নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই চলে এসেছিলাম কালিম্পঙের অচেনা অজানা কয়েকটি গন্তব্যের সন্ধানে। কিন্তু দার্জিলিং মেইল নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছল দু’ ঘন্টা দেরিতে। ফলে ৬০০ কিলোমিটার পথ ১২ ঘন্টায় শেষ হল। স্টেশনের বাইরে পাহাড়ের পুরনো ড্রাইভার জোজো, প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হল আমাদের সফর। শহর পেরিয়ে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের পাশ দিয়ে আমরা ছোট্ট মারুতি ওয়াগনার করে চলেছি তিস্তাকে সাক্ষী রেখে। সেবক কালীবাড়ি, করোনেশন ব্রিজ বা বাঘপুল পেরিয়ে কালিঝোরার পথে। ড্যামের উপর দিয়ে এই পথে কালিম্পঙ যেতে গেলে ড্যামের পাহারারত অফিসারের খাতায় গাড়ি ও যাত্রীদের সংক্ষিপ্ত বিবরণী লিপিবদ্ধ করে তবেই যেতে হয়।
কালিঝোরার পর থেকে শুরু হল খাড়াই পথ যার প্রতিটা বাঁকে রয়েছে মনমোহিনী সব দৃশ্য। গাড়ি দাঁড় করলাম যে-জায়গায়, সেখান থেকে ফেলে আসা করোনেশন বা বাঘপুলটা দেখা যায়। বহু বহু নিচে দামাল তিস্তা একটা মাথার সিঁথির মতো লাগছে আর তার উপর বাঘপুলটাকে একটা চিরুনির মতো মনে হচ্ছে। চোখ জুড়ানো রূপ। আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই, শুধু কিছু লুকিয়ে থাকা পাখির ডাক আর গাছ-গাছালির বাতাসের সঙ্গে নিভৃতকথন।
এই পথ গিয়েছে লোলেগাঁও হয়ে আরও কোথায় কোথায় জানি না। আবার চলেছে গাড়ি। এবার রাস্তা ভীষণ খাড়াই আর সরু কিন্তু এক অদ্ভুত সৌন্দর্য মাখা। কিছুক্ষণের মধ্যে জোজো গাড়ি থামাল পানবু ভিউ পয়েন্টে।
আমরা প্রায় বাকরুদ্ধ। একটু আগে অনেক নিচে দেখা বাঘপুলের দৃশ্যকে, নাকি এই পানবু ভিউ পয়েন্টের নয়নাভিরাম দৃশ্যপট- বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, কাকে আমি শ্রেষ্টত্বের জায়গায় রাখব!
তবে করোনেশন ভিউ পয়েন্টের কাছে কোনও হোমস্টে নেই। তার চেয়ে চলে আসা ভালো পানবুতে।
যদি পথের সৌন্দর্যকে দেখতে চান তবে থাকতে পারেন অফবিট পাবঙ-এ। কালিঝোরা হয়ে যে-পথে লোলেগাঁও যাওয়া যায়, সেই পথে পড়বে অজস্র নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র, যাদের নিয়ে এখনও তেমন কোনও প্রচার নেই।
পানবু দারা এলে প্রায় তিন হাজার ফুট উপর থেকে তিস্তা নদীকে দেখবেন ঝুলন্ত বারান্দা থেকে। একটু এগোলেই পাওয়া যায় ইয়ং মাকুম, যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে।
পানবুর একদম মাথায় রয়েছে একটি হোমস্টে, ভাড়া ১৮০০ থেকে ২৩০০ টাকা জনপ্রতি থাকা খাওয়া-সহ। আর আছে লামা দারা নামের এক অসাধাণ জায়গা। এখানে যে-রিসর্টটি আছে তার প্রতিটা ঘরে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ। একটা বিশাল পাথরের উপর এই রিসোর্টটি তৈরি।
অনতিদূরেই চারখোল। এখানেও হবে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে মোলাকাত। আরও একটু এগিয়ে আমাদের আজকের যাত্রার সমাপ্তি হল। জায়গার নাম আগেই বলেছি, পাবঙ। এক অদ্ভুত সুন্দর শান্ত পাহাড়ি গ্রাম, যেখানে প্রতিটা বাড়িই যেন ফুলের বাসর সাজিয়ে রেখেছে। বিকেলের নরম রোদ গায়ে মেখে ফুলের বিছানায় শুয়ে আছে অজানা অচেনা এই মনোরম সুন্দর শান্ত পাহাড়ি গ্রামটি। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে কিছু রঙিন প্রজাপতি ছেঁকে ধরল। এ কোথায় এলাম!
ঢুকে পড়লাম আমাদের হোমস্টেতে। তিনদিন ধরে পাহাড়ে দিওয়ালি ও ভাইফোঁটা চলছে, তাই হোমস্টের মালিকের বাড়িতে কুটুমরা এসেছে এই অনুষ্ঠানে সামিল হতে। প্রচুর খিদে নিয়ে পৌঁছেছিলাম। আমাদের মুখ দেখে ওরা হয়তো বুঝেছিল। পারিবারিক অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে আমরা বিব্রত বোধ করছিলাম কিন্তু আমাদের পেয়ে পরিবারের সকলে খুব খুশি।
ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র রাখার আগেই এক প্লেট সেল রুটি আর চা নিয়ে হাজির ওরা। সেল রুটি এই পাহাড়ে বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় প্রতিটা শুভ অনুষ্ঠানে। দুপুরে খেয়ে একটু রেস্ট নিলাম। সূর্য ডোবার আগেই ওদের আত্মীয়রা সব যে-যার ডেরায় ফিরে গেল। আমিও চললাম ৮ কিলোমিটার দূরে লামা দারার পথে। চারখোলে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে বিকেলটা উপভোগ করলাম।
গন্তব্য এবার সবার চোখের আড়ালে থাকা লামা দারা। কী অপরূপ এর সৌন্দর্য! পাহাড়ের মাথায় একটা বিশাল পাথর কেটে এক টুকরো জায়গা বানিয়ে তার উপর অর্ধ চন্দ্রাকার আকৃতির দশটা ছোট ছোট কটেজ। দেখে মনে হচ্ছে যেন ঝুলন সাজিয়েছে কেউ। এখান থেকে দেখলাম পাহাড়ের ভিড়ে সূর্যদেব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আর তার আলোয় পাহাড়গুলো কমলা আবিরে হোলি খেলছে।
রাত্রে বেশ ঠান্ডা অনুভব করলাম পাবঙে। ৫ হাজার ফুট উঁচুতে এই ছোট্ট গ্রামকে পাহারা দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সকালে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘার সে এক অপূর্ব রূপ দেখতে পেলাম! মোটা জ্যাকেট ঠান্ডাকে দমন করতে পারছিল না। এর মধ্যে গরম চা হাতে বুদ্ধদিদি হাজির। আহা এটাই প্রয়োজন ছিল, গরম আদা গোলমরিচ চা খেয়ে চাঙ্গা হলাম।
কাঞ্চনজঙ্ঘাকে খুব কাছে থেকে উপভোগ করতে চান যারা, তারা পরের বার ভ্রমণ তালিকায় রাখুন পানবু দারা, লামা দারা, ইয়ং মাকুম, চারখোল, কাফেরগাওঁ, লোলেগাঁও আর নোক দারা আর পাবং। অচেনা অজানা জায়গা হলেও আপন করে নিতে সময় লাগবে না এই পাহাড়ি ডেস্টিনেশনগুলিকে। অফুরন্ত ভালোবাসা দেবেন এই এলাকার মানুষরা।