মধুবন চক্রবর্ত্তী
বাঙালির ছুটি কাটানোর জন্য দি-পু-দা চর্চা বরাবরই। এই চিত্রটা অবশ্য এখন অনেকটা বদলেছে। তবুও দিপুদা (দিঘা-পুরী-দার্জিলিং) নির্ভরশীলতা কোনোদিনই কমবে না। সপ্তাহান্তে ছুটির মজা নিতে কাছে পিঠে দার্জিলিংয়ের মত স্নিগ্ধ পাহাড়ি সৌন্দর্য যে সুখ আপনাকে দেবে, তা ভরা গ্রীষ্মে কোথায় পাবেন? সদ্য মাধ্যমিক দিয়েছি। রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তিন মাস। এই তিন মাসের মধ্যে কোথাও তো বেড়াতে যেতেই হবে। যেহেতু বাবা বাইরে বাইরে কাজে ঘুরে বেড়াতেন। তাই বাড়িতে এসে ‘সুখের ঘুম’ ছেড়ে আবার বেরোনোর সেরকম ইচ্ছে থাকতো না তাঁর। আমার আবদারে আর মায়ের তাড়নায়, সে গ্রীষ্মের ছুটি হোক বা শীতের ছুটি, বেরিয়ে পড়তেন আমাদের নিয়ে। খুব বেশি প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে যে বেরোনো হতো সেরকমটা নয়। সেবার গিয়েছিলাম দার্জিলিং। তখন সদ্য মধ্যমিক দিয়েছি, রেজাল্ট বেরোতে প্রায় তিন মাস দেরি। হঠাৎ প্ল্যান করার জন্য দিপুদা-ই ঠিকঠাক সেটা আগেও বুঝেছি, পরেও…৷ শেষমেশ ঠিক হল, দার্জিলিং। ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়নি। অগত্যা রকেট বাসই সই। দূরপাল্লার বাসে চড়ে দার্জিলিঙ যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল একেবারে অন্যরকম। তাও আবার রাতের বাস। চেয়েছিলাম ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক। হয়ে গেল আরেকরকম। বাস যখন জোরে ছুটতে শুরু করল এক অজানা ভয় যেন গ্রাস করেছিল আমায়। মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে সারা রাত পড়েছিলুম। এত গতি আমার কোনোকালেই ভালো লাগে না।
তবু দার্জিলিং দেখার উত্তেজনায় সেই ভয়কে জয় করেছিলাম। অবশেষে সারারাত বাসজার্নির পর ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং। সেই ছেলেবেলার স্মৃতি আজও উঁকি দেয় অতীতের বারান্দা থেকে। দার্জিলিং আমার কাছে অন্যরকম একটা অনুভূতি। জীবনের প্রথম পরীক্ষার পর, প্রথম পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার মজাটাই আলাদা। আজ এত বছর পরে, প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতিটাই আরোও একবার উস্কে দিল আমাকে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে আজও মনে আছে পাহাড়গুলো যেন কথা বলছিল আমার সঙ্গে। আরও উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিলাম অমরা। নিচে থেকে যে পাহাড়টা দেখা যায়, সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে, আবার নতুন পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়। এক ‘চুড়া’ থেকে আর এক ‘চূড়া’র কাছে পৌঁছনো। কৈশোরের সেই ‘মুগ্ধতা’ আজও ভুলিনি আমি। কারণ কিছু মুগ্ধতা চিরকালীন। জীবনের বিভিন্ন স্তরে সে বিভিন্ন রূপে আসে। মেঘ কুয়াশার চাদরে মাখা পাহাড়ের বিভিন্ন স্তর কেটে কেটে অবশেষে পৌঁছোনো দার্জিলিং। এক মায়াবী শহর। পাহাড়ের গায়ে কুয়াশার চাদর সরলেই দেখা যায় জনবসতি। নিচে থেকে পাহাড়ের ওপরের বাড়িগুলো যেরকম ছোট দেখায়, আবার ওপর থেকেও নিচের বসতিকে খুবই ছোট দেখায়। ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুতভাবে মেঘের দল ঘিরে ধরেছিল আমাদের। তারপর কিছুক্ষণ বাদে মেঘগুলো সরে সরে যাচ্ছিল। আবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল… এভাবে আমরা ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। পাহাড়ি রাস্তার মোড়গুলো বেশ ভয়ঙ্কর। একেবারে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন। ঠিক পাশেই পাহাড়ের পাদদেশ। এভাবেই উচ্চতাকে একটু একটু করে ছুঁয়ে দেখেছি। দার্জিলিং ‘যেন জীবনের গল্প বলে’।
আজ এতগুলো বছর পরে যখন পিছনের দিকে তাকাই, মেঘ-কুয়াশা-রৌদ্র, আলো-ছায়া মাখা সেই পাহাড়, আমাকে চুম্বকের মত টানে। হ্যাঁ, এটা ঠিক, গরম এলেই ইচ্ছে করে আবার সেই চূড়ায় যাই। কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর দেখি, দুচোখ ভরে। অনেক সময় চাইলেই তো আর ম্যাজিকের মত সবটা হয় না। তখন সেই অতীতই ভরসা। দার্জিলিং ঘুরতে ঘুরতে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম সেই পাহাড়ি সুর। তখন আশির দশক।
সদ্য দেখেছিলাম সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি। বোঝা না বোঝার এক মাঝামাঝি স্তরে তখন বিচরণ করছিলাম। ছবিটি দেখতে দেখতে একটা সুর শুধু মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। দার্জিলিংয়ে পৌঁছেও সেই সুরটি আমাকে তাড়িত করেছিল। সেই ছবির সঙ্গে জুড়ে আছে এক পাহাড়ি বালক, যার কোনও কথা নেই। গোটা চরিত্রটাই যেন অনুভূতির রঙে মাখামাখি এক বক্তব্য হয়ে উঠেছে। সে নির্বাক অথচ সবাক। এই বৈপরীত্য ছবিটিকে এক অন্যমাত্রা দিয়েছে।
ছেলেটি আসলে আঞ্চলিকতার প্রতীক। কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে দার্জিলিং যেমন সমার্থক তেমনই এই ছেলেটিও। আমার ছেলেবেলার দেখা দার্জিলিঙ আর কাঞ্চনজঙ্ঘা ঠিক সেরকমভাবেই সমার্থক হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার আবহসংগীতের সব থেকে উল্লেখ্য, ঘুরে ঘুরে ফিরে আসা এক পাহাড়ি সুর। পাহাড়ি সুরের আবেশে কাঞ্চনজঙ্ঘায় এক রহস্যময়তা তৈরি হয়। বাস্তবেও তো তাই। একদিকে পাহাড়ের মুক্ত পরিবেশে নির্জনতা, অন্যদিকে নাগরিক সভ্যতার কুয়াশাচ্ছন্ন জীবন। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সেই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির নায়িকা একসময় বলেছিলেন, ‘আমার কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘ কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা আস্ত একটা ছবি।’ সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, মেঘ কুয়াশার চাদরে ঢাকা অপরূপা মায়াবী শৈলশহর ‘দার্জিলিং’ দেখার ইচ্ছেটাকে আরোও প্রবল করে দেয়। একটি বিকেলের গল্পকে নিয়ে তৈরি কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে ছোট্ট নেপালি সেই ছেলেটি একা হেঁটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তার ওপর দিয়ে। সেইসঙ্গে বেজে উঠেছে নেপালি সুর। এগিয়ে চলেছে জীবন। ধীরে ধীরে মেঘ কেটে যায়। ভেসে ওঠে কাচের মতো স্বচ্ছ, দুধের মতো সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। দার্জিলিং গেলে আজও সেই সুরটাই যেন কানে ভেসে ওঠে। এখানে এই সুর কেবলমাত্র একটি আঞ্চলিক সুর নয়। এই সুর, দেশ, স্থান, কাল, পাত্র, সীমা সীমানা সীমান্ত ছাড়িয়ে বৃহত্তর জীবনের কথা বলে। এই সুরটিই সিগনেচার টিউন। এই ছবি প্রকৃতপক্ষে দার্জিলিং তথা গোটা পাহাড়ের যাপনচিত্র আর তার গল্প। গোধূলি আলোয় দেখতে পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া এক স্বর্গীয় অনুভূতি। আমার দার্জিলিং ঘোরার সেই স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এ ত গেল ফ্ল্যাশ ব্যাকের কথা।
এবারে আসি দার্জিলিঙে গেলে কিভাবে ঘুরে বেড়াতে পারেন। সেখানে গেলে টয়ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন পাহাড়ি রাস্তা ধরে।
দার্জিলিং টয় ট্রেন
দার্জিলিং হিমালয়ের রেলওয়ে, এটি ডিএইচআর (DHR) বা খেলনা ট্রেন নামেও পরিচিত। দুই ফুট ন্যারো গেজ রেলপথ যা পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিঙের মধ্যে চলাচল করে। ১৮৭৯ সাল থেকে ১৮৮১ এর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল এটি দীর্ঘ প্রায় ৮৮ কিলোমিটার বা ৫৫ মাইল। এর উচ্চতার মাত্রা শিলিগুড়িতে ১১৪ মিটার অর্থাৎ ৩৭৪ ফুট এবং দার্জিলিঙে ২০৭৩ মিটার অর্থাৎ ৬,৮০১ ফুট।
টয়ট্রেনের কথা বলছি অথচ ঘুম স্টেশনের কথা বলবো না সেটা কি হতে পারে! টয়ট্রেন আর ঘুম ষ্টেশন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে একে অপরের সঙ্গে। দার্জিলিঙের অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে জড়িয়ে এই ঘুম স্টেশন। তাই বলছিলাম, দার্জিলিং যাবেন আর ঘুম যাবেন না, সেটা হতেই পারে না। ঘুম যেন এক স্বর্গরাজ্য। দার্জিলিং পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে ঘুম স্টেশন। যাকে ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন বলা হয়। উচ্চতায় ২ হাজার ২৫০ মিটার। রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে এক হাত তুললেই ছুঁতে পারবেন মেঘবালিকাদের। মেঘ যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। রবিঠাকুরের গানের কথায় বলতে হয় ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে৷’
১৮৮১ সাল থেকে এই স্টেশনে রেল চলাচল শুরু হয়। দার্জিলিং থেকে ঘুমের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। টয় ট্রেনে করে দার্জিলিং ভ্রমণ এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। বাতাসি লুপ থেকে ঘুম স্টেশনের দিকে যেতে যেতে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতাকে আরও নিবিড় করে তুলবে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দার্জিলিং হিমালয়ান রেলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করেছিল। আবার ২০০৫ সালে নীলগিরি পার্বত্য রেলকে এর সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসের তালিকাভুক্ত করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রেল, দার্জিলিং হিমালয়া রেল অধিগ্রহণ করে নেয়। এবং ১৯৫৮ সালে এই রেল উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের অংশে পরিণত হয়। আবার ১৯৬২ সালে শিলিগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার পথ নতুন ব্রডগেজ লাইনের মাধ্যমে যুক্ত হয়।
আবার ১৯৮৮ থেকে ৮৯ সালে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ফলে এই রেল প্রায় ১৮ মাস বন্ধ ছিল। টয় ট্রেনে চললে ঘুম স্টেশন আপনাকে আসতেই হবে দার্জিলিং যেতে মাঝখানে পড়বে বাতাসিয়া লুপ। জায়গাটির দূরত্ব ঘুম স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার দার্জিলিং থেকে ৫ কিলোমিটারের মতো ইংরেজিতে এই লুপ কথাটির অর্থ হলো বক্রাকার। কিংবা বৃত্তাকার কোন অঞ্চল।
চড়াই পথে টয় ট্রেনের এই সফর
মনোমুগ্ধকর সফর যা আপনার যাত্রাকে সাবলীল করে তোলে। আনন্দমুখর করে তোলে। এক স্বর্গীয় যাত্রাপালা যেতে পারে, টয়ট্রনের এই যাত্রাকে সাবলীল করার জন্য ১৯১৯ সালে বাতাসিয়া লুপ তৈরি হয়।
টয় ট্রেন বাতাসিয়া লুপে প্রায় ৩৬০° ঘুরে যায়। আতাই দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৃত্তাকার ভিউ সহজেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চোখে পড়ে তুষার ধবল হিমালয়। বাতাসিয়া লুপ থেকে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলে আপনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন। ইয়াবার ছিল দৃশ্য আপনার মনের মণিকোঠায় চিরকাল থেকে যাবে বাতাসিয়া লুপের কেন্দ্রে একটি যুদ্ধ স্মৃতি স্মারক আছে। আর সামনে রয়েছে ছোট্ট বাজার। এখানে আসলে আপনি যেতে পারেন ঘুম স্টেশন দার্জিলিং শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাজার এলাকা থেকে সড়কপথে যে কোনও যানবাহনে ঘুম স্টেশনে পৌঁছতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট মতো সময় লাগে যদিও নানান দিকের পথ এসেছে মিশে এই ঘুমে। ঘুমের পাশেই দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে মিউজিয়াম। সেইসঙ্গে সামনেই দেখা যাবে সামটেন চোলিং বৌদ্ধ মঠ। ইডা চলিন মঠে রয়েছে মৈত্রীয় বুদ্ধের অসাধারণ সুন্দর বিগ্রহ প্রাচীনযুক্ত প্রায় বেশ কিছু বৌদ্ধ পুথিও যত্ন সহকারে এখানে সংগৃহীত আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করা পুঁথিও সংগ্রহে রয়েছে। রয়েছে সিঞ্চল হ্রদ।
সূর্যোদয়ের বিবিধ দৃশ্য দেখার জন্য টাইগার হিল তো আছেই।
কোনও অলস বিকেলে মনের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন কোনও মনেস্ট্রি। হোটেলের ঘরে বসে দার্জিলিংয়ের চায়ে চুমুক দিতে দিতে অস্তমিত সূর্যের রূপ দেখতে দেখতে হয়তো লিখে ফেলতে পারেন কোনও গান। অথবা কোনও কবিতা। কবিতা না এলেও রবি ঠাকুরের এই গানটা তো গাইতেই পারেন
‘জীবনও মরণের সীমানা ছাড়ায়ে
বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে৷’….
শৈলশহর দার্জিলিং আপনাকে দেবে এক ঐশ্বরিক অনুভূতি। অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আপনি হারিয়ে যাবেন এক অচিন জগতে। আমার স্মৃতির শহর। ভ্রমণ গল্প মনের কোনায় জমে ছিল।
তাই এতদিন পরেও কাঞ্চনজঙ্ঘার অমোঘ টান আমাকে নিয়ে যায় সেখানে, যেখানে ছায়াছবি আর জীবনের ককটেল পান করি আমি। বাঙালির কাছে প্রথমেই যে ছবি ভেসে ওঠে তা হল, বিখ্যাত সেই চায়ের কথা। এই চায়ের খোঁজেই দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন দার্জিলিংয়ে। পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে ক্যামেলিয়ার কোমল কুঁড়ি দিয়ে উৎপাদিত হয় বিশ্ব বিখ্যাত চা। তবে শুধু কি চায়ের স্বাদ? সেই সঙ্গে এমন কিছু রকমারি জিনিস রয়েছে যা আপনি না দেখলে অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে এই ভ্রমণ। যেরকম ‘তিব্বতি মুখোশ’। খুবই জনপ্রিয়। রয়েছে নানা ধরনের হাতের তৈরি জিনিস। দার্জিলিংয়ের কাছেই রয়েছে তিব্বতি শরণার্থীদের শিবির যেখানে তিব্বতিদের হাতে তৈরি নানান রকম উপকরণ পাওয়া যায়। তিব্বতি ছবি, তিব্বতি মুখোশ, তিব্বতি গয়না আর সেই সঙ্গে উলের পোশাক, যা না কিনে আপনি দার্জিলিং থেকে ফিরতেই পারবেন না। উলের তৈরি টুপি, জ্যাকেট, কোট যা ম্যাল থেকে নিচের দিকে নামতে রাস্তা জুড়ে বসে থাকে। গরম পোশাকের মেলা বসে এই অঞ্চলে। মেডিটেশনের জন্য সিঙ্গিং বোল ব্যবহার করে থাকেন বৌদ্ধরা। বাটির মধ্যে থেকে একটি বিশেষ ধরনের মিউজিক্যাল বা সাংগীতিক আওয়াজ বেরোতে থাকে। সিঙ্গিং বোলের চাহিদা আছে। ঘুরতে ঘুরতে কিনে নিতে পারেন এই জিনিসটি।
আর আছে টাইগার হিল। টাইগার হিল থেকে সূর্যাস্ত দেখার এক অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা তো জানেন। আর যাঁরা আবারো দেখতে চান তাঁরা অবশ্যই আসতে পারেন। পর্যটকরা পাহাড়ের শীর্ষ থেকে মাউন্ট এভারেস্ট এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার চমৎকার দৃশ্য দেখতে পারেন। সেই সঙ্গে দার্জিলিংয়ের প্যাগোডা ও মনেস্ট্রিতো আছেই, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ঘুম মনেস্ট্রি। তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রাচীন এই মন্দিরের পনেরো ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট বৌদ্ধমূর্তি দেখার মত এবং এখান থেকে সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায়। রোপওয়ে থেকে পাহাড়ি ঝর্না, বন্য সৌন্দর্য দেখা যেন এক স্বর্গীয় সুখ।
চা বাগান থেকে ফেরার পথে তেনজিং রক পেরোলেই, দার্জিলিংয়ের কেবল কার। এক মাথা থেকে আর একমাথা যেতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগে রোপ ওয়েতে করে।
হিমালয়ের মাউন্টেন ইনস্টিটিউটের একটু সামনেই চা বাগানের আগেই পড়বে তেনজিং রক। তেনজিং রক হচ্ছে বিশাল পর্বতের ছোট সংস্করণ। একটি পর্বতের টুকরো যেন গোটা একটা পর্বত। এই বরফস্নাত পাহাড় অতি মনোরম। পাহাড়ের রানীকে দেখতে গেলে বর্ষাস্নাত পাহাড় দেখার এক আলাদা অনুভূতি যেমন আছে, হেমন্ত কাটিয়ে তীব্র শীতে পাহাড়ের কোণ থেকে আচমকা সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতিও বিরল। হেমন্তের শেষে যখন ধীরে ধীরে হিমেল হাওয়া প্রবেশ করে মনের অরণ্যে, প্রকৃতির গহন জঙ্গলে, তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার যেন আলাদা রূপ। শীতের ঘনপথে মেঘমুক্ত আকাশ দেখা নিশ্চয়ই বিরল অভিজ্ঞতা। তবু যদি কখনও দেখে ফেলেন সেই মেঘমুক্ত ভোর ! তাহলে মনে হতেই পারে সোনার হরিণ পেলাম কি?
দার্জিলিংয়ের ম্যাল বা হোটেলের ঘর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর দেখা মানে এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। আবার ফিরে এলাম শৈশবের কথায়। ছেলেবেলায় দেখা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সেই কাঞ্চনজঙ্ঘl আজও মনে করিয়ে দেয় এক পাহাড়ি সুর। গোধূলি আলোয় দেখতে পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া এক স্বর্গীয় অনুভূতি সেখানে গেলে টাইট্রেডি করে ঘুরে বেড়াতে পারেন পাহাড়ি রাস্তা ধরে। কোনও অলস বিকেলে মনের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন কোনও মনেস্ট্রি।
শৈল শহর দার্জিলিং আপনাকে দেবে এক ঐশ্বরিক অনুভূতি। অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আপনি হারিয়ে যাবেন এক অচিন জগতে।