সুনীতা দাস
বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তার পক্ষে সর্বত্র বিরাজমান থাকা সম্ভব নয় বলেই তাঁর আরেক রূপ মায়ের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তার প্রতিটি সৃষ্টির যত্ন-রক্ষা হতে পারে।’ সন্তানের প্রয়োজনে মা তার সন্তানের জন্য সেই সৃষ্টিকর্তার সঙ্গেও যুদ্ধে প্রস্তুত। সেই মা-এর স্মরণ দিবস আজ। মা শুধু তো মা নয় সে যেমন মেয়ে, বোন, স্ত্রীও। তবে সবার মধ্যেই একজন মা উপস্থিত। মা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন নিজের সন্তানকে সব বাধা-দুঃখ-কোস্ট থেকে দূরে রাখতে চায়। নিজে শত বিপদে থাকলেও সন্তানকে গোটা পৃথিবীর বিপদ থেকে বাঁচাতে নিজের আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখে। সে আঁচল শত ছিদ্র হলেও সেই সন্তানের কাছে বিপদ ঘেঁষতে শতবার ভাবে যার সামনে মাতৃত্বের ঢাল হাতে মা দাঁড়িয়ে থাকে।
আচ্ছা বলুন তো আমার সন্তানটি দুধে-ভাতে থাকুক কোন মা না চায় ? তাই তো বলা হয় ‘মাতা কুমাতা কভু নহে’। যদিও বর্তমান পৃথিবীতে কুমাতার উদাহরণ যে পাওয়া যাবে না তা নয় তবুও তা কিঞ্চিৎ মাত্রা। সেই কুমাতার সংখ্যা যৎসামান্য ধূলিকণা সমান। পৃথিবীর সেই মহান মায়েদের কাছে এক ফুৎকারে উড়ে হারিয়ে যেতে পারে। মা যেখানেই থাকুক সন্তান তার সবার আগে। স্বর্গে যাক বা নরকে এক মায়ের কাছ থেকে যদি তার সন্তানকে কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে তার ব্যথা কারুর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আজ ১২ মে, মাতৃত্ব উদযাপনের দিনে সেই মায়েদের স্মরণ করি যারা অপরাধে বা নিরাপরাধে গারোদের পেছনে থেকে নিজের নাড়ি ছেড়া ধনদের দেখে কাঁদে। না হয় জানুন তাদের ব্যথার কথাই।
ধরুন যদি একজন মাকে জিজ্ঞেস করা হয় আপনার সন্তানকে ভবিষ্যতে কি রূপে দেখতে চান, বেশিরভাগ মায়ের উত্তর হবে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত-সন্মানীয় ব্যক্তি । কিন্তু জানেন কি বীনা, রৌশান, তারা, কবিতা, আমিনার মত মায়েদের কাছে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তাদের সন্তানদের তারা কিভাবে দেখতে চান? তাদের উত্তর, ‘আমাদের ছায়া থেকে দূরে, মুক্ত জগতে, দুবেলা পেটপুরে খেতে পাবে এমন পৃথিবীতে।’ শুনে ভাবছেন এ কেমন ও উত্তর? মা কখনো তার সন্তানকে নিজের থেকে দূরে রাখতে চায় ? সত্যি বলতে এরা চায়। সন্তানকে নিজের নয় নিজের পরিবেশ থেকে দূরে পাঠাতেই এদের এই আকুতি। এরা যে প্রত্যেকে দেশ-বিদেশের নানা কারাগারে বন্দি।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো অনুসারে গোটা দেশের বিভিন্ন জেলে বর্তমানে 19,913 জন মহিলা বন্দী রয়েছেন। তাদের মধ্যে 8 শতাংশের সঙ্গে আবার 1,779 জন শিশু রয়েছে। এনসিআরবির হিসেবে মহিলারা কারাগারের জনসংখ্যার মাত্র 4%। জেলে থাকা মহিলাদের মধ্যে সবথেকে দৈনন্দিন অবস্থা সন্তান সহ বন্দিজীবন কাটানো মহিলাদের। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মহিলাই প্রায়ই তাদের সন্তানদের জন্য উপযুক্ত খাবার পেতে লড়াই করেন। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন জেলে বন্দি নারীদের সংখ্যা 740,000। হেলেন ফেয়ার এবং রয় ওয়ালমসলি দ্বারা বিশ্ব মহিলা কারাবন্দি তালিকার পঞ্চম সংস্করণের সূত্র অনুযায়ী কোভিডের পর মহিলা বন্দির সংখ্যা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে জেলগুলিতে।
সূত্র বলছে ২০০০ বছর থেকে কারাগারের বন্দি মায়েদের সংখ্যা পুরুষ বন্দির তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে । হিসেবে বলছে এই সংখ্যা 60%। সেই তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় 22% ।
তবে সন্তান সহ বা সন্তানহীন মহিলা বন্দির দিক থেকে ভারত তুলনামূলক ভাবে বিশ্বে একটু ভালো অবস্থানেই আছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কবেকের ইনস্টিটিউট ফর ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিস পলিসি রিসার্চ (আইসিপিআর) দ্বারা প্রকাশিত আরেক তালিকা বলছে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশে যত নারী বন্দীদের সংখ্যা রয়েছে তাদের মধ্যে 200,000 এরও বেশি মহিলা বন্দী রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর চিন 145,000জন, ব্রাজিল 42,694 জন, রাশিয়া 39,120 এবং থাইল্যান্ড 32,952 জন।এদের মধ্যে আনুমানিক 19,000 শিশু তাদের পিতামাতার সাথে কারাগারে থাকতে বাধ্য। ভারত হোক বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে জেলে সন্তান সহ বন্দি মায়েদের অবস্থা প্রায় একই।
তবে সন্তান সহ বা সন্তানহীন মহিলা বন্দির দিক থেকে ভারত তুলনামূলক ভাবে বিশ্বে একটু ভালো অবস্থানেই আছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কবেকের ইনস্টিটিউট ফর ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিস পলিসি রিসার্চ (আইসিপিআর) দ্বারা প্রকাশিত আরেক তালিকা বলছে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশে যত নারী বন্দীদের সংখ্যা রয়েছে তাদের মধ্যে 200,000 এরও বেশি মহিলা বন্দী রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর চিন 145,000জন, ব্রাজিল 42,694 জন, রাশিয়া 39,120 এবং থাইল্যান্ড 32,952 জন।এদের মধ্যে আনুমানিক 19,000 শিশু তাদের পিতামাতার সাথে কারাগারে থাকতে বাধ্য। ভারত হোক বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে জেলে সন্তান সহ বন্দি মায়েদের অবস্থা প্রায় একই।
যদিও ভারতের নিরিখে আমেরিকা বা রাশিয়ার মত দেশগুলিতে জেলে মানুষ হওয়া শিশুরা একটু আলাদা ভাবে বাঁচার সুযোগ পায়। যেটা ভারতে প্রায় নায়ের সমান। এই প্রসঙ্গে মনোবিদ দেবদত্তা রায় বলেন, ‘যে সমস্ত শিশুরা মায়েদের সঙ্গে জেলে জীবনের কিছু সময় কাটায় তাদের ঠিকমত মানসিক বা শারীরিক বৃদ্ধি হয় না। জেলে তো আর তাদের আশেপাশে সবাই মুনি ঋষিই হবেন না। সেই গ্যারেন্টি কোনো সরকার বা জেল কর্তপক্ষই দিতে পারে না তাই তারা ভালোর থেকে খারাপ শেখে বেশি।’
খুন, চুরি বা কাঁটাতারের বেড়া টপকানো, যে দোষেই বন্দি হোক না কেন একজন মহিলার ওপর তার প্রভাব পুরুষদের তুলনায় সবথেকে বেশি। আর তার সঙ্গে যদি সন্তান থাকে তাহলে তার অবস্থা ভাবুন।
৪২ বছরের বীনা নিজের স্বামীকে হত্যার অভিযোগে তিহার জেলে বিচারাধীন বন্দি ছিল ২০১৮ থেকে। মঙ্গলপুরির বাসিন্দা বীনার সঙ্গে তখন তার ৯ মাসের মেয়ে। আর কেউ না থাকায় ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সন্তানের ৬ বছর না হওয়া পর্যন্ত বিচারাধীন বা সাজাপ্রাপ্ত মায়ের সঙ্গে সন্তানকে রাখা হয়। তাই বীণার সঙ্গে তার মেয়েকেও জেলের সেই কুঠরিতেই মাসের পর মাস কাটাতে হয়। বর্তমানে জেলমুক্ত বীনা তার ছয়বছরের মেয়ের সঙ্গে একটি গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের দোকানের কর্মী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাপের-শ্বশুরের দুই বাড়ির দরজাই তার কাছে বন্ধ হয়ে যায়। শেষে অনেক কষ্টে এই কাজ। কিন্তু জেলে থাকাকালীন সন্তানের অবস্থা মনে করতে গিয়ে জলে ঝাপসা হয়ে ওঠা চোখে জানালেন, কোনো শত্রুকেও যেন তার সন্তানের সঙ্গে জেলে না থাকতে হয়।
আশার বয়েস 34। দিল্লির রোহিণীর বাসিন্দা আশাও সেই 2018 সাল থেকে হরিয়ানার গুরুগ্রাম জেলা কারাগারে নয় বছর ধরে বন্দি ছিলেন। 2009 সালে যখন তার মেয়ে জেলে জন্মগ্রহণ করে, তার সাজার পাঁচ মাস, “গুরুগ্রাম জেলের ভিতরে গর্ভবতী মহিলা এবং শিশুদের জন্য খুব কমই কোন সুযোগ-সুবিধা ছিল”। আশা বলেছিলেন নিজের ছেলেটির জন্য প্রায়ই তাকে জেলের কারারক্ষী বা অন্য বন্দিদের সঙ্গে ঝগড়া করতে হতো। কারণ সে দুধের জন্য সারাদিনই প্রায়ই কাঁদত। পরে মেয়ের বয়েস ৬ হতেই কারা কর্তৃপক্ষ তাকে নয়ডার একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে। একজন জেল বন্দি মায়ের কাছে এটা সবথেকে বড়ো সমস্যা। কারাগারের মধ্যে, শিশুদের খাবার, বাসস্থান , প্রয়োজনে চিকিৎসা সহায়তা, শিক্ষা এবং একটি বিনোদনের জায়গা দেওয়ার কথা সুপ্রিম আইনে থাকলেও তার অনেকটাই রয়েছে শুধু খাতায়-কলমে। কারণ মায়ের সাথে সেই ছোট্ট কুঠিরতেই একটি কম্বলে বেশিরভাগ রাত কাটে তার। বেশি দুধ বা খাবার লাগলেও দিনের বরাদ্বকৃত খাবারই জোটে। আর খেলার জায়গা ? দিনে যখন তার মা বাগানে বা অন্য কাজে ব্যস্ত তখন শিশুটি মাটিতে বসে।
যদিও দিল্লির তিহারের মতো কেন্দ্রীয় কারাগারকে একটি ‘মডেল’ কারাগার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং মহিলাদের জন্য একটি পৃথক কারাগার রয়েছে, ভারতের মহিলা বন্দীদের প্রায়ই পুরুষ বন্দীদের মতো একই কারাগারের মধ্যে একটি পৃথক ঘরে রাখা হয়। যদিও কারাগারগুলিকে মূলত “পুরুষ বন্দীদের সমস্যার কথা মাথায় রেখেই তৈরী বলে জানিয়েছেন বহু বিশেষজ্ঞ ।
জানিয়ে রাখি, ভারতের 15টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মহিলাদের জন্য 31টি জেল রয়েছে, যেখানে 21টি রাজ্যে মহিলাদের জন্য আলাদা কোন জেল নেই। 2019 সালে সমস্ত বিচারাধীন মহিলার প্রায় 10 জনের মধ্যে একজনের সঙ্গে শিশু ছিল ।
ভারতীয় সংবিধান অনুসারে জেলে বন্দি মায়ের সঙ্গে তার শিশুকে যদি পরিবারের কেউ নিতে অস্বীকার করে তাহলে ৬ বছর পর্যন্ত তাকে মায়ের সঙ্গেই রাখা হয় । তারপর সেই শিশুকে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত আবাসিক স্কুল, সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়ে যাতে তারা উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারে। এর মাঝে মা মুক্তি পেলে এবং সন্তানের ভরণ-পোষণের ক্ষমতা বহনে সক্ষম হলে তাঁকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছয় বছর পর্যন্ত জেলেই তাদের উপযুক্ত খাবার-স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখার কথা কারাগার কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভীষণ অস্বাস্থকর পরিবেশে ৬ বছর পর্যন্ত মানুষ হতে হয় জেলে বন্দি মায়েদের সন্তানদের। কিন্তু ৬ পেরোলেই তাদের সন্তানদের নিয়মের বাঁধনে কোলছাড়া করা ছাড়া উপায় থাকে না।
জেলে কোনো শিশু জন্মালে তার জন্ম সনদে সেই ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হয়ে না। নিয়মমতো মায়ের-বাবার বা পরিবারের ঠিকানা উল্লেখ থাকে।
2006 সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে, মহিলা বন্দি এবং তাদের শিশুদের কল্যাণের জন্য শিশুদের ৬ বছরের পর যে শিশুকে কোনো হোমে পাঠানো হয় তাকে অবশ্যই সপ্তাহে অন্তত একবার কারাগারে তাদের মায়ের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া উচিত, তবে এটি খুব কমই বাস্তবায়িত হয়। জেল বন্দি ফারিয়া কিন্তু বহু বার বহু জায়গায় আবেদন করেও তার ৭ বছরের ছেলেটিকে মাসে একবারও দেখা করার সুযোগ পায়নি। ফারিয়া ২০২১ এ অনৈতিক ভাবে ভারতে ঢোকার দায়ে রাজস্থানের একটি জেলে আটক ছিল। ছেলের বয়েস ৬ হতেই তাকে তুলে দেওয়া হয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হতে। প্রথম প্রথম ছেলের সঙ্গে সপ্তাহে একবার দেখা করতে পারলেও পরে তা মাস-বছরে দাঁড়ায়।
তার থেকেও বড় কথা যে জেলবন্দি মায়েদের সন্তানদের যে সমস্ত সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয় সেখানে প্রতিনয়ত সরকারি ভাবে তাদের খবর রাখার কথা আইনে থাকলেও তা মানা হয় না। ফলে সেখানেও তারা ভালো পরিবেশ পাবে তার উদাহরণও খুবই কম। এক্ষেত্রে বিজেপির মহিলার শাখার সাধারণ সম্পাদক জুহি চৌধুরী চালিত বিমলা শিশু গৃহ-এর কথা আপনা থেকেই উঠে আসে। যেখানে জেল বা অনাথ শিশুদের আনা হত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু পরে তাদের বেআইনি ভাবে বিক্রি করে দেওয়া হত। মামলাটি জনসমক্ষে আসা পর্যন্ত প্রায় ১৭ শিশু এভাবে বেআইনি বিক্রি করে দেওয়া হয় যাদের পরবর্তীতে কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ভারত সরকার জেলে বন্দি মা বা তাদের সন্তানদের জন্য বহু সুযোগ-সুবিধার কথা বললেও তারা তার কটা পায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
