• facebook
  • twitter
Sunday, 27 April, 2025

সপ্তবদ্রি ও পঞ্চপ্রয়াগ

চামোলি জেলার অ্যানিমঠে বৃদ্ধবদ্রির অবস্থান, যা বদ্রিক্ষেত্রের পঞ্চম তথা ‘সপ্তবদ্রি’-র অন্যতম। কৃষ্ণপাথরে তৈরি বিষ্ণুমূর্তি। এখানে বদ্রির বৃদ্ধবেশ। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত শোনাচ্ছেন শেষাদ্রি শেখর ভট্টাচার্য।

পর্ব – ৪

হেলাং মোড়ে এসে পৌঁছলাম ৮টা ৪০-এ। গাড়ি বাঁক নিল ডানদিকে। মাত্র ২-৩ কিমি পথ পেরিয়ে অ্যানিমঠে পৌঁছলাম ১০ মিনিট পরেই। রাস্তার ধারেই বৃদ্ধবদ্রি মন্দিরের প্রবেশ দ্বার। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম, ১৩৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত বৃদ্ধবদ্রি মন্দিরের উদ্দেশ্যে। খাড়া সিঁড়ি এঁকে-বেঁকে উঠে গিয়েছে। দু’পাশে ঘরবাড়ি, ফুলের বাগান, সবজির চাষ— বেশ ভালো লাগছে। পেঁয়াজকলির উপর তার ফুলের যা আকার হয়, সবজি বাগানে রসুনকলিতে ফুলের আকার দেখলাম তার তিন-গুন বড়। একনাগাড়ে সিঁড়ি ভেঙে দশ-বারো মিনিট পরে গিয়ে পৌঁছলাম বৃদ্ধবদ্রি মন্দিরের কাছে।

গুপ্ত বংশের রাজত্বকালে নির্মিত প্রাচীন এই মন্দিরের মূল গঠনকে অক্ষুন্ন রেখে, তার সংস্কার করা হয়েছে সম্প্রতি। মন্দিরের চাতালের বাইরে জুতো ছেড়ে, হাত ধুয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। পরিষ্কার মন্দিরে পুরোহিত সবেমাত্র তাঁর পুজো শেষ করেছেন। কৃষ্ণপাথরে তৈরি বিষ্ণুমূর্তিকে প্রণাম জানালাম। এখানে বদ্রির বৃদ্ধবেশ। পূজারীজির সঙ্গেও পরিচিত হলাম।

মন্দিরের চাতালে বসে মনে পড়ে গেল হিন্দুধর্মের উপকথায় বৃদ্ধবদ্রির গুরুত্ব। ভগবান বিষ্ণু এই স্থানে এক বৃদ্ধ মানুষের বেশে পূজিত হন। তাই বদ্রির এই নাম। উপকথায় বলা হয়েছে, মহর্ষি নারদ এই স্থানেই বিষ্ণুদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য তপস্যা শুরু করেন। ভক্তের উপাসনায় সেদিন আনন্দিত হন বিষ্ণুদেব। স্বয়ং বিশ্বকর্মা-সৃষ্ট এক বৃদ্ধের অবয়বে তিনি দেখা দেন মহামুনি নারদকে। মনে করা হয়, বন্যা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভগবান বিষ্ণুর এই মূর্তি ছিল অ্যানিমঠেই। তারপর অষ্টম শতকে এই মূর্তি খুঁজে পান জগৎগুরু আদি শঙ্করাচার্য, যিনি তখন ভারতবর্ষের প্রতিটা দুর্গম স্থানে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করে বেড়াচ্ছিলেন। তিনিই ওই বিষ্ণুমূর্তিকে ‘বৃদ্ধবদ্রি’ রূপে আবিষ্কার করে, তাঁকে মন্দিরে পুনরায় স্থাপন করেন।

আমরা ধীরে ধীরে নামতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে। প্রায় ১০ মিনিট পরে আমরা নীচের রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। প্রবেশদ্বারের উলটো দিকে রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান। আমরা সেই দোকানে ঢোকার সময় প্রকাশ ও বিনোদকেও ডেকে নিলাম। বিস্কুট সহযোগে চা পান করলাম সকলে। এবার অল্টোতে চড়ে বসতেই বিনোদ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল। আমরা এগিয়ে চললাম যোশিমঠের পথে।

হেলাং থেকে এনএইচ-৭ ধরে এগোলে যোশিমঠের দূরত্ব ১৫-১৬ কিমি। প্রায় ৪০ মিনিট পরে যোশিমঠ বাজার এলাকায় অবস্থিত হোটেল সানরাইজ ইন-এর কাছে এসে গাড়ি থামল । গাড়ি ভাড়ার টাকা মিটিয়ে আমরা হোটেলে চেক-ইন করলাম বেলা ১১টায়।

দোতলায় আমাদের ঘর দেওয়া হল। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সামনেই চোখে পড়ে নৃসিংহবদ্রি মন্দির। ঘরে লাগেজ গুছিয়ে রেখে স্নান সেরে নিলাম। এবার পরিষ্কার জামা-প্যান্ট পরে আমরা নিচে নেমে এলাম। অর্ধবদ্রির পরিবর্তে আমরা নৃসিংহবদ্রি দর্শন করব। রাস্তা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে এলাম মন্দিরের কাছে।

প্রবেশ করে দেখি, অতি সুন্দর রত্নালঙ্কারে ভূষিত নৃসিংহবদ্রি (নরসিংহ অবতার)– যাঁর একপাশে কুবের ও উদ্ধবজি, অন্য পাশে শ্রীরাম-লক্ষণ-সীতা বিরাজমান। নৃসিংহ বা নরসিংহ, ভগবান বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। শ্রীবিষ্ণু আংশিক সিংহ এবং আংশিক মানুষের শরীরে অবতীর্ণ হয়ে বরপ্রাপ্ত অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে পৃথিবীকে অধর্ম ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। এবার দর্শন করলাম আদিগুরু শঙ্করাচার্যের বেদি। সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালাম ওই মহাপুরুষের উদ্দেশ্যে। তারপর বিশাল মন্দির চত্বর ঘুরে একে একে দর্শন করলাম বলভদ্র-বাসুদেব মন্দির, শিব মন্দির, কালী মন্দির, গড়ুর মন্দির এবং অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির।

শীতকালে যখন বরফাবৃত বদ্রিনাথ অগম্য হয়ে পড়ে, তখন যোশিমঠের নৃসিংহ মন্দিরে, নরসিংহ মূর্তির সঙ্গেই শ্রীবদ্রিবিশালজি পূজিত হন। প্রবাদ আছে, কলিযুগের শেষে যখন নরসিংহ মূর্তির ডান হাত খসে পড়বে, তখন এক বিধ্বংসী ভূমিধ্বসে বদ্রিনাথ যাওয়ার পথ বন্ধ হবে। প্রত্যক্ষদর্শী পূজারীদের মতে নরসিংহ মূর্তির দক্ষিণ হস্ত ক্রমশই ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং যোশিমঠ অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে ভূমিধ্বস প্রকট হচ্ছে। প্রবাদ অনুসারে, কলিযুগের শেষে সত্যযুগে শ্রীবদ্রিনাথ তাঁর আসনের স্থানান্তর করবেন ভবিষ্যবদ্রি-তে, যোশিমঠ থেকে যার দূরত্ব ২৯ কিমি।

কাছেই এক চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে প্রায় ৪৫০টি সিঁড়ি ভেঙে, বিভিন্ন উচ্চতায় বহু ঘর- বাড়ি-দোকানের মাঝ দিয়ে, উপরে উঠে পৌঁছে গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। তখনই এক হাসি-খুশি যুবক এগিয়ে এল আমাদের কাছে। নাম জয়দীপ। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পরদিন সকালে ভবিষ্যবদ্রি যাওয়ার ছোট গাড়ি পাওয়া যাবে কিনা। আমরা মাত্র দু’জন জেনে সে বলে, গাড়ি পাওয়া যাবে। ভাড়া পড়বে ২২০০ টাকা। আমরা তাকে ২০০০ টাকায় রাজি করাই। তার ফোন নম্বর নিয়ে লাঞ্চ করতে গেলাম একটি হোটেলে। দুটো ভেজ থালি-র অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম চেয়ারে।
মোহন আমায় জিজ্ঞাসা করল, ‘বিকেলে আমরা কী করছি?’
আমি বলি, ‘যোশিমঠেই একটু ঘোরাঘুরি করার ইচ্ছে।’
সে প্রস্তাব দেয়, ‘লাঞ্চের পরেই তো ভবিষ্যবদ্রি দর্শনে যেতে পারি।’
আমিও সায় দিয়ে বলি, ‘ভালোই তো। এখনই জয়দীপকে ফোন করছি।’

ততক্ষণে গরম খাবার এসে গিয়েছে টেবিলে। জয়দীপকে ফোনে জিজ্ঞাসা করি, সে এখন কোথায়। সে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেই রয়েছে জেনে তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলি। দ্রুত লাঞ্চ সেরে আমরা ফিরে যাই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে।

জয়দীপ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘ক্যায়া বাত হ্যায় স্যার?’
আমি বলি, ‘অভি ভবিষ্যবদ্রি যাকে শাম সে পহলে ওয়াপস আ সকেঙ্গে?’
সে হেসে বলে, ‘আরাম সে। অভি তো স্রিফ পৌনে দো বজা হ্যায়। সাড়ে পাঁচ সে পহলে ওয়াপস আ যাউঙ্গা।’

জয়দীপের গাড়ি সামনেই পার্ক করা রয়েছে। আমরা তখনই উঠে বসি গাড়িতে। গাড়ি ধীরে ধীরে লোকালয় ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়ল। আমরা চলেছি তপোবন রোড ধরে। রাস্তার পাশে পাইন গাছ, বহুদূর পর্যন্ত। এই রাস্তা চলে গিয়েছে সেই নিতি ভ্যালি অবধি। এবার পাহাড়ের বাঁকে দেখতে পাই বিশাল হনুমান শিলা। তোলি জনপদ পেরিয়ে গেলাম। রাস্তার অবস্থা খারাপ, কিন্তু শান্ত পরিবেশ।

অবশেষে তপোবন এসে পৌঁছলাম। ছোট গ্রাম– বেশ কয়েকটা প্রয়োজনীয় দোকানপাট নিয়ে ব্যস্ত বাজার এলাকা। আমরা গাড়ি থামিয়ে জলের বোতল কিনে নিলাম।

গাড়ি আবার এগিয়ে চলল। চাঁচরি পেরিয়ে গেলাম। পাহাড় থেকে ধ্বস নামার চিহ্ন যেখানে সেখানে। এটাও একটা বড় কারণ, প্রায় সময়েই এইসব রাস্তা খারাপ থাকার। ধৌলিগঙ্গার পাশ দিয়ে রাস্তা এগিয়েছে। সামনে শোভা পাচ্ছে বরফে ঢাকা দ্রোণাগিরি আর কলঙ্ক-শিখর। কখনও রাস্তার বাঁকে বাঁকে উঁকি দিচ্ছেন আমার প্রিয় নন্দাদেবী। দূরে পাহাড়ের বাঁকে ঋষিগঙ্গা এসে মিলিত হয়েছে ধৌলিগঙ্গায়।

সলদরে পৌঁছে অনুভব করলাম, যোশিমঠের গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা যেন মন্ত্রবলে কমে গিয়েছে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম সুভাই গ্রামে। সুভাই-এর উচ্চতা ৮০৭১ ফুট আর ভবিষ্যবদ্রি মন্দির ৯০০৩ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সুভাই গ্রামেও একটি বদ্রিনারায়ণ মন্দির আছে যেখানে রয়েছে অষ্টম শতাব্দীর একটি বিষ্ণুমূর্তি। কয়েক বছর আগে এই স্থান থেকেই ট্রেক করে পৌঁছতে হতো ভবিষ্যবদ্রি মন্দিরে।

গাড়ি আরও ২ কিমি পথ এগিয়ে এসে থামল। প্রেক্ষাপটে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী, পাইন, দেওদার ও অন্যান্য সরলবর্গীয় উঁচু উঁচু গাছের পাশ দিয়ে সরু পথ এগিয়েছে মন্দির পর্যন্ত। তুষারাবৃত পর্বতরাজি থেকে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। পথের পাশের সবুজ ঘাসজমি ছোট ছোট হলুদ ফুলে ঢাকা। সেই পথ ধরে হেঁটে গিয়ে, শেষে কয়েক ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে আমরা মন্দিরের প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছলাম। গৈরিক বর্ণের প্রবেশদ্বারে লাল ও হলুদ রঙের মালা ঝুলছে– উপরে মন্দিরের পরিচয় ও স্বাগত বার্তা। (চলবে)