প্রাক কথন
দুই পর্যায়ে অর্থাৎ ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে এবং ২০১৮-র অক্টোবরে, পঞ্চকেদার দর্শন সম্পূর্ণ করেছিলাম। তারপর থেকেই মনে একটা ইচ্ছে ছিল, সপ্তবদ্রি দর্শন করার। প্রায় ৬ বছর পরে সেই ইচ্ছে বাস্তব রূপ পায়। এই যাত্রায় আগ্রহী বন্ধুর সঙ্গে আলোচনার সময় সে প্রস্তাব দেয়, সপ্তবদ্রির সঙ্গেই পঞ্চপ্রয়াগ দর্শন করার। যেহেতু প্রয়াগগুলির অবস্থান বদ্রিক্ষেত্রের কাছাকাছি, আমি তখনই সম্মত হই তার প্রস্তাবে। ফলস্বরূপ ২০২৪ সালের মে মাসে আমি ও আমার যাত্রাসঙ্গী কর্নেল মোহন, যথাক্রমে কলকাতা ও পুনে থেকে যাত্রা শুরু করে, ঋষিকেশে এসে মিলিত হই। সেখানে এক রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা একসঙ্গে সপ্তবদ্রি ও পঞ্চপ্রয়াগ দর্শনের অভিপ্রায়ে প্রকৃত যাত্রা শুরু করি।
১৫ মে ২০২৪
কুম্ভ এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন থেকে দুপুর ১টায় ছেড়ে পরদিন হরিদ্বার এসে পৌঁছল বিকেল সাড়ে ৪টেয়। লাগেজ নিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই চলে এলাম বাস স্ট্যান্ডে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিকেশ যাবার বাস পেয়ে গেলাম। মিনিট ৪৫ পরে বাস এসে পৌঁছল ঋষিকেশ বাস স্ট্যান্ডে। এবার পিঠে ব্যাগ নিয়ে, ট্রলি হাতে পৌঁছে গেলাম বাস স্ট্যান্ডের উলটো দিকেই অবস্থিত একটি হোটেলে। মনে পড়ল, সেপ্টেম্বর ২০১৬-তে মদমহেশ্বর যাত্রাতেও এই হোটেলেই উঠেছিলাম। ‘চারধাম যাত্রা’-র কারণে প্রতিটা হোটেলেই স্থানাভাব। তবু, সৌভাগ্যবশত হোটেলে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর পেয়ে গেলাম দুজনের থাকার জন্য।
আধঘণ্টা পরেই মোহন দেরাদুন বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে চেপে ঋষিকেশ এসে পৌঁছল। ওকে নিয়ে সোজা চলে এলাম হোটেলের নির্দিষ্ট ঘরে। লাগেজ রেখেই আমরা চলে এলাম একটি চা-দোকানে। পরপর দু’কাপ চা খেয়ে ক্লান্তি দূর করতে পারলাম অনেকটাই। তারপর চারধাম যাত্রার ‘আবশ্যিক রেজিস্ট্রেশন’ করার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে সচেষ্ট হলাম।
প্রথমেই উত্তরাখণ্ড সরকারের চারধাম রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। রাত তখন পৌনে ৮টা, তবু কাউন্টারে বসে থাকা এক কর্মচারী সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাঁকেই দেখালাম, ‘টুরিস্ট কেয়ার উত্তরাখণ্ড’ অ্যাপ্স-এর মাধ্যমে আমাদের দুজনের ‘ইউটিডিবি’ রেজিস্টার্ড মোবাইল নম্বর। উনি সব দেখে জানালেন, ওই দুই মোবাইল নম্বরই রেজিস্টার্ড হয়েছে, শুধুমাত্র চারধাম যাত্রার অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পূরণ করার জন্য। তখনও আসল কাজটাই বাকি জেনে আমরা বেশ হতাশ হলাম। চারধাম রেজিস্ট্রেশন অফিসের বিশাল চত্বরে তখনও কয়েক হাজার তীর্থযাত্রীর ভিড়।
এবার আমরা পৌঁছলাম চারধাম যাত্রার টোকেন দেওয়ার কাউন্টারগুলোর কাছে। জানলাম, বন্ধ জানলাগুলো খুলবে সকাল ৮টায়, যদি রেজিস্ট্রেশন অফিস সবুজ সংকেত দেয় ।
১৭ মে ২০২৪ – কর্ণপ্রয়াগের পথে
শুক্রবার সকাল ৮টায় রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, পরের রবিবার পর্যন্ত নাকি রেজিস্ট্রেশন বন্ধ। তার কারণ ‘চারধাম’-এর প্রতিটিতেই নাকি আপাতত বহু সংখ্যক তীর্থযাত্রী অবস্থান করছেন। পরবর্তী তিন দিন ধরে প্রশাসন চেষ্টা করবে, যত বেশি সম্তব তীর্থযাত্রীকে নীচে ঋষিকেশ বা হরিদ্বারে ফিরিয়ে আনতে। ইতিমধ্যে আমরা দুজন আলোচনা করলাম, রেজিস্ট্রেশন অফিসের এক মহিলা অফিসারের সঙ্গে। তিনি আমাদের ফোন নম্বর নিয়ে আশ্বস্ত করলেন, সোমবার রেজিস্ট্রেশন চালু হলেই আমাদের যাত্রার ব্যবস্থা করে দেবেন।
মনে একটু দ্বিধা নিয়ে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। কাছেই একটা দোকানে বসে গরম রুটি-সবজি ও চায়ে চটজলদি প্রাতরাশ সেরে নিলাম। হোটেলে ফিরেই মোহনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি রাজি সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে?’ সে জানায়, ‘মোটেই নয়। ঋষিকেশ থেকে আমি এখনই বেরিয়ে যেতে চাই ।’ আমি বলি, ‘চলো তাহলে বেরিয়ে পড়ি। লাগেজ তো গোছানোই আছে।’
গত রাতেই হোটেলের ঘর ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিলাম। তাই সময় নষ্ট না করে আমরা লাগেজ নিয়ে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বাস স্ট্যান্ডের কাছে আসতেই একটা বোলেরো থেকে হেল্পারের আওয়াজ ভেসে এল, ‘কর্ণপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ’। আমরাও মুহূর্তের মধ্যে বোলেরোর কাছে এসে জানলাম, গাড়িতে মাত্র ২টো আসনই খালি আছে পিছনে। আমরা তখনই ট্রলি দুটো উঠিয়ে দিলাম বোলেরোর ছাদে। গাড়ির হেল্পার দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল আমাদের লাগেজ। আমরাও পিঠ-ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে বসলাম পিছনের সিট-দুটোয়। হেল্পার প্রথমেই আমাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫০০ টাকা করে চেয়ে নিল গাড়ি ভাড়া বাবদ। পাঁচমিনিট পরেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
পিছনের বাকি সিট-দুটোতে বসে রয়েছেন এক বাঙালি দম্পতি। কোনও রকমে ছোট লাগেজগুলোর ঠাঁই হয়েছে আমাদের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পরেই চারজনের মধ্যে বেশ আলাপ জমে উঠল।
দুপুর দেড়টা বাজে। গাড়োয়ালের চেনা পথে গাড়ি এসে থামে একটা ধাবার কাছে। এখানে লাঞ্চ বিরতি আধ-ঘণ্টার। আমরা সবাই একে একে নেমে এলাম জিপ থেকে। ধাবায় ওয়াশ-বেসিনের জলে হাত-মুখ ধুয়ে বসে পড়ি চেয়ারে। খুব গরম, তাই ভাত-ডাল-সবজি এবং দই দিয়ে হালকা লাঞ্চ সেরে নিলাম। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল এবং বেলা ২টো নাগাদ আমরা দেবপ্রয়াগে এসে পৌঁছলাম। গাড়ি এখানে দশ মিনিট থামবে। যতবার দেখি এই প্রয়াগ ততবারই আরও বেশি ভালো লাগে। রাস্তা থেকে বহু নীচে সবুজ-বর্ণের অলকনন্দা ও ঘোলাটে রঙের ভাগীরথীর মিলন ঘটেছে। সঙ্গমের তিনদিকেই পাহাড়– দুই নদীর মিলিত, স্ফীত জলধারা পবিত্র গঙ্গার সৃষ্টি করেছে।
অলকনন্দা ও মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল রুদ্রপ্রয়াগে এসে পৌঁছলাম দুপুর ৩টে নাগাদ। এখানে আমাদের বিদায় জানিয়ে নেমে গেলেন সহযাত্রী দম্পতি। জিপ তখনই আবার চলতে শুরু করল। বিকেল প্রায় ৫টায় আমরা এসে পৌঁছলাম মহাবীর কর্ণের স্মৃতি-বিজড়িত কর্ণপ্রয়াগে। জিপ থেকে নেমে কয়েক পা হেঁটে, রাস্তার পাশেই একটি হোটেলে চেক-ইন করলাম।
বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে কাছেই একটি দোকানে আমরা গরম আলু-টিকিয়া-চাট খেলাম, পরে এক কাপ করে চা। কয়েক পা এগোতেই দেখি অলকনন্দার ওপর লোহার সেতু। আমরা সেই সেতু পেরিয়ে নদীর অন্য পাড়ে চলে গেলাম। সেখান থেকে একটু এগোলেই বাঁ-পাশে প্রয়াগে যাবার সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। সিঁড়ির মুখেই কমলা বর্ণের শিবমন্দির–উমাপতি মহাদেব সঙ্গম শিবালয়। আমরা মহাদেবকে প্রণাম জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। কিছুটা নীচে সিঁড়ির বাঁ-পাশে গঙ্গামায়ের প্রাচীন মন্দির। শ্বেতবর্ণের মাতৃমূর্তি অসাধারণ সুন্দর। কমলা রঙের শাড়িতে সুসজ্জিতা। মূর্তির নীচে বেদিতে সাদা টালির গায়ে শিব-দুর্গার রঙিন ছবি। আরও কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছলাম সঙ্গম-ঘাটে।
প্রশস্থ এবং পরিষ্কার ঘাট। পিণ্ডার নদীর শুভ্র জলরাশি ও অলকনন্দার ঘোলাটে জলরাশির মিলনস্থল, ঘাট থেকে কয়েক ফুট দূরেই দৃশ্যমান।
নন্দাদেবী-পূর্ব (২৪৩৯০ ফুট) এবং নন্দাকোট (২২৫১০ ফুট) পর্বতদ্বয়ের হিমপ্রবাহ থেকে সৃষ্ট হয়েছে পিণ্ডারী হিমবাহ। ১২,৫৩০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হিমবাহটি, দৈর্ঘ্যে প্রায় দুই মাইল এবং প্রস্থে ৪০০ ফুট। পিণ্ডারী হিমবাহ থেকে সৃষ্ট পিণ্ডার নদী কর্ণপ্রয়াগে এসে আরও এক নাম লাভ করেছে– কর্ণগঙ্গা। সঙ্গমের ওপরে কর্ণগঙ্গার তীরেই কর্ণমন্দির। কথিত আছে, মহাবীর কর্ণ এই স্থানেই পিতা সূর্যদেবের তপস্যা করেন। সূর্যদেব পুত্র কর্ণের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘অভেদ্য কবচ’ প্রদান করেন। কর্ণ প্রতিষ্ঠিত ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের বেদীমূলে, নবম শতাব্দীতে নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন আদিগুরু শঙ্করাচার্য।
ঘাট থেকে ধীর-পায়ে জলে নামি। দানবীর কর্ণের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে প্রয়াগের পবিত্র জল মাথায় ঠেকাই। সঙ্গম-ঘাটে বসে থাকি কিছুক্ষণ। তারপর আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি। দৃষ্টি চলে যায় সিঁড়িতে বসে থাকা এক সাধুর প্রতি, যিনি নিজের মনেই কথা বলছিলেন। রাস্তায় উঠে এসে, কিছুদূর হেঁটে অলকনন্দার ওপর আর এক লোহার সেতু পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বাস ও কার-স্ট্যান্ডে। জেনে নিলাম, কোথা থেকে এবং কখন আদিবদ্রি যাওয়ার বাস ছাড়বে ।
হোটেলের ঘরে বসে পরদিনের যাত্রাপথের পরিকল্পনা করে নিলাম। ঠিক হল, ভোরে উঠে আরও একবার প্রয়াগ দর্শন করব। তারপর বের হব আদিবদ্রি দর্শন করতে। একই দিনে আমাদের ইচ্ছে হেলাং হয়ে দেবগ্রামে পৌঁছনোর। রাত ৯টা নাগাদ বের হ’লাম ডিনার সারতে। কাছেই এক পরিচ্ছন্ন হোটেলে গিয়ে দই-সহ ভেজ-থালিতে রাতের খাওয়া সেরে নিলাম। এবার হালকা ঠান্ডা আবহাওয়ায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম হোটেলে। ক্রমশ..