• facebook
  • twitter
Tuesday, 8 April, 2025

সপ্তবদ্রি ও পঞ্চপ্রয়াগ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুপ্রয়াগে দাঁড়ালে যেন এক অসাধারণ অনুভূতি আসে মনে। নিতি ভ্যালি থেকে উৎপন্ন হয়ে দুরন্ত গতিতে বয়ে এসে, দুর্বার অলকনন্দার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শ্বেতবর্ণের ধৌলিগঙ্গা। দেখে এলেন শেষাদ্রি শেখর ভট্টাচার্য।

পর্ব – ৬

যোগবদ্রি মন্দিরের ডানপাশে অবস্থিত বাসুদেব মন্দিরে শোভা পাচ্ছে অপূর্ব সুন্দর বাসুদেবের মূর্তি। একসময় খননকার্যের পরে অনতিদূরে আবিস্কৃত হয়েছিল ছোট এক লক্ষ্মী মন্দির। স্থাপত্যের বিচারে যোগবদ্রি মন্দির নির্মিত হয় নবম শতাব্দীর শুরুতে। বাসুদেব মন্দিরও তৈরি হয় নবম শতাব্দীতে, কিন্তু যোগবদ্রি মন্দির নির্মাণের কিছু সময় পরে।

যোগবদ্রি মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পের এক অনুপম নিদর্শন। এটি একটি নলাকার ‘শিখর’ নিয়ে তৈরি, সঙ্গে ঢালু ছাদের মণ্ডপ। শিখরের দেওয়ালে রয়েছে মূল দিক নির্দেশিত চারটি প্রসারিত কুলুঙ্গি যেগুলি কীর্তিমুখ মোটিফে সজ্জিত। শিখর-নির্মাণে বৌদ্ধস্তুপের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শিল্পরীতিতে এই মন্দির সমগ্র উত্তরাখণ্ডে একেবারেই তুলনাহীন। বাসুদেব মন্দিরের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে যোগবদ্রি মন্দিরের সঙ্গে, শুধু শিখরটি এখানে বক্ররেখায় তৈরি। যোগবদ্রি দর্শন শেষে সম্পূর্ণ হল আমাদের সপ্তবদ্রি পরিক্রমা।

গাড়ি এগিয়ে চলল বিষ্ণুপ্রয়াগের পথে– পাণ্ডুকেশ্বর থেকে যার দূরত্ব মোটামুটি সাড়ে ৯ কিমি। বিকেল ৫টা নাগাদ আমরা বিষ্ণুপ্রয়াগের প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছলাম। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে পৌঁছে গেলাম সঙ্গমস্থলের কাছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ১৩৭২ মিটার অর্থাৎ ৪৫০১ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিষ্ণুপ্রয়াগে দাঁড়িয়ে, এক অসাধারণ অনুভূতি এল মনে। নিতি ভ্যালি থেকে উৎপন্ন হয়ে, দুরন্ত গতিতে বয়ে এসে দুর্বার অলকনন্দার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শ্বেতবর্ণের ধৌলিগঙ্গা। সঙ্গমস্থলের স্বর্গীয় রূপ দেখে ধন্য হলাম। সঙ্গমের ডান ও বাঁ-পাশে পাহাড়, সামনে তাকালেও পাহাড়। ছবি তুললাম সেই অপূর্ব দৃশ্যের। অবাক হয়ে দেখছি, অশান্ত অলকনন্দাকে বুকে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জয় ও বিজয় পাহাড় (নর ও নারায়ণ পর্বত)। প্রচণ্ড স্রোত দুই নদীতেই। রেলিং ধরে সাবধানে নীচে নেমে প্রয়াগের পূণ্যবারি মাথায় ঠেকালাম। মনে পেলাম পরম শান্তি! এবার প্রথমে গিয়ে পৌঁছলাম প্রয়াগের বিষ্ণু-নারায়ণ মন্দিরে– প্রত্যক্ষ করলাম শ্রীবিষ্ণুর সুন্দর কৃষ্ণমূর্তি। তারপর একে একে দর্শন করলাম ভূতনাথ মহাদেব মন্দির এবং প্রাচীন ভৈরবনাথ মন্দির।

বিষ্ণুপ্রয়াগের উপরে একটি দোকানে বসে কফি ও বিস্কুট খেলাম। জয়দীপ ঠান্ডা পানীয় নিল। এরপর গাড়িতে বসে ফিরে চললাম যোশিমঠের পথে। ভাবছিলাম,বাকি রইল নন্দপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ ও দেবপ্রয়াগের পূণ্য বারি স্পর্শ করা। যোশিমঠের কিছু আগে থেকে গাড়ির লম্বা জ্যামে আটকে রইলাম কিছুক্ষণ। অবশেষে হোটেলের কাছে এসে পৌঁছলাম সন্ধে সাড়ে ৬টা নাগাদ। জয়দীপ গাড়ির টাকা নিয়ে ফিরে গেল।

ঘরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে নিলাম। এই পরিক্রমায় আমরা বাসের চেয়ে গাড়িতেই ঘুরছি বেশি। তাতে খরচ কিছুটা বেশি লাগলেও, আমরা বদ্রি ও প্রয়াগগুলিতে সরাসরি পৌঁছে গিয়ে সময়ের সাশ্রয় করতে পেরেছি অনেকটাই। আলোচনায় ঠিক হল, পরদিন সকালে আমরা একটু দেরিতে হোটেল থেকে চেক আউট করে, গাড়িতে চেপে সোজা যাব নন্দপ্রয়াগে। তারপর কোটেশ্বর মহাদেবের গুহামন্দির দর্শন করে রুদ্রপ্রয়াগের কোনও এক হোটেলে চেক-ইন করব। রাত সাড়ে ৮টায় ডিনার করতে পৌঁছলাম আর-একটি হোটেলে।

২১/৫/২০২৪–নন্দপ্রয়াগ, কোটেশ্বর গুহামন্দির এবং রুদ্রপ্রয়াগ

গত রাতে যতটা সম্ভব লাগেজ গুছিয়ে রেখেছিলাম, তাই আজ আমরা বিছানা ছাড়লাম সকাল ৬টার পরে। জয়দীপকে বলা হয়েছে সকাল সাড়ে ৯টায় গাড়ি নিয়ে আসতে। মুখ ধুয়ে ঘরেই চা বানিয়ে নিলাম। বারান্দায় এসে নৃসিংহ বদ্রিকে প্রণাম জানালাম। এবার একে একে স্নান সেরে নিলাম। আজ আরও লম্বা জার্নি– তাই সাড়ে ৮টায় নীচে নেমে একটি দোকানে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। তারপর হোটেলে ফিরে ঘরভাড়া মিটিয়ে দিলাম। ঠিক সকাল ৯টা ৪০-এ জয়দীপ গাড়ি নিয়ে চলে এল। হোটেলের এক কর্মচারী আমাদের ট্রলি দুটো গাড়ির ডিকিতে ঢুকিয়ে দিল। আমরা বসতেই জয়দীপ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল। যোশিমঠ থেকে নন্দপ্রয়াগের দূরত্ব ৬০ কিমি, সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টাা। বাজার এলাকা ছাড়িয়ে চলে এলাম এনএইচ-৭-এ।

ভাবছিলাম, কালের নিয়মেই ঋষিকেশ ও যোশিমঠে আধুনিকতার যথেষ্ট প্রভাব– পূণ্যভাবের তেমন বিকাশ নেই। একে একে সেলাং, প্যানিং পেরিয়ে চলে এলাম হেলাং-এ। যোশিমঠ থেকে হেলাং-এর দূরত্ব সাড়ে ১৫ কিমি। হেলাং মোড় থেকে ডানদিকে চলে গেছে দেবগ্রাম যাবার রাস্তা। আমরা এগিয়ে চললাম চামোলির পথে। কিছুক্ষণ পরেই পেরোলাম গুলাবকোটি, পাতাল-গঙ্গা এবং গড়ুর-গঙ্গা। পিপলকোটি পৌঁছলাম বেলা ১১টা নাগাদ। বাজার এলাকায় দেখি বহু দোকান, হোটেল ও ব্যাঙ্ক।

বতুলা পেরিয়ে চলে এলাম সদর শহর চামোলি-তে। অসংখ্য ধর্মীয় উপাসনালয় ও মন্দিরের জন্যই চামোলিকে ‘দেবতার আবাস’ বলা হয়। বেলা ১১টা ৫০-এ পৌঁছলাম নন্দপ্রয়াগ। গাড়ি এসে থামল একেবারে নন্দপ্রয়াগে নামার সিঁড়ির কাছে। বহু সিঁড়ি অতিক্রম করে নীচে নেমে পৌঁছলাম একটি সেতুর সামনে। সেই সেতু নদী-বুকের উপর দিয়ে পৌঁছে গেছে অলকনন্দা ও নন্দাকিনির সঙ্গম ঘাটে। সঙ্গমের দুই দিকেই পাহাড়, মাথার উপরে নীল আকাশ, সেখানে সাদা মেঘ– প্রকৃতির অপূর্ব সুন্দর রূপ দেখে আমরা একেবারে মুগ্ধ। ঘাটে এসে নিচু হয়ে, হাত বাড়িয়ে প্রয়াগের জল নিয়ে মাথায় ঠেকালাম। নন্দাকিনির উৎস নন্দাঘুণ্টি শিখরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত হিমবাহ থেকে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে নন্দাকিনি অলকনন্দার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ৮৭০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই নন্দপ্রয়াগে। ঘাট থেকে ফিরে এগিয়ে গেলাম বাঁধানো, পরিষ্কার অন্ত্যেষ্টি ঘাটের দিকে। তার চারপাশেই গাছ, কাছেই বসার জায়গা। কিছুদূরে সাধু-সন্ন্যাসীদের থাকার জন্য কয়েকটি ঘর। নন্দপ্রয়াগের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে এক অনাবিল শান্তির পরিবেশ।

সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম রাস্তায়। আমরা বসতেই ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করল– এগিয়ে চললাম রুদ্রপ্রয়াগের পথে। দূরত্ব ৫২ কিমি। বেশ গরম লাগছে। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামানো হল। আমরা একটা দোকান থেকে ঠান্ডা লস্যি কিনে পান করলাম। গাড়ি কর্ণপ্রয়াগে এল দুপুর ১টায় এবং গৌচরে মিনিট ১৫ পরে।

রুদ্রপ্রয়াগের ৪-৫ কিমি আগে অলকনন্দার তীরে, কোটেশ্বর মহাদেব গুহামন্দির অবস্থিত। মন্দিরের বিরাট প্রবেশদ্বারের কাছে এসে পৌঁছলাম দুপুর ২টোয়। ছবি তুললাম গৈরিক বর্ণের সুউচ্চ প্রবেশদ্বারের। ছায়ামাখা পথ ধরে এগিয়ে চললাম গুহামন্দিরের উদ্দেশ্য। পথের বাঁ-পাশে পর পর দোকান, পুজোর উপকরণের। পথ শেষ হয়েছে সিঁড়ির মুখে– নীচে বয়ে চলেছে খরস্রোতা অলকনন্দা। ঘুরে ঘুরে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নদীর বাঁধানো ঘাটে। প্রথমেই চোখে পড়ল রেলিং-ঘেরা কোটেশ্বর মহাদেব স্নান-ঘাট। আরও কিছুটা এগিয়ে দেখি, বাঁ-পাশের লতা-গুল্মে ভরা পাহাড় থেকে টিপটিপ করে অবিরাম জল পড়ছে পথের উপর। পথের ডান পাশে রেলিং– তার পাশেই স্রোতস্বিনী অলকনন্দা। স্যাঁতসেঁতে ভেজা পথে এগিয়ে চললাম গুহামন্দিরের দিকে। পথের পাশে, পাহাড়ের গায়ে গাছের ওপর বহুসংখ্যায় বাঁদর। মাঝে মাঝে তারা পূণ্যার্থীদের কাছেও চলে আসছে খাবারের সন্ধানে।

কয়েক মিনিট হেঁটে এবার পৌঁছে গেলাম গুহামন্দিরের কাছে। মাথা নিচু করে গুহামন্দিরে প্রবেশ করেই বিস্ময়ে হতবাক হলাম। দেখি, গুহা-গাত্রে কোটেশ্বর মহাদেবের একাধিক স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ। পাহাড়ের গা থেকে অবিরাম জল চুঁইয়ে পড়ছে শিবলিঙ্গগুলির উপর– ফলে তার নিচেই সৃষ্ট হয়েছে একটি ক্ষুদ্র জলাশয়। বেলপাতা, জবাফুল ও গাঁদাফুল দেওয়া হয়েছে লিঙ্গগুলির উপরে। জলাশয়ের দুই পাশে, বেদীর উপরে উপবিষ্ট দুটি শ্বেতবর্ণের নন্দী শিবলিঙ্গগুলির দিকেই মুখ করে। মহাদেবের উদ্দেশ্যে অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে বেরিয়ে এলাম ওই আশ্চর্য গুহামন্দির থেকে। (চলবে)

News Hub