স্কন্দ পূরাণে উল্লিখিত আছে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা রাক্ষসদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় রাক্ষসকুলের বিনাশ সাধনে উদ্যত হলে, রাক্ষসেরা মহাদেব শিবের তপস্যা শুরু করেন। শিব তাঁদের কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের বর চাইতে বলেন। তখন সেই রাক্ষসগণ মহাদেবের কাছ থেকে দু’টি বর প্রার্থনা করেন। প্রথম বরে তাঁদের যেন রাক্ষস-যোনি থেকে মুক্তি ঘটে এবং দ্বিতীয় বরে তাঁদের নাম ভবিষ্যতে যেন সম্মানের সঙ্গে বিভিন্ন কথায় উল্লিখিত থাকে। মহাদেব বর দানের পরে সেখানে একটি গুহা নির্মাণ করে বলেন, তিনি গুহায় শিবলিঙ্গ রূপে বিরাজ করবেন এবং সমগ্র পর্বতে সেই রাক্ষসদের সঙ্গে জুড়ে থাকবেন ততগুলি শিবলিঙ্গের রূপে। রাক্ষসদের সংখ্যা ছিল কোটির সমান— তাই সেখানে শিবের নাম হয় কোটেশ্বর।
গাড়িতে এসে বসতেই জয়দীপ এগিয়ে চলল রুদ্রপ্রয়াগে হোটেলের খোঁজে। মিনিট পনেরো পরে রাস্তার পাশেই একটা হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হল। হোটেলের একতলায় একটা ঘর পছন্দ হয়ে গেল। গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে জয়দীপকে টাকা মিটিয়ে দিলাম। সে আমাদের বিদায় জানিয়ে ফিরে গেল যোশিমঠের পথে। ঘরে লাগেজ রেখে লাঞ্চ সারলাম হোটেলেই।
বিকেল ৫টায় বার হ’লাম চায়ের টানে। চা পান করার সময়েই বৃষ্টি এসে গেল– প্রথমে অল্প-স্বল্প, তারপরে প্রবলভাবে। এক ঘণ্টা পরে বৃষ্টি থামলেও আকাশ মেঘলা। হঠাৎই ঠান্ডা অনুভব করলাম। হোটেলে ফিরে এলাম সন্ধে পৌনে ৭টায়। ঘরে মোবাইল-ফোন চার্জ করে নিলাম। ভোরে যাব প্রয়াগ দর্শনে, তাই রাত ১০টায় ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম।
২২/৫/২০২৪ – রুদ্রনাথ মন্দির ও অলকনন্দা-মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল
ভোর ৫টায় উঠে ঘরেই চা বানিয়ে নিলাম এবং সাড়ে ৫টায় হোটেল ছেড়ে বার হ’লাম। রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকে এগোতেই দেখি, একটা সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নীচে। সেখান থেকে কিছুটা হেঁটে পার হ’লাম সেতু– নীচে অলকনন্দা। আমরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরে প্রয়াগের দিকে এগোলাম। কিছুটা এগোতেই বাঁ পাশে ‘কালীকমলি যাত্রি নিবাস’। গলির মুখে বিরাট হোর্ডিং : “শ্রীরুদ্রনাথজী কা প্রাচীন মন্দির”— সেই দিকেই সঙ্গমে যাওয়ার রাস্তা। গলি দিয়ে প্রায় ৬০০ মিটার এগিয়ে রাস্তার ডান দিকে দেখি, আমাদের অভীষ্ট রুদ্রনাথ মন্দিরের প্রবেশ দ্বার। প্রথমেই প্রাচীন শ্রীরুদ্রনাথ মন্দিরে গিয়ে পৌঁছে প্রণাম জানালাম মহাদেবের উদ্দেশ্যে। এরপর দর্শন করলাম শ্রীদূর্গা মন্দির, শ্রীভৈরবনাথ মন্দির এবং হনুমান মন্দির। ইতিমধ্যে দেখি, মন্দির চত্বরে এক বিশেষ জায়গায় ছাত্ররা এসে আসন গ্রহণ করছে। আমরা দু’জন এগিয়ে এসে আলাপ করলাম শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সংস্কৃত ক্লাসে ছাত্রদের এবার তিনি বেদ পাঠের শিক্ষাদান করবেন। জানলাম, এই সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় রাজ্য সরকারের অধীনে এবং ছাত্ররা এখানে বিনামূল্যে খাদ্য, বাসস্থান এবং শিক্ষা লাভ করে।
মন্দিরের উল্টোদিকে রাস্তার পাশ থেকেই সিঁড়ি নেমে গিয়েছে সঙ্গমস্থলের দিকে। গাড়োয়াল হিমালয়ের চোরাবালি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে মন্দাকিনী রুদ্রপ্রয়াগে এসে মিলিত হয়েছে অলকনন্দার সঙ্গে, যার উৎপত্তি হয়েছে সতোপন্থ ও ভাগীরথী-খড়ক হিমবাহ দু’টির মিলনস্থল থেকে। হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে সঙ্গমস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো। ঘাটে নেমে সঙ্গমের পবিত্র জল মাথায় ঠেকালাম। এবার দর্শন করলাম চামুণ্ডা মায়ের মন্দির, তারপরে শিবমন্দির– যেখানে সঙ্গীত শিক্ষা সম্পূর্ণ করে মহর্ষি নারদ বর প্রার্থনা করেছিলেন মহাদেবের কাছে।
হোটেলে ঢোকার আগে এক রেস্তোরাঁয় বসে প্রাতরাশ সারলাম। আজ আমরা রুদ্রপ্রয়াগেই থাকব। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময়। স্নান সেরে লাঞ্চ করলাম হোটেলেই। অলস দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। বিকেল সাড়ে ৪টায় একটা দোকানে চা পান করে হাঁটতে লাগলাম সঙ্গমস্থলের উদ্দেশ্যে। রুদ্রপ্রয়াগের অন্ত্যেষ্টি ঘাট পেরিয়ে উঠে এলাম সেতুর উপর। অলকনন্দার রূপে শ্বেতবর্ণের উচ্ছ্বাস, তুলনায় মন্দাকিনী যেন কিছুটা কালচে। রাতে ডিনার সেরে জনবিরল রাস্তায় একটু হাঁটাহাটি করলাম। পরদিন সকালে যাব দেবপ্রয়াগে।
২৩/৫/২০২৪ – দেবপ্রয়াগ, শ্রীরঘুনাথ মন্দির
ভোর ৫টায় উঠে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে, পিঠে ন্যাপ-স্যাক ও হাতে ট্রলি নিয়ে হোটেল ছাড়লাম। বাস স্ট্যাণ্ডে পৌঁছলাম পৌনে ৬টায়। ঋষিকেশগামী বাসের ডিকিতে ট্রলি ঢোকানোর পর জানলার পাশেইসিট পেলাম। এবার এক চা-দোকানে বিস্কুট-সহ দু’কাপ করে চা খেয়ে আমরা সিটে এসে বসলাম। বাস ছাড়ল সাড়ে ৬টায়। সকালের যাত্রা আমার ভারি প্রিয়। অলকনন্দা বয়ে চলেছে অনেক নীচে। উল্টো দিক থেকে মোটরবাইকে চেপে শিখ যুবকেরা চলেছে হেমকুণ্ড সাহিবের পথে। পাহাড়ের আমগাছে ঝুলছে ছোট-ছোট কাঁচা আম, আর সমতলে তখন পাকা আমের রমরমা।
অলকনন্দা উৎগ্রীব ভাগীরথীর সঙ্গে মিলিত হতে। বাস শ্রীনগরে এসে পৌঁছলো ৭টা ৪৫-এ। যথেষ্ট আধুনিক শহর গাড়োয়ালের শ্রীনগর। টিহরি গাড়োয়ালের কীর্তিনগর পেরিয়ে ৯টা ২০ মিনিটে এসে পৌঁছলাম দেবপ্রয়াগে। বাস থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে এনএইচ-৭-এর পাশেই এক ধাবায় ঘর পেয়ে গেলাম। ভাড়া ১৫০০ টাকা।
দেবপ্রয়াগে বেশ গরম। নীচে নেমে ঠাণ্ডা লেবু-শরবত পান করলাম। এবার রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছলাম প্রয়াগের প্রবেশদ্বারে। সেখান থেকে সিঁড়িদিয়ে নেমে লোহার সেতুতে এলাম। সেতু পেরিয়ে অন্যপাড়ে গেলে সঙ্গমস্থল এবং স্নানঘাটে নামার সিঁড়ি। এবার প্রয়াগের বাজার-দোকানের মাঝ দিয়ে এগিয়ে এসে পৌঁছলাম প্রাচীন শ্রীরঘুনাথ মন্দিরের নীচে। মোট ১০৩টি সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরদ্বারে পৌঁছলাম। শ্রীরঘুনাথ মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকেই গরুড় মন্দির।
অষ্টম শতাব্দীতে আদিগুরু শঙ্করাচার্য স্থাপন করেন এই মন্দির। পরে টিহরি গাড়োয়ালের রাজারা তার সংস্কার ও বৃদ্ধি করান। অলকনন্দা ও ভাগীরথীর সঙ্গমে সৃষ্ট পবিত্র গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরে শ্রীরাম এবং পিতা দশরথ নাকি তপস্যা করেছিলেন। মন্দিরের সামনে পিতলের গরুড়-মূর্তি। মন্দিরের চূড়ায় শোভা পাচ্ছে শিখর-কলস, ছত্রের উপরে পিতলের দণ্ড। রঘুনাথ মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের বিরাট মূর্তিটি অতি সুন্দর – তাঁর মাথায় মুকুট, গায়ে গহনা, কোমরে ঢাল-তলোয়ার এবং হাতে তীর-ধনুক। দণ্ডায়মান শ্রীরামের বাঁ পাশে সিংহাসনে বসে রয়েছেন সীতা। ডান পাশে রাম ও লক্ষ্মণের দুটি ছোট মূর্তি।
স্নান ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সবুজাভ অলকনন্দা ও ঘোলাটে ভাগীরথীর অপূর্ব সুন্দর সঙ্গম। শতোপন্থ হিমবাহ ও ভাগীরথী-খড়ক হিমবাহের মিলনস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে অলকনন্দা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে দেবপ্রয়াগে এসে মিলিত হয়েছে গঙ্গোত্রী হিমবাহের পদপ্রান্তে অবস্থিত গোমুখ থেকে উৎপন্ন হওয়া ভাগীরথীর সঙ্গে। পবিত্র দুই নদীর মিলিত ধারা পতিতপাবনী গঙ্গা। বুদ্ধ পূর্ণিমার পূণ্য দিনে দেবপ্রয়াগে স্নান সারলাম। মন প্রাপ্তির আনন্দে পরিপূর্ণ।
হাল্কা লাঞ্চ সেরে দুপুরে বিশ্রাম নিলাম। বিকেল সাড়ে ৪টেয় দরজা খুলে বারান্দায় এলাম। সামনে তাকালে চোখে পড়ছে পাহাড়ের নীচে “কেন্দ্রীয় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়”-এর বিশাল বিল্ডিং। ধাবায় চা খেয়ে হেঁটে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। সন্ধে ৭টায় ঘরে ফিরে স্নান সেরে নিলাম। রাত ৯টায় ধাবার বৈষ্ণব ভোজনালয়ে ফ্রায়েড রাইস ও পনীর মশালায় ডিনার সারলাম।
২৪/৫/২০২৪ – ঋষিকেশ ও হরিদ্বার
সকাল সাড়ে ৬টা। এনএইচ-৭-এর পাশে, এক দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎই ঋষিকেশগামী বাস এসে থামল সেখানে। ডিকিতে লাগেজ ঢুকিয়ে বাসে উঠে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। বাস চলতে শুরু করার পরেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে উঠল। হিমালয় ছেড়ে এলেই আমার এই অবস্থা হয়।
ঋষিকেশ বাস স্ট্যাণ্ডে এসে পৌঁছলাম ঠিক সাড়ে ৮টায়। এক দোকানে গরম আলুপরোটা ও চায়ে প্রাতরাশ সেরে নিয়েই হরিদ্বারগামী বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছাড়ল সকাল ৮টা ৫০-এ। ভেবে অবাক হ’লাম, মাত্র ৯ দিন আগেই হরিদ্বার থেকে যাচ্ছিলাম ঋষিকেশে – আর আজ ফিরে চলেছি একই পথে। হরিদ্বারে এসে পৌঁছলাম ঘণ্টাখানেক পরে। বাস-স্ট্যাণ্ড থেকে বেরিয়ে ই-রিক্সায় চেপে পৌঁছলাম কাছেই এক রেসিডেন্সীতে। তিনতলায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এক দ্বিশয্যা বিশিষ্ট ঘরে আমাদের ঠাঁই মিলল তিনদিনের জন্য।
প্রতিদিনই ভোরে চা-বিস্কুট খেয়ে একটু হেঁটে বেড়ানো, নির্দিষ্ট সময়ে ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ, সন্ধেবেলায় হর-কি-পৌড়ি ঘাটে গঙ্গারতি দেখা এবং রাতে ডিনার সেরে বিছানায় ঘুম। মাঝে একদিন ভোরবেলায় গিয়েছিলাম আমার প্রিয় বিষ্ণুঘাটে। ২৭ মে, সকাল থেকে দুজনেরই মনে ঘরে ফেরার আনন্দ। বন্ধু মোহন সন্ধে ৬টায় চাপল দিল্লিগামী ট্রেনে। আমার ঘরে ফেরার ট্রেন রাত সেই পৌনে ১২টায়। (সমাপ্ত)