• facebook
  • twitter
Sunday, 27 April, 2025

সপ্তবদ্রি ও পঞ্চপ্রয়াগ

ভগবান বিষ্ণুর অবস্থান অলকনন্দা নদীর উপত্যকায়, যার শুরু উত্তরে বদ্রিনাথ থেকে ২৪ কিমি দূরে অবস্থিত শতোপন্থে এবং তার বিস্তৃতি দক্ষিণে নন্দপ্রয়াগ পর্যন্ত। এটি ‘বদ্রিক্ষেত্র’ নামে পরিচিত। লিখছেন শেষাদ্রি শেখর ভট্টাচার্য।

আদিবদ্রি, ধ্যানবদ্রি ও কল্পেশ্বর মহাদেব দর্শন

ভোর সাড়ে ৫টায় উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আমরা উমাপতি মহাদেব এবং গঙ্গা মা-কে প্রণাম জানিয়ে নেমে এলাম সঙ্গম-ঘাটে। স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝে পূণ্য প্রয়াগের জল নিয়ে মাথায় ছোঁয়ালাম। চারিদিকের দৃশ্য অতি মনোরম– দূর থেকেই কর্ণমন্দিরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। এবার ধীরে ধীরে উঠে এলাম রাস্তায়। চা-বিস্কুট খেয়ে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে নিলাম। সারাদিনের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। পরপর দুটো পুল পেরিয়ে চলে এলাম বাস-স্ট্যান্ডে। দেখি, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আদিবদ্রি যাওয়ার খালি বাস। বাস ছাড়বে সকাল ৮টায়। ফলে হাতে সময় আছে প্রাতরাশ সেরে নেবার জন্য। আমাদের সঙ্গে এখন কোনও লাগেজ নেই, তাই বাসে উঠে দু’জনেই জানলার পাশে আসন নিলাম। বাস ছাড়ল যথাসময়ে।

এই প্রসঙ্গে ‘বদ্রিক্ষেত্র’ বা বিষ্ণুধাম সম্পর্কে কিছু কথা জানিয়ে রাখি। ভগবান বিষ্ণুর অবস্থান অলকনন্দা নদীর উপত্যকায়, যার শুরু উত্তরে বদ্রিনাথ থেকে ২৪ কিমি দূরে অবস্থিত শতোপন্থে এবং তার বিস্তৃতি দক্ষিণে নন্দপ্রয়াগ পর্যন্ত। এটিই ‘বদ্রিক্ষেত্র’ নামে পরিচিত। সপ্তবদ্রি মন্দিরের পাঁচটি মন্দির এই বদ্রিক্ষেত্রের অন্তর্গত। তাই সেই পাঁচটি মন্দিরকে পৃথকভাবে ‘পঞ্চবদ্রি’ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। এই পাঁচটি বদ্রি হল বদ্রিবিশাল, আদিবদ্রি, ভবিষ্যবদ্রি, যোগবদ্রি এবং বৃদ্ধবদ্রি। সপ্তবদ্রি পরিক্রমা করতে হলে পঞ্চবদ্রির সঙ্গে ধ্যানবদ্রি এবং নৃসিংহবদ্রি অথবা অর্ধবদ্রিও দর্শন করতে হয়।

বদ্রিনাথ হলেন ‘বদ্রিক্ষেত্র’-এর নাথ অর্থাৎ সর্বময় কর্তা। বদ্রিনাথ নামের উৎপত্তি হয় ‘বদ্রি’ থেকে যার অর্থ হলো বুনো জাম। ভগবান বিষ্ণু যখন এই সুন্দর, শান্ত পর্বতমালায় ধ্যান করতে বসেন, তখন তাঁর পত্নী লক্ষ্ণীদেবী বুনো জাম গাছের আকার ধারণ করেন এবং ভগবান বিষ্ণুকে ছায়া এবং নিরাপত্তা দান করেন। পূরাণকথা অনুসারে, ভগবান বিষ্ণু কলিযুগে বদ্রিনাথে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপরযুগে, এই আদিবদ্রিতে বাস করতেন। শীতকালে যখন তুষারপাতের কারণে বদ্রিনাথ যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেত, তীর্থযাত্রীরা বিষ্ণুদেবের পূজা করতেন আদিবদ্রিতেই। সপ্তবদ্রির মধ্যে প্রাচীনতম মনে করা হয় এই আদিবদ্রিকে।

কর্ণপ্রয়াগ থেকে আদিবদ্রির দূরত্ব ১৮ কিমি। বাস ভাড়া মাথাপিছু ৫৫ টাকা। মোটামুটি সমতল রাস্তা। মিনিট কুড়ি পরে একটি ছোট শহরতলিতে এসে পৌঁছল বাস। কয়েকটি ঘরবাড়ি, দোকান নিয়ে শান্ত জায়গাটির নাম সিমলি। বাস থেকে নামল দু-এক জন, বাসে উঠলও কয়েকজন। পথের দু’পাশেই কাছে-দূরে চোখে পড়ছে বেগুনি ফুলের গুলমোহর গাছ। সরু পথের দু’পাশে পাহাড় আর মাঝে মাঝে একেবারে ধারালো হেয়ার পিন বেন্ড।

বাস পৌঁছল ছোট্ট গ্রাম ভাটুলিতে আর তার কিছুক্ষণ পরেই দাঁড়াল ‘চাঁদপুর গড়ি’ স্টপে। ডানদিকে তাকালে কিছু দূরে, একটি উচ্চতর স্থানে প্রাচীন দূর্গের ধ্বংসাবশেষের কিছুটা অংশ দৃশ্যমান হয়। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় অবস্থিত, পাওয়ার রাজবংশের রাজা কনকপালের রাজত্বকালে (সম্ভবত অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মাঝে) এই অসাধারণ দুর্গটি স্থাপিত হয়েছিল। আদিবদ্রি এখান থেকে আরও সাড়ে তিন কিমি। বাস যাবে আরও দূরে। তালগ্রাম পেরিয়ে বাস এনএইচ-১০৯ (কর্ণপ্রয়াগ-নৈনিতাল রোড)-এর পাশে অবস্থিত আদিবদ্রির কাছে এসে থামল সকাল পৌনে ৯টায়।

বাস থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়েই পৌঁছে গেলাম এএসআই দ্বারা সংরক্ষিত এক সুন্দর মন্দির কমপ্লেক্স-এর কাছে। রাস্তার পাশ থেকে কয়েকটি সিঁড়ি পেরিয়ে উঠে এলাম সামান্য উচ্চতা বিশিষ্ট একটি ঢিবির উপর। সেখানে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন শৈলীতে তৈরি এবং বিভিন্ন দেবদেবীকে উৎসর্গীকৃত ১৪টি ছোট-বড় মন্দির (বাকি ২টি মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত)। প্রথমেই চলে এলাম নারায়ণ মন্দিরের কাছে। দেখি, মন্দিরের ভিতরে প্রায় তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট, কৃষ্ণবর্ণের পাথরে নির্মিত অপূর্ব সুন্দর এক বিষ্ণুমূর্তি। যেন এক অজানা ভালোলাগায় মন ভরে গেল। ভগবান বিষ্ণুকে প্রণাম জানিয়ে আমরা একে একে দর্শন করলাম শিব মন্দির, গৌরীশঙ্কর মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, গণেশ মন্দির, চক্রভান মন্দির এবং গরুড় মন্দির। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে, পরপর দেখে নিলাম রাম-লক্ষণ-সীতা মন্দির, জানকী মন্দির, হনুমান মন্দির, কালী মন্দির এবং কুবের মন্দির।

মন্দির কমপ্লেক্সের নীচে রাস্তার পাশেই দোকানে বসে, কর্ণপ্রয়াগে ফিরে যাওয়ার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কয়েক মিনিট পরেই বাস এসে গেল এবং আমরাও বাসে উঠে পড়লাম। প্রথমে ভাটুলি, তারপর একে একে পেরিয়ে গেলাম সিরোলি ও সিমলি। এখানে কয়েকজন যাত্রী নেমে গেলেন। আরও কিছুক্ষণ পর পেরোলাম পাডলি ও জাখের।

কর্ণপ্রয়াগে বাস এসে থামল সকাল সোয়া ১০টায়। বাস থেকে নেমে পরপর দুটি পুল পেরিয়ে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। ঘরে দ্রুত স্নান সেরে নিলাম। লাগেজ গোছানোই ছিল। সময় নষ্ট না করে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে বাস-স্টপে এসে দাঁড়ালাম। আমরা যাব হেলাং এবং সেখান থেকে দেবগ্রামে।

চারধাম যাত্রার প্রবল ভিড় অব্যাহত। হরিদ্বার বা ঋষিকেশ থেকে আগত যাত্রীবোঝাই আরক্ষিত প্রাইভেট বাসগুলো কর্ণপ্রয়াগ স্টপে দাঁড়ালই না। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চড়া-রোদে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু অন্য বাসের দেখা নেই। গাড়ি রিজার্ভ করে চামোলি পর্যন্ত যাওয়া যায় কিন্তু যে-ভাড়া চাইছে, তা শুনে মাথা ঘুরে গিয়েছে। এইসব বিশৃঙ্খলা চারধাম যাত্রা-র কারণেই। হতাশ না হয়ে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই বনবিভাগের একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। ড্রাইভার জানলা থেকে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাঁহা যানা হ্যায়?’
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিই, ‘হেলাং তক যানা হ্যায়।’
তিনি বলেন, ‘ম্যায় চামোলি তক যাউঙ্গা। উঁহাসে গাড়ি মিল যায়েগি হেলাং যানে কে লিয়ে।’
আমি তখনই বলি, ‘চলিয়ে, হামলোগ যায়েঙ্গে চামোলি তক।’

তখনই মাহিন্দ্রা গাড়ির পিছনের অংশে লাগেজ চাপিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ি। গাড়িও চলতে শুরু করে। সামান্য খরচে আরামদায়ক যাত্রায় আমরা চামোলি এসে পৌঁছলাম বেলা ১২টা নাগাদ। গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে, কিছুদূর এগিয়েই পৌঁছে গেলাম কার- স্ট্যান্ডে। সেখান থেকেই যোশিমঠ ও হেলাং যাওয়ার গাড়ি ছাড়ছে। একটা গাড়ির খালাসি আমার কাছে জানতে চাইল, আমরা কোথায় যেতে চাই। তাকে বললাম, দেবগ্রামে যাব। সৌভাগ্যক্রমে, পাশে তিনজন যুবক দাঁড়িয়েছিল যারা দেবগ্রামেই যেতে চায়। তখনই একটি বোলেরোতে আমাদের দেবগ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। পাঁচজন উঠে বসলাম গাড়িতে। আমরা মাথাপিছু ৫০০ টাকা করে দিতেই ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল।

মোহন বসেছে ড্রাইভারের পাশে। সওয়ারি তিন মালিয়ালি যুবকের একজন বসেছে মাঝের সিটে আমার পাশে, বাকি দু’জন পিছনের সিটে। তাদের সঙ্গে আলাপে জানলাম, দেরাদুনে তারা সমাজ বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো করছে। বহুজনের কাছে দেবগ্রামের কথা শুনে তারা সেখানে চলেছে টেন্ট নিয়ে। তাদের ইচ্ছে, প্রকৃতির কোলে তাঁবু খাটিয়ে কয়েক দিন থাকা। মনে পড়ল, ২০১৬-র অক্টোবরে কীভাবে দিনের শেষ জিপে আমরা তিন বন্ধু হেলাং থেকে লেয়ারি পৌঁছেছিলাম। তারপর সেই অন্ধকার সন্ধ্যায় এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় আমরা দুই কিমি হেঁটে পৌঁছেছিলাম দেবগ্রামের ‘পথিক লজ’-এ। এবারেও আমরা সেই লজে থাকব– আসার আগে লজের মালিকের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি ফোনে।

হেলাং মোড়ে এসে পৌঁছলাম দুপুর ১টা নাগাদ। কালের নিয়মে সেদিনের শান্ত হেলাং আজ এক ব্যস্ত জনপদ। গাড়ি বাঁদিকের রাস্তায় ঢুকে পড়ল। কথায় কথায় জানতে পারলাম, ড্রাইভারের বাড়ি দেবগ্রামেই এবং তাঁর নাম বদ্রি কুঁয়র নেগি। তিনি এবার আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপলোগ গাঁও মে কঁহা ঠহরেঙ্গে?’
মোহন আমার দিকে তাকায় । আমি উত্তর দিই, ‘পথিক লজ মে।’
কুঁয়র আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘রাজেন্দ্র নেগি কা ঘর মে?’
আমি বলি, ‘জি হাঁ।’
তিনি খুশি হয়ে বলেন, ‘রাজেন্দ্রজি মেরা দোস্ত হ্যায়। চলিয়ে, ম্যায় আপ দোনো কো উনকা ঘরকে পাস ছোড় দুঙ্গা।’
খুশিতে মোহন বলে, ‘শুক্রিয়া জি।’

ঠিক তখনই রাজেন্দ্র সিং নেগি-র ফোন আসে। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা এখন কোথায় এবং লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রাখবেন কিনা। মোহনের সম্মতি নিয়ে রাজেন্দ্রজিকে জানাই, আমরা এখন হেলাং থেকে দেবগ্রাম চলেছি এবং আমাদের জন্য অবশ্যই লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রাখতে।

হেলাং থেকে লেয়ারি যাবার রাস্তা খুবই খারাপ, ভাঙাচোরা। মনে পড়ে, ২০১৬-তেও রাস্তা একই রকম খারাপ ছিল। পরে একই রকম অবস্থা দেখলাম যোশিমঠ থেকে ভবিষ্যবদ্রি যাবার পথে– সেখানেও তপোবন থেকে সুভাই গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা বেশ খারাপ, বছরের পর বছর ধরে। উভয়ক্ষেত্রেই প্রধান কারণ একই, অসৎ উপায়ে তৈরি হওয়া খারাপ রাস্তা। (ক্রমশ)