• facebook
  • twitter
Saturday, 26 April, 2025

সপ্তবদ্রি ও পঞ্চপ্রয়াগ

‘বদ্রিনাথ’ হলেন ‘বদ্রিক্ষেত্র’-এর নাথ অর্থাৎ সর্বময় কর্তা। বদ্রিনাথ নামের উৎপত্তি হয় ‘বদ্রি’ থেকে যার অর্থ হলো ‘বুনো জাম’। সপ্তবদ্রি পরিক্রমা করতে বেরোলেন শেষাদ্রি শেখর ভট্টাচার্য।

পর্ব – ৩

ডানপাশে, অনেকটা নীচে বয়ে চলেছে কল্পগঙ্গা। বাঁ-পাশে জঙ্গল প্রায় নেই বললেই চলে। নাচতে নাচতে জিপ এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পরে ড্রাইভার জানাল লেয়ারি-তে পৌঁছেছি। কিন্তু চিনতে পারলাম না কিছুই – গত আট বছরে জনপদটি বদলে গিয়েছে অনেকটাই। লেয়ারি থেকে দেবগ্রাম পর্যন্ত রাস্তার বাঁ-পাশে ছিল পাহাড়, ডানপাশে ছিল ঘন জঙ্গল। আজ উধাও সেই জঙ্গল। নতুন রাস্তা হওয়ার ফলে মনে হচ্ছে, পাহাড়টাও যেন একটু দূরে সরে গিয়েছে। জানলাম, এই রাস্তা দেবগ্রামের শেষে একেবারে কল্পেশ্বর মহাদেব মন্দিরের কাছে পৌঁছে গিয়েছে।
কয়েক মিনিট পরে জিপ এসে থামল এক জায়গায়, যেখান থেকে একটি পথ চলে গিয়েছে নীচে পথিক লজের কছে। কুঁয়রসাব তখনই ফোন করলেন রাজেন্দ্রজিকে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজেন্দ্রজির ছেলে ও একজন নেপালি কুলি এসে হাজির হল আমাদের লাগেজ নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমাদের ট্রলি দুটো নেপালি কুলিকে দিলাম, পিঠ-ব্যাগ পিঠেই রইল। ঢালু পথে ধীরে ধীরে নেমে পাঁচ মিনিট পরেই পৌঁছে গেলাম পথিক লজ-এ। বাড়িতে ঢুকেই যে-ব্যাপারটায় আমি একটু আশ্চর্য হ’লাম তা হল, গত ৮ বছরে প্রায় কিছুই পরিবর্তন হয়নি এই লজের। পুরো বাড়িটাই খুব ফাঁকা, নির্জন লাগছে। পোশাক পালটে ঘরের বাইরে আসতেই রাজেন্দ্রজির ছেলে আমাদের জিজ্ঞাসা করে, ‘খানা লগা দুঁ?’
মোহনই উত্তর দেয়, ‘হাঁ, লগা দো লাঞ্চ।’

আমি আর অপেক্ষা না করে তাকে শুধোই, ‘তুমহারা পাপা কঁহা হ্যায়?’ সে উত্তর দেয়, ‘পাপা কাম মে গয়ে হ্যায়। থোড়া দের বাদ হি ওয়াপস আয়েঙ্গে।’

কয়েক মিনিট পরেই ছেলে রান্নাঘর থেকে ফিরে আসে দুই হাতে দুটো থালায় খাবার নিয়ে – ভাত, ডাল ও আলুর তরকারি। অপটু হাতের রান্না দেখেই বুঝলাম, বাড়িতে রাজেন্দ্রজির স্ত্রীও নেই। পেটে খিদে ছিল, তাই অতি সাধারণ রান্নাও খেয়ে নিলাম বিনা বাক্যে।

বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ ধ্যানবদ্রি দর্শন করতে যাব। তাই আমরা ঘরে ঢুকি ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিতে। মাছির উপদ্রব ঠেকানোর জন্য ঘরের জানলায় জাল লাগানো রয়েছে। ক্লান্তি তো ছিলই তাই কখন চোখ লেগে গিয়েছিল জানি না। ঘুম ভাঙতেই ঘড়িতে দেখি বিকেল সোয়া ৪টে। চোখ মুখ ধুয়ে, জল পান করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

কয়েক মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম গ্রামের ছোট্ট শিবমন্দিরে। জুতো বাইরে ছেড়ে, চাতাল পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। গ্রিলের দরজার ফাঁক দিয়ে শিবলিঙ্গের উপর দৃষ্টি ফেলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম– গর্ভগৃহে পরম যত্নে রক্ষিত ও পূজিত প্রস্তরখণ্ডটি অবিকল শ্রীকেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের মতো। পরে জেনেছিলাম, দেবগ্রামের অধিবাসীরা এই মন্দিরকে ‘কেদার মন্দির’ বলেই সম্বোধন করে।

মাটির পথ ছেড়ে উঠে এলাম পাকা রাস্তায়। গ্রামের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে, ঘর-বাড়ির মাঝের সরু পথ দিয়ে প্রায় পাঁচ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম উদ্দিষ্ট মন্দিরের কাছে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেই সিমেন্টে তৈরি চাতাল, যার এক প্রান্তে পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে, শান্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে ধ্যানবদ্রির মন্দির। মন্দিরে প্রবেশ করে প্রত্যক্ষ করলাম কৃষ্ণপাথরে তৈরি চতুর্ভূজ, ধ্যানমগ্ন বিষ্ণুমূর্তি।

অলকনন্দা নদীর তীরে ঊর্গম ভ্যালিতে কল্পেশ্বরের কাছেই ধ্যানবদ্রির অবস্থান। দ্বাদশ শতকে আদি জগৎগুরু শঙ্করাচার্যের তত্বাবধানে ধ্যানবদ্রি মন্দির নির্মিত হয়। মন্দিরের গায়ে সূক্ষ কারুকলা দৃষ্টি কাড়ে অচিরেই। ধ্যানবদ্রি মন্দিরের চতুর্দিকে চারটি পৃথক মন্দির। পশ্চিমে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, পূর্বে কুবেরধারা, উত্তরে ঘণ্টাকর্ণ মন্দির এবং দক্ষিণে চণ্ডিকা মন্দির। ধ্যানবদ্রির উপকথা জড়িয়ে আছে পাণ্ডব বংশীয় রাজা পুরঞ্জয়ের পুত্র ঊর্বঋষির সঙ্গে। তিনি ঊর্গম অঞ্চলে তপস্যা করেন এবং এই বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরে অধিষ্ঠিত চতুর্ভূজ বিষ্ণুদেব রয়েছেন ধ্যান মুদ্রায়। তাঁর দুই হাতে শঙ্খ এবং চক্র। মন্দিরে রয়েছে নরনারায়ণ, কুবের এবং গড়ুর মূর্তি।

ধ্যানবদ্রি দর্শন করে ফিরে এলাম পাকা রাস্তায়। একটা দোকানে বসে চা-বিস্কুট খেলাম। আমরা এবার রাস্তা ধরে প্রায় ৩-৪ কিমি হেঁটে সন্ধে ৬টা ২০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম কল্পগঙ্গার উপর নির্মিত লোহার তৈরি নতুন ব্রিজে। দেখি, মন্দিরের পিছনে সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসা এক ঝরনা ঝরে পড়ছে কল্পগঙ্গায়। দ্রুত পার হ’লাম লোহার তৈরি সেতু– নীচ দিয়ে উত্তাল বেগে ছুটে চলেছে কল্পগঙ্গা।

মন্দিরের বাহির-দ্বারে ঝুলন্ত পিতলের ঘণ্টা বাজালাম তিনবার। কিছুটা এগিয়ে পৌঁছে গেলাম কল্পেশ্বর মন্দিরের কাছে। মূল গুহামন্দিরে প্রবেশের আগে ছাদ-দেওয়া বসার জায়গায় খানিক জিরোই। এরপর গুহাপথেই পৌঁছলাম পাথরে তৈরি শিবমন্দিরে। সেখানে জটারূপী পঞ্চম কেদারের দৈনন্দিন শোধন-কার্য সম্পন্ন করছিলেন পূজারীজি। আমরা ঈশ্বরের চরণামৃত এবং পুজোর ফুল গ্রহণ করলাম। পরমানন্দে মন্দির থেকে বার হয়ে, সেতু পেরিয়ে চলে এলাম পাকা রাস্তায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে ধীরে ধীরে পথ চলে ফিরে এলাম লজে।

আমরা এবার ঘরে ঢুকে ছোট-খাটো কিছু কাজ সেরে নিলাম। রাত ৯টায় প্রকাশের ডাকে আমরা দুজনে বারান্দায় এসে বসলাম ডিনারের জন্য। রাজেন্দ্রজিকে জানালাম, ‘কাল সুবহ ৮ বজে হমলোগ নিকলনা চাহতে হ্যায়। কোই ছোটা গাড়ি মিল সকতা হ্যায়?’ উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কঁহা তক যানা চাহতে হ্যায়?’ আমি বলি, ‘যোশিমঠ তক। উসসে পহলে বৃদ্ধবদ্রি দর্শন করনা হ্যায়।’ রাজেন্দ্রজি বলেন, ‘ছোটা গাড়ি কা ইন্তেজাম হো যায়ে গা। অউর যোশিমঠ যানে সে পহলে আপলোগোঁকো বৃদ্ধবদ্রিকা দর্শন ভি হো জায়েগা।’ তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে খেতে শুরু করি। গরম রুটি, ডাল ও সবজিতে সাদামাঠা খাবার। তবে লাঞ্চের চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক। রাতে হালকা ঠান্ডা। বিছানায় শোবার পর ঘুম আসতে দেরি হল না।

১৯/৫/২০২৪ – বৃদ্ধবদ্রি, যোশিমঠ, নৃসিংহবদ্রি এবং ভবিষ্যবদ্রি দর্শন

সকাল ৬টার আগেই উঠে পড়েছি বিছানা ছেড়ে। ঘর থেকে বাইরে আসতেই দৃষ্টি আটকে গেল সামনের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীতে। অনেক উচ্চতায় পাহাড়ের কোলে একটি দেবালয় দেখে বেশ ভালো লাগল। বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসলাম। কয়েক মিনিট পরেই গরম চা পেয়ে গেলাম। চা পান করে আমরা স্নান সেরে নিলাম। সারাদিনের জন্য তৈরি হয়ে বারান্দার একপাশে লাগেজগুলো রাখলাম। গরম রুটি-সবজিতে প্রাতরাশ সারা হল। দ্বিতীয়বার চা পান করার সময় লজে থাকা-খাওয়ার বিল মিটিয়ে দিলাম। রাজেন্দ্রজি এসে জানালেন, গাড়ি এসে গিয়েছে। অনুরোধ করলেন, তাঁর ছেলে প্রকাশকে সঙ্গে নিয়ে যেতে যোশিমঠ পর্যন্ত– সেখানে তার কিছু কাজ আছে। সানন্দেই রাজি হলাম আমরা। রাজেন্দ্রজিকে বিদায় জানিয়ে লজের বাইরে চলে এলাম। কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ে গ্রামের ছোট্ট শিবমন্দির। মহাদেবকে প্রণাম জানিয়ে পৌঁছে গেলাম পাকা রাস্তায়। আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সাদা অল্টোর কাছে। ট্রলিদুটো গাড়ির ছাদে বাঁধা হল, আমরা বসলাম পিছনের সিটে। গাড়ি ছাড়ল ঠিক সকাল ৮টায়।

দেবগ্রাম ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। সপ্তবদ্রি পরিক্রমার সঙ্গে পঞ্চপ্রয়াগও আছে – তাই যাত্রায় আলস্যের অবকাশ কম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলাম লেয়ারি। এখন বাঁ-পাশে, অনেক নীচে কল্পগঙ্গা বয়ে চলেছে। গাড়িতে চেপে যাচ্ছি বৃদ্ধবদ্রি দর্শনে। সেখান থেকে যাব যোশিমঠ। গাড়ি ভাড়া ২০০০ টাকা– একটু বেশি হলেও আমরা নিরুপায়।

গাড়ি ধীরে ধীরে, লাফাতে লাফাতে চলেছে। স্থানীয় ড্রাইভার বিনোদ সিং-এর হাতে স্টিয়ারিং। চামোলি জেলার অ্যানিমঠে বৃদ্ধবদ্রির অবস্থান, যা বদ্রিক্ষেত্রের পঞ্চম তথা ‘সপ্তবদ্রি’-র অন্যতম।
(চলবে)