে থেকে যাবে আমার ভ্রমণ অ্যালবামে। তাই শেষবারের মতো বিকেলের নরম আলোয় আবার পৌঁছে গেলাম নোয়া ডিহিং-এর কাছে। নদীর জল ছলাৎ ছল এখানে হয় না। এ নদী বড় নিঝুম শান্ত। নদীর পাড়ে একটু বসলাম। চারপাশ নির্জন নিশ্চুপ। আজ নোয়া ডিহিং-এর জলে একটি ডিঙি নৌকোর দেখা পেলাম। এই বিরাট ছড়ানো নদীতটে ছোট্ট ডিঙি নৌকোটা আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছে।

নোয়া ডিহিং-এর স্বচ্ছ শীতল জলে নুড়ি পাথরগুলো জ্বলজ্বল করছে। সূর্য এবার ডুবু ডুবু। অরুণাচলে সন্ধে নামে অনেক আগেই। দিনশেষের বিষন্নতা প্রকৃতির মধ্যে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে। আমিও বিষন্ন মনে ভাবছি, এত সুন্দর আমার এই একলা ভ্রমণটা আজ শেষ হয়ে যাবে! কত স্মৃতি, কত অভিজ্ঞতা মুসাফিরের ঝুলিতে জমা হয়ে গেল। তবু যেন আমার ঝোলা ভারী হয় না। নতুন পথে যাত্রা শুরুর জন্য কেবল একটু সামান্য বিরতির প্রয়োজন হয়! আমি সেই বিরতির বিরামসুখে নোয়া ডিহিংকে দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি দিন শেষের রাঙা আলোয়! এটুকুই প্রাপ্তি।