• facebook
  • twitter
Monday, 31 March, 2025

অফবিট ডুয়ার্স

বাইসন, ময়ুর, হাতি ও নানারকমের পাখির দেখা পেলাম। এক ঘন্টার জিপ সাফারির শেষে আবার আমরা শালকুমার গেটেই ফিরে এলাম।

ফাইল চিত্র

অনামিকা মন্ডল সেনগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব দিকে হিমালয়ের পাদদেশে ডুয়ার্স এক অনিন্দ্যসুন্দর জায়গা। সৃষ্টিকর্তা এখানের প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন। পাহাড়, জঙ্গল, নদী— সবকিছু নিয়ে ডুয়ার্সের নিসর্গের টানে প্রকৃতিপ্রেমীরা বার বার আসেন এখানে। ডুয়ার্স শব্দের অর্থ হলো প্রবেশ দ্বার। ডুয়ার্স পূর্ব হিমালয়ের প্রবেশ দ্বার। তবে এটাই ডুয়ার্সের আসল পরিচয় নয়। ডুয়ার্স আসলে প্রকৃতিকে ভালোবাসার, তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রবেশদ্বার। সংকোশ নদী, ডুয়ার্সকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গর দিকটা পশ্চিম ডুয়ার্স ও আসামের দিকটাকে বলে পূর্ব ডুয়ার্স। তবে সমগ্র ডুয়ার্সেই রয়েছে অসংখ্য নদ নদী ও বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। এছাড়াও রয়েছে, গরুমারা, জলদাপাড়া, বক্সা, কাজিরাঙ্গাসহ মোট ছয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

আমাদের এবারের গন্তব্য ডুয়ার্সেরই এক মনোরম ও বিখ্যাত অভয়ারণ্য জলদাপাড়ায়। ভূটান পাহাড়ের পাদদেশে, তোর্ষা নদীর কোলে ৬১ মিটার উঁচুতে ২১৬.৫১ বর্গকিলোমিটার (৮৩.৫৯ বর্গমাইল) জুড়ে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের বিস্তার। জলদাপাড়া মূলত এক শৃঙ্গ গণ্ডারের জন্য বিখ্যাত। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতীর এই গণ্ডার এই অভয়ারণ্যের মুখ্য আকর্ষণ। এছাড়াও আছে, বেঙ্গল টাইগার, হাতি, বাইসন, সম্বর হরিণ, মায়া হরিণ, চিতল হরিণ, বুনো শুয়োর প্রভৃতি জন্তু জানোয়ার।জলদাপাড়া অভয়ারণ্য পাখিদের জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে বনমোরগ, ময়ূর, মেছো ঈগল, ক্রেস্টেড ঈগলসহ প্রচুর পাখি। এছাড়াও ভারতের যেক’টি জায়গা থেকে বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হল, জলদাপাড়া।

আমরা বেড়াতে ভালোবাসি। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য আমরা প্রায়ই পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। এবারও নতুন বছরের শুরুতে দিন তিনেকের একটা ছোট্ট ছুটি পেয়ে ঠিক করলাম, কোথাও একটা ঘুরতে যাবো। এই তিনদিনের সঙ্গে আরো একটা দিন যোগ করলে হয়তো আমরা ডুয়ার্সের অনেকগুলো জায়গাতেই ঘুরতে যেতে পারতাম। কিন্তু অতো তাড়াহুড়োর বেড়ানো আমাদের পছন্দ ছিল না। একটু খোঁজাখুঁজির পরে ঠিক করলাম জলদাপাড়ায় যাবো। একটা দিন নদীর ধারে বসে অলস সময় কাটাবো। আশপাশের পাহাড়, নদী, গ্রাম দেখতে যাবো। একটু খোঁজাখুঁজির পরে, আমরা পেয়ে গেলাম, সিসামারা নদীর তীরে এক রিসর্টের সন্ধান। ডুয়ার্সেরই একটু অফবিট জায়গা ঘুরতে এবার চলে এলাম।

সন্ধে ৭.৩০-এর উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস চড়ে পরের দিন সকাল সোয়া আটটায় ফালাকাটায় এসে পৌঁছলাম। স্টেশনের বাইরে তখন শীতের নরম মিষ্টি রোদ। ট্রেন থেকে দেখা কুয়াশা কেটে গেছে একটু আগেই। কলকাতার তুলনায় এখানে ঠান্ডা অনেকটাই বেশি। ট্রেন থেকে বের হতেই সেটা বুঝতে পারলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে এক কাপ গরম গরম চা খেতে খেতেই আমাদের গাড়ি চলে এলো। এবার আমরা যাবো জলদাপাড়া। ওখানে সিসামারা নদীর তীরে রাইনো কটেজে থাকব। ফালাকাটা থেকে জলদাপাড়ার দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার, সময় লাগে এক ঘণ্টার মতো। একটু পরেই গাড়ি আমাদের নিয়ে রওনা হল। কখনো চা-বাগানের পাশ দিয়ে কখনো কলাবাগান অথবা নারকেল বা সুপুরি গাছের পাশ দিয়ে মসৃণ পিচ বাঁধানো রাস্তা দিয়ে গাড়ি চললো। কিছু দূর গিয়েই পথ হাই রোড ছেড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে চললো। পথের দুপাশে পড়লো ধান ক্ষেত, আলু ক্ষেত। তবে গ্রামের রাস্তা হলেও, রাস্তা খুব মসৃণ আর পরিষ্কার। সকাল সাড়ে নটা নাগাদ আমরা জলদাপাড়ায় এসে পৌঁছলাম। ধান ক্ষেতের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে কটেজে ঢোকার সময় মনটা একটু দমে গিয়েছিল। কিন্তু কটেজে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল। বিশাল বড় জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কটেজের ঘরগুলো।

আমাদের ঘরটা ছিল ওয়েস্টার্ন টাইপ ট্রি হাউজ। সেখানে ওঠার জন্য রয়েছে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। উঠেই পেলাম একটা কাঠের সুন্দর ব্যালকনি। সেখানে বসে দেখা যায় সামনের সিসামারা নদী এবং তার পিছনের বনকে। ঘরে রয়েছে আটটা বাঙ্ক বেড, ফ্রিজ, এসি প্রভৃতি। সকালে জলখাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নদী দেখতে। শীতের সিসামারা নদী অনেকটাই শান্ত, ক্ষীণকায়া। নদীতে স্বচ্ছ জল টলমল করছে। নদীর নিচের নুড়িপাথরগুলোও দেখা যায়। দু’পাশে বিস্তৃর্ণ পাড়ে নুড়ি পাথর ছড়ানো। সিসামারা নদী তোর্ষা নদী থেকে বেরিয়ে, একটু দূরে গিয়ে আবার তোর্ষা নদীতে পড়েছে। তোর্ষা নদী এখানে তিনটে ভাগে ভাগ হয়েছে, বুড়ি তোর্ষা, শীল তোর্ষা এবং বালু তোর্ষা। এখন তোর্ষার মূল প্রবাহটা শীল তোর্ষার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বুড়ি আর বালু তোর্ষা অনেকটা নালার মতো হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ট্রেন জার্নির ধকলে সবাই-ই বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তাই সেই সকালটা আমরা কটেজের বারান্দায় বসে বসে নদী আর বন দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে গেলাম বাঁধের উপর দিয়ে ঘুরতে। টোটো করে ঘুরতে গিয়ে দেখলাম মহাদেব ও তোর্ষাদেবীর মন্দির।

পরদিন সকালে গেলাম জঙ্গলে। সিসামারার রাইনো কটেজ থেকে জলদাপাড়ার শালকুমার গেট ৫ কিমি পথ। আমরা খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমরা গিয়েছিলাম, সকাল ৬টার জঙ্গল সাফারিতে। সাফারির জিপ ভাড়া ১৪০০ টাকা। এর সঙ্গে আছে টুরিস্ট পারমিট, গাড়ির পারমিট ও গাইডের চার্জ। সাফারির জন্য প্রত্যেকের আধার কার্ডের আসল ও জেরক্স লাগে। শালকুমার গেটের পাশের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে হয়। শীতের সকালে জঙ্গল তখন কুয়াশার চাদর সরিয়ে সবে আলস্যের আড়মোড়া ভাঙছে। ঘন সবুজে ছাওয়া জঙ্গলের পরিবেশ ভারী ভালো লাগছিল।

বাইসন, ময়ুর, হাতি ও নানারকমের পাখির দেখা পেলাম। এক ঘন্টার জিপ সাফারির শেষে আবার আমরা শালকুমার গেটেই ফিরে এলাম। কটেজে এসে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম মধুপুর ধাম দেখতে। এটি কোচবিহার শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। জায়গাটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানের সেবাইত থেকে শিষ্যরা অনেকেই আসামের লোক। আসামের বৈষ্ণবদের মহাগুরু শঙ্করাদেবা ও তাঁর শিষ্য মাধবাদেবা, কোচ রাজাদের পৃষ্টপোষকতায় এই ধাম স্থাপন করেছিলেন। মধুপুর ধাম দেখে আমরা গেলাম মহাদেব ও পাতাল ভৈরবীর মন্দির দেখতে। মন্দিরের পিছন দিয়ে বয়ে যাওয়া তোর্ষা নদীকে দেখে আমরা আবার চলে এলাম জলদাপাড়ার কটেজে।

পরদিন সকালে কিছুটা সময় নদীর পাড়ে বেড়িয়ে নিলাম। জলখাবার শেষ হওয়ার পরেই ফেরার তাড়া শুরু হয়ে গেল।
বেলা এগারোটার সময় চেক আউট করে অরণ্যকে এবারের মতো বিদায় জানিয়ে ফালাকাটার দিকে রওনা হলাম। ওখান থেকে দুপুর একটার তিস্তা-তোর্ষা এক্সপ্রেস ধরে, সেদিনই মাঝরাতে শিয়ালদহে এসে পৌঁছালাম।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:- জলদাপাড়া যেতে হলে ট্রেনে ফালাকাটা নামতে হবে। শিয়ালদহ থেকে তিস্তা তোর্ষা এবং উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস এবং হাওড়া থেকে কামরুপ ও সরাইঘাট এক্সপ্রেস ফালাকাটা যায়। ওখান থেকে জলদাপাড়া ৩০ কিলোমিটার মতো।

এছাড়া মাদারিহাট দিয়েও জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে ঢোকা যায়।  নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট বাগডোগরা। ওখান থেকে গাড়িতে ১৪৫ কি.মি মতো রাস্তা। জিপ সাফারি ছাড়া, হাতির পিঠে চড়েও জঙ্গলে ঘোরানো হয়। একে বলে হাতি সাফারি। হাতি সাফারির টিকিট আগের দিন অফলাইনে পাওয়া যায়। এছাড়াও অনলাইনে টিকিটের ব্যবস্থা আছে।

জুনের ১৫ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ অবধি জঙ্গল বন্ধ থাকে। তখন জঙ্গলে কোনো সাফারিই হয় না।
ডুয়ার্সে বছরের যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়। নিবিড় প্রকৃতির কোলে, দুচার দিন কাটালে শরীর ও মনের দুয়েরই শান্তি পাওয়া যায়…