• facebook
  • twitter
Thursday, 26 December, 2024

পাটনা To পাওয়াপুরি

আজকের পাটনা সংলগ্ন বিহার একসময় পরিচিত ছিল মগধ নামে। মগধের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। রাজগীর ছিল মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানী। বর্তমানে ব্যাপক বদলে গেছে পাটনা শহরের ছবি। এই পাটনা শহরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে রয়েছে তিনটি পর্যটনভূমি-- রাজগীর, নালন্দা ও পাওয়াপুরি। ঘুরে এলেন সুমিত সেনগুপ্ত।

শীতে অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসই হল পাটনা, রাজগীর এবং বোধগয়া অঞ্চল ভ্রমনের জন্য সঠিক সময়। নভেম্বরে হালকা ঠান্ডা থাকে। হাফ সোয়েটারে সাধারণত কাজ চলে যায়। ডিসেম্বরে অবশ্যই ফুল সোয়েটারে বা ফুল জ্যাকেট চাই। বিহারের ঠান্ডা কলকাতার তুলনায় শুষ্ক। কনকনে নয়, হিমশীতলও নয়, গায়ে ঠান্ডা বাতাসের স্নিগ্ধ ছোঁয়া লাগে।

ব্যাপক বদলে গেছে পাটনা শহরের ছবি। একাধিক ফ্লাই ওভারের সঙ্গে ঝুলিতে ভরেছে অবকাশ যাপন ও বিনোদনের মনভরানো জায়গা। গড়ে উঠেছে ভালো ভালো হোটেল। যাতায়াতে গতি বেড়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট হয়েছে। পর্যটনের দিক দিয়ে নানাভাবে শহরকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।

ধার্মিক দৃষ্টিকোণে পাটনা, রাজগীর ও পাওয়াপুরি যথাক্রমে শিখ ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য মহত্বপূর্ণ ধর্মীয় এক তীর্থক্ষেত্র। পুরনো পাটনা বা পাটনা সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন শিখ ধর্মের দশমগুরু, গুরু গোবিন্দ সিং। এই পাটনা শহরেই আছে শিখ ধর্মাম্বলীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ গুরুদ্বার হরমিন্দর সাহিব বা পাটনা সাহিব।

পাটনা শহর সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই আসে গোলঘর প্রসঙ্গ। পাটনা শহরের কেন্দ্রস্থলে গান্ধী ময়দানের পশ্চিম দিকে এটি অবস্থিত। ১৭৭০-এর মন্বন্তরের পরে ১৭৮৬ শতাব্দীতে তৈরি হয় এই গোলঘর।

এটি একটি বৃহৎ খাদ্য ভাণ্ডার। এর গায়ে লাগানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে পাটনা শহর দর্শন হয় পাখির চোখে। এখন এটি একটি পুরনো স্থাপত্যশিল্প ও বাস্তুকলার নিদর্শন মাত্র।

পাটনা শহর সমান্তরালভাবে দাঁড়িয়ে আছে গঙ্গানদীর কিনারে। এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে পূর্বপ্রান্ত গাইঘাট থেকে পশ্চিমপ্রান্তে দানাপুর পর্যন্ত, মুম্বাই শহরের মেরিন ড্রাইভের অনুকরণে ‘পাটনা মেরিন ড্রাইভ’। আজকাল অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে পাটনায় সবচেয়ে বেশি ফুটফল হচ্ছে এখানে।

তৈরি হয়েছে দুটি বড় মিউজিয়াম। একটি পাটনা জংশন রেল স্টেশনের কাছে ভগবান বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের ঊপর স্মারক মিউজিয়াম ‘বৌদ্ধ স্মৃতি পার্ক’। ভগবান বুদ্ধের অনেক স্মারক স্মৃতি ছাড়াও, ২০০ ফিট উঁচু পাটলিপুত্র করুণা স্তুপ আর সযত্নে রাখা হয়েছে ভগবান বুদ্ধের অস্থির অংশ। পর্যটকদের নজর কাড়তে অতি আধুনিক স্থাপত্যে তৈরি বিহার মিউজিয়াম নামের দ্বিতীয় মিউজিয়ামটি, তৈরি হয়েছে বেলি রোডের উপর বোরিং রোডের সংযোগস্থলে। এছাড়া এর কাছাকাছি বুদ্ধ মার্গ অঞ্চলে আছে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্মারক সমৃদ্ধ পাটনা মিউজিয়াম। পরিবার নিয়ে সারাদিনের জন্য পিকনিক উদযাপন করার জন্য, পাটনা সেক্রেটারিয়েটের পিছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে ইকো পার্ক বা রাজধানী বাটিকা। এতে রোয়িং এবং স্কেটিং করতে পারবেন। আছে রোমহর্ষক জিপ লাইন অর্থাৎ দড়িতে ঝুলে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া।

দর্শনীয় স্থান হিসেবে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার আদলে তৈরি হয়েছে, গঙ্গার তীরে গান্ধী ময়দানের উত্তর দিকে, ‘গেটওয়ে অফ পাটনা’ বা সভ্যতাদ্বার। পাটনা স্টেশন পরিসরের ঠিক পাশেই আছে বিখ্যাত

হনুমান মন্দির। এই মন্দিরে প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত, বজরংবলির পুজো দেন । এবার বেরিয়ে পড়ুন পাটনা থেকে বাইরে। ৯০ থেকে ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে আছে অনেক ঘোরার জায়গা। পাটনা শহরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে আছে তিনটি পর্যটনভূমি – রাজগীর, নালন্দা ও পাওয়াপুরি। রাজগীরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে যাবেন নালন্দা ও পাওয়াপুরি। আপনি পাটনা জংশন স্টেশন থেকে ট্রেনে আসতে পারেন রাজগীর। এর থেকে সুবিধাজনক ও দ্রুত উপায় সড়কযোগে আসা। পাটনা থেকে সোজা রাজগীর আসতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। রাজগীরে থাকার জন্য আছে ছোট বড় অনেক হোটেল। এর বেশির ভাগ রাজগীর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।

রাজগীর শহর থেকে বেরিয়ে পর্যটন পরিসীমায় প্রবেশ করতেই, প্রথমে পাবেন প্রধান সড়কের পাশে রাজগীর উষ্ণ প্রস্রবন। এখানে একটি জলাধারে গড়িয়ে এসে পড়ছে উষ্ণ জল। কথিত আছে এই জলে স্নান করলে অনেক রোগ থেকে উপসম হয়।

রাজগীরের সঙ্গে জড়িত আছে ইতিহাসের দুই রাজার নাম। একজন মহাভারতে বর্ণিত রাজা জরাসন্ধ। তখন আজকের পাটনা সংলগ্ন বিহার, পরিচিত ছিল মগধ নামে। আর এই মগধের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। সেই সময় রাজগীর ছিল জরাসন্ধের মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানী। দ্বিতীয় ব্যক্তি বৌদ্ধ যুগের ভগবান বুদ্ধের অনুগত শিষ্য রাজা বিম্বিসার। রাজা বিম্বিসারের সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই রাজগীর।

পর্যটন পরিসীমায় দ্বিতীয় দর্শনস্থল বেণুবন। রাজা বিম্বিসার ভগবান বুদ্ধকে নির্জনে ধ্যান করার জন্য ও শিষ্যদের মধ্যে তার বাণীর প্রচারের জন্য একটি পুকুরকে বেষ্টনী করে, বাঁশগাছ ঘেরা শান্তি সমৃদ্ধ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেন । বেণুবনের কাছে আছে দর্শনস্থল, বীরায়াতন মিউজিয়াম। আর একটু এগোলে পাবেন জাপান সরকার দ্বারা নির্মিত জাপানী বৌদ্ধ মন্দির।

এরপরে যেগুলো দেখবেন, তার মধ্যে আছে বৃহৎ পাথর দিয়ে তৈরি জরাসন্ধের কুস্তির আখড়া। রাজধানী রাজগীরকে শত্রুর থেকে সুরক্ষিত রাখতে চিনের প্রাচীরের মতো চল্লিশ কিমি ব্যাপি, বড় বড় পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে রাজা জরাসন্ধ রাজগীরকে ঘিরে দেয়াল তুলেছিলেন। প্রাচীরের কারিগরি প্রযুক্তি দর্শনীয়। একটি পাথরের সঙ্গে আরেকটি পাথরকে জুড়তে কোনও সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ ব্যবহৃত হয়নি। ইংরেজিতে এর নাম সাইক্লোপিয়ন ওয়াল। এটি ইউনিসকো দ্বারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।

রাজা বিম্বিসারকে সিংহাসনচ্যূত করে রাজা হন তার কনিষ্ঠ পুত্র অজাতশত্রু। তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্ম বিরোধী। ঔরঙ্গজেবের মতো পিতাকে এক কয়েদখানায় বন্দি করেছিলেন তিনি। বিম্বিসার জেল তাই এক দর্শনীয় স্থল। এছাড়াও দেখবেন অজাতশত্রু ফোর্ট, স্বর্ণ ভাণ্ডার, রথের চাকা বসে যাওয়া সম্পূর্ণ পাথুরে রাস্তা, বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের মিউজিয়াম।

এরপর আসুন রত্নাগিরি পর্বতে চারশো মিটার উঁচুতে অবস্থিত, বিখ্যাত রাজগীর বিশ্ব শান্তিস্তুপ দেখতে। এখানে বুদ্ধের একটি মন্দির আছে। এটা মূলত মেডিটেশন বা ধ্যান করার জন্য তৈরি হয়েছে। এখানে পৌঁছলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। রাজগীর শহরে দেশবিদেশ থেকে পর্যটক আসেন। রাজগীরের মুকুটে উঠেছে এক নতুন পালক, রাজগীর সাফারি পার্ক। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তৈরি এই পার্কের মূলত দুটি ভাগ। একটি ভাগে আছে প্রাকৃতিক পরিবেশে দৃষ্টিনন্দন স্বর্ণগিরি এবং বৈভবগিরি উপত্যকার উপর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র। আরেকটি ভাগে তৈরি করা হয়েছে প্রকৃতি ও প্রযুক্তির রোমহর্ষক অনুভূতির নানা উপাদান। এই পার্কটির জন্য রাখুন পুরো একটি দিন।

এছাড়াও রাজগীরে পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থল হল ঘোড়া কাটোরা লেক, পান্ডু পোখার ইকো অ্যাডভেঞ্চার রেসর্ট, গৃদ্ধকূট পর্বত শিখর ইত্যাদি।

একদিন রাখতে হবে নালন্দা ও পাওয়াপুরি ভ্রমণের জন্য। রাজগীর থেকে মাত্র ১৫ কিমি দুরে পৌরাণিক নালন্দা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এখানে অবশ্যই একজন গাইড নেবেন। নিষ্ঠা ও অনুশাসনে ভরা এক পৌরাণিক সভ্যতা, যার আধার ছিল বৌদ্ধ বিচারধারা। এখানে একসময় পদধূলি পড়েছিল পৃথিবী বিখ্যাত নানা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের।

নালন্দা থেকে পরবর্তী গন্তব্যস্থল পাওয়াপুরি। পাওয়াপুরি জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এখানে আছে বিখ্যাত জৈন জলমন্দির। পাওয়াপুরিতে জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ভগবান মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন, ধর্ম প্রচার করেন এবং তাঁর দেহাবসান ও পাওয়াপুরিতেই হয়। নালন্দা থেকে পাওয়াপুরির দূরত্ব ১৫ কিমি। একটি বিশাল আকারের পুকুরের কেন্দ্রস্থলে মন্দিরটি অবস্থিত।

এখান থেকে গয়ার দূরত্ব ৬০ কিমি। গয়া থেকে বোধগয়ার দুরত্ব ১৫ কিমি। উল্লেখ্য বোধগয়া বৌদ্বধর্মাম্বলীদের তীর্থক্ষেত্র। মহাভারতে বর্ণিত নিরঞ্জন বা নিলাঞ্জন নদীর (এখন ফল্গু নদী) অনতিদূরে অশ্বথগাছের তলায়, বুদ্ধদেব সিদ্ধিলাভ করেন। গাছটি বোধিবৃক্ষ নামে বিখ্যাত হয়। সম্রাট অশোক এখানে মহাবোধি বৌদ্ধমন্দির নির্মাণ করে। দেশবিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক আসেন এখানে। জাপান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড,ভুটান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সরকার দ্বারা নির্মিত দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধমন্দির আছে। বোধগয়ায় ভালো ভালো অনেক হোটেল ও আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর আছে।

কলকাতা ও হাওড়া থেকে প্রচুর সুপার ফাস্ট ট্রেন আছে রাজধানী এক্সপ্রেস ভায়া কর্ড, আছে কালকা মেল,পূর্বা এক্সপ্রেস ভায়া কর্ড, হাওড়া গয়া এক্সপ্রেস, দুন এক্সপ্রেস ইত্যাদি।