• facebook
  • twitter
Tuesday, 15 April, 2025

কাফেরে কাঞ্চনে

হোমস্টের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে গেল লোলেগাঁও থেকেই। নীচের দিকে তিন কিমি দূরে ছোট্টো পাহাড়ি গ্রাম, কাফের। এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার সম্পূর্ণ শায়িত বুদ্ধের দর্শন মেলে। সেই দৃশ্যের সাক্ষী হলেন গৌরী ঘোষ।

সপ্তাহ শেষে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণার পরেও যখন কোনও কূল কিনারা করতে পারলাম না, তখন এক বন্ধুস্থানীয় দাদার শরণাপন্ন হলাম। দাদা বহুকাল পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত, তাই পাহাড়ি গ্রামের ঠিকানা বাতলাতে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। বললাম, ‘সারা সপ্তাহের ক্লান্তি কাটাতে, কোথায় যাওয়া যায় বলুন তো? আমি এমন জায়গায় যেতে চাই, যেখানে ভিড় একেবারেই থাকবে না, সহজে যাওয়া যাবে, ভালো হোমস্টে থাকবে আর ঘর থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে। মাত্র এইটুকুই চাহিদা।’ ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘কাফের চলে যান।’ আমি এক মুহূর্তও না ভেবে বললাম, ‘বেশ, ব্যবস্থা করে দিন।’

অফিসে ছুটি নেই একদম। তাই চাইলেও শনি-রবির সঙ্গে আরও দুটো দিন জোড়ার উপায় নেই। এদিকে পাহাড়ের টান বড়ো বালাই! বেশ কৌতুহল জাগল কাফেরকে ঘিরে। জায়গাটার ছবি চাইলাম। বললেন, পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু সারাদিন কেটে গেল! ছবি না পেয়ে একটু যেন উদ্বিগ্নই হলাম। যোগাযোগ করায় উনি লাইন গাড়ির ফোন নম্বর আর একটি মাত্র ছবি পাঠালেন এবং ভরসা রাখতে বললেন।

আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। দাদার দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে আমাদের পৌঁছনোর তারিখের কথা বলে রাখলাম। সকালে নির্দিষ্ট গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলাম আমরা তিনবন্ধু। মাঝের চারটে সিটের ভাড়া দিয়ে বেশ আরাম করেই বসলাম সকলে। জনপ্রতি ৪০০ টাকা। গাড়ি ছাড়ল সকাল সাড়ে আটটায়। নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট দেরিতে। সেবক রোডের ওপর অবস্থিত গুরুদোয়ারার সামনে থেকে যেহেতু সকালে শুধু চা খেয়ে বেরিয়ে ছিলাম, তাই ড্রাইভার সাহেবকে বললাম রাস্তায় কোথাও একটু জলখাবারের জন্যে দাঁড়াতে। যদিও এটাই দস্তুর তবুও বলে রাখলাম।

পানিট্যাঙ্কি মোড় হয়ে গাড়ি সেবক রোড ধরল। করোনেশন ব্রিজকে ডানহাতে রেখে গাড়ি এগিয়ে চলল পাহাড়ের পথে। কালিঝোরা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পার করে গাড়ি উঠতে থাকল চড়াই বেয়ে। এই জায়গায় ছবি তোলা নিষিদ্ধ। খাড়া পাহাড়ি পথের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য। কিছু পরেই এল চিরকাঙ্ক্ষিত পানবুদারা। কপাল এবং আবহাওয়া ভালো থাকলে এখান থেকেই এক সরল রেখায় দেখা যায় তিস্তা নদীর ওপর সেবক করোনেশন ব্রিজ এবং রেলব্রিজ। অসম্ভব সুন্দর দেখায় দৃশ্যটি! যদিও মূহুর্তেই গাড়ি এগিয়ে যায়, দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়, আমাদেরও তাই হল। মুঠোফোনে ধরলাম বটে কিন্তু চোখে যা দেখা যায় তার তুলনায় ছবি কিছুই নয়।

খানিক এগিয়ে এই পানবুতেই ড্রাইভার সাহেব একটি ছোটো দোকানের পাশে গাড়ি দাঁড় করালেন। তিনজন পেটুক মানুষ লাফিয়ে নেমে গোগ্রাসে পাহাড়ি মোমো সাবাড় করলাম। অপূর্ব স্বাদের এই অথেন্টিক ভেজ পাহাড়ি মোমো। আবার যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে পৌছলাম লোলেগাঁও।

হোমস্টের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে গেল এই লোলেগাঁও থেকেই। নীচের দিকে তিন কিমি দূরে ছোট্টো পাহাড়ি গ্রাম, কাফের। ভাড়া মাত্র ২০০ টাকা। পাইন বনের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে রাস্তা, খুবই নিরিবিলি। পর্যটকের ভিড় এখনও এখানে আঁচড় কাটতে পারেনি। তাই খুব বেশি হোমস্টে গড়ে ওঠেনি এই পাহাড়ি গ্রামটিতে।

আমাদের হোমস্টের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মাত্র তিনটি ঘরের ছিমছাম সুন্দর করে সাজানো ছবির মতো একটা হোমস্টে। সামনেই ১৮০ ডিগ্রি ভিউ। খরচ জনপ্রতি ১৫০০ টাকা, দুপুর, সন্ধে, রাত এবং সকালের খাবার-সহ। মালিক ভদ্রলোক জানালেন, সকালে এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার সম্পূর্ণ শায়িত বুদ্ধের দর্শন মেলে। আমরা একযোগে বললাম, ‘নিশ্চিন্তে থাকুন, কাল দেখা যাবে না, আমাদের সঙ্গে কাঞ্চনের লুকোচুরির সম্পর্ক। তবে আপনার হোমস্টেটি খাসা।’

বেলা দেড়টা বাজতেই খাবারের ডাক পড়ল। আর-পাঁচটা হোমস্টের মতোই সাধারণ খাবার কিন্তু অসাধারণ তার স্বাদ। চেটেপুটে সব খাবার শেষ করে বেলা চারটে পর্যন্ত টেনে ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে কালো কফির কাপ হাতে নিয়ে বাইরের বসবার জায়গায় গা এলিয়ে দিলাম। হালকা ঠান্ডায় কফিটা যেন অন্য মাত্রা যোগ করছিল।

সন্ধ্যা নামতেই দূরের পাহাড়ে একে একে আলো জ্বলে উঠতে থাকল- ঠিক যেন ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি। এ এক অপার্থিব দৃশ্য! মালিক এসে চিনিয়ে দিলেন, বাঁ-দিকে কালিম্পং, তারপর ডেলো পাহাড় এবং আরও কত কী। প্রাণ ভরে গান গাইলাম সারাটা সন্ধে। ছ’টা নাগাদ মশলা চা আর দুর্দান্ত নিরামিষ মোমো এল, যা সন্ধেটাকে যেন আরও সরস করে তুলল।

রাত বাড়লে হিম থেকে বাঁচতে ঘরে গিয়ে বসলাম কিন্তু দরজা জানালা খোলা রেখে। চলল দেদার আড্ডা। দশটা নাগাদ গুটি গুটি পায়ে খাবার ঘরে গিয়ে বসলাম, আবারও তৃপ্তি করে খেলাম পাহাড়ি খানা, বিশেষ করে প্রথম পাতে বাড়িতে তৈরি গাওয়া ঘিয়ের তো কোনও জবাব নেই। ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঠাকুমা ঘি তৈরি করতেন আর আমি খেতাম। ঠিক সেই সুগন্ধ। আসল গাওয়া ঘি যাঁরা খেয়েছেন, তাঁরাই জানবেন এই ঘিয়ের মাহাত্ম্য।

১১টা নাগাদ শুয়ে পড়লাম এবং অচিরেই ঘুম এসে গেল। ভোর পাঁচটায় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙল কিন্তু বিছানা ছাড়তে পারলাম না। ছ’টার সময় যখন দুই বন্ধু দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, আমার চোখে তেমন কিছুই পড়ল না, শুধু সামনের পাহাড়টা আগের দিনের থেকে যেন একটু বেশি স্পষ্ট মনে হল। আমি কল্পনা করতে থাকলাম, হয়তো ডানদিকে কোথাও এক টুকরো কাঞ্চন লুকিয়ে রয়েছে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটি উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই তো কাঞ্চন!’ এবার আমি অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম, আমাদের দরজার ঠিক সামনে, মেঘের ওপর থেকে একটা আস্ত সিঙাড়ার মতো যেটা উঁকি দিচ্ছে- সেটাই আমাদের বহু আকাঙ্খিত সাধের কাঞ্চনজঙ্ঘা!

এদিনই আমাদের ফিরে যেতে হবে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তাই বলে তো আর এই অমূল্য সময়টা নষ্ট করা চলে না। তাই অপলক চোখে চেয়ে রইলাম দুজনে। ধীরে ধীরে মেঘ সরে গিয়ে চোখের সামনে ভাস্বর হল শায়িত বুদ্ধ, যেন ঈশ্বর দর্শন। পাশের ঘর থেকে ছেলে (আমাদের অন্যতম বন্ধু) উঠে এসে পাশে দাঁড়াল। আমরা সবাই যার পর নাই আনন্দিত এবং তৃপ্ত।

ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং চা এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কাঞ্চনের সঙ্গে বসেই খেলাম। চা শেষ হতেই সে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে। মেঘ এসে গেছে সামনে। অতঃপর আলস্য ঝেড়ে ফেলে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। গরম গরম ফুলকো লুচি আর আলু চচ্চড়িতে প্রাতরাশ সেরে, খানিক হেঁটে এলাম পাহাড়ি পথ ধরে। এবারে আর সাইট সিয়িংয়ের কোনও তাড়া নেই, শুধুই বিশ্রাম, শুধুই অবসর।

নির্দিষ্ট সময়ে দুয়ারে এল লাইন গাড়ি। আমরাও গাড়িতে উঠে বসলাম। আবারও একই কায়দায়, তিনজনের জন্যে মাঝের চারটি সিট। বাগরাকোট হয়ে নেমে এলাম শিলিগুড়ি শহরে। ফেরার সময় কাঞ্চনকে বলে এলাম, ‘আবার দেখা হবে, খুব শিগ্গিরি।’ গৃহকর্তাকে বলে এলাম, ‘পরের বার নির্মীয়মাণ অ্যাটিক রুমেই ঘাঁটি গাড়ব।’