মহাকুম্ভ ২০২৫ প্রস্তুতি পর্ব

প্রয়াগে আয়োজিত ২০২৫ সালের মহাকুম্ভে ৭৫টি দেশের ২৫ কোটিরও বেশি তীর্থযাত্রী, দেশ-বিদেশের অতিথি-সহ বিপুল সংখ্যক জনসমাগমের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই মহাকুম্ভের থিম রাখা হয়েছে ‘ভব্য-দিব্য ও নব্য মহাকুম্ভ’। এরকম বৈভব্য আয়োজনে উত্তর প্রদেশ সরকারের ৫৬০০ কোটি টাকারও অধিক ব্যয় হচ্ছে। এই মহাকুম্ভ কেবল উত্তর প্রদেশ নয় ভারতের গ্লোবাল ব্র্যান্ডিংয়ের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
একেবারে প্রস্তুতি পর্ব থেকেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মহাকুম্ভের আয়োজনের দিকে নিরন্তর নজর রেখেছেন। মহাকুম্ভ পার্বণ উপলক্ষে প্রয়াগধামে আগত কোটি কোটি পুণ্য স্নানার্থীদের যাতে নূন্যতম অসুবিধার সম্মুখীন না হতে হয় এবং এই মহাকুম্ভ যাতে তাঁরা তাঁদের মনের মণিকোঠায় চিরদিনের মতন তুলে রাখতে পারেন- সেই বিষয়ে সরকার সম্পুর্ণ সচেতন। পুণ্যার্থী-সহ দেশ বিদেশের অতিথিদের আসা-যাওয়া যাতে সহজ, সুবিধাজনক ও সুরক্ষিত হয়- তা সুনিশ্চিত করতে সমস্ত রকমের ব্যবস্থা এবং গুরুত্বপুর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রয়াগে ‘কুম্ভ নগরী’র লেআউটের কাজ ইতিপূর্বেই সম্পন্ন হয়েছে। এই মহাকুম্ভে সর্বমোট ২৫টি সেক্টর নিয়ে অস্থায়ী ‘কুম্ভ নগরী’ গড়ে উঠছে। যার মধ্যে সর্বাধিক ১৪-টি সেক্টর ঝুঁসী অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে। তীর্থযাত্রী-সহ মহাকুম্ভে আগত দেশ বিদেশের বিশাল জনসমাগমকে লক্ষ রেখে, কুম্ভ প্রশাসন নিরাপত্তার জন্য সপ্তস্তরীয় চক্র তৈরি করেছে। ৬০ হাজারের মতো বিশাল পুলিশবাহিনী, যার মধ্যে ট্র্যাফিক পুলিশও মোতায়েন করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ মহাকুম্ভ অঞ্চলকে অভেদ্য সুরক্ষাবলয়ে মুড়ে ফেলার জন্য গুরুত্বপুর্ণ পরিকল্পনা নীতি তৈরি করা হয়েছে। যাতে যে-কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে ও সময় থাকতে থাকতেই অবাঞ্ছিত ঘটনা মিটিয়ে ফেলতে পারা যায়। বিশাল পুলিশ ও পিএসি বাহিনী ছাড়াও, প্রয়োজন বিশেষে প্যারামিলিটারি ফোর্সেকেও মহাকুম্ভে মোতায়েন করা হতে পারে।

সম্পুর্ণ কুম্ভমেলা অঞ্চলটিকে ১০টি জোন,২৫টি সেক্টর, ৫৬টি থানা এবং ১৫৫টি পুলিশ চৌকিতে বিভাজিত করা হয়েছে। এর জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে মহাকুম্ভের প্রস্তুতি। এই প্রথম সর্বাধিক ২৫টি সেক্টর নিয়ে মহাকুম্ভের এই বিশাল আয়োজন। ‘কুম্ভনগরীকে’ অস্থায়ী একটি নতুন জেলা ঘোষণা করার আয়োজন সম্পুর্ণ হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে আধিকারিকদের নিযুক্তি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে।
পবিত্র ত্রিবেণী সঙ্গমের তটে জপ–তপ ও প্রবচন এবং যাগ-যজ্ঞের জন্য ‘কুম্ভ নগরী জনপদ’ নির্মাণ শীঘ্রই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। মেলা লেআউট হিসাবে সর্বাধিক ১৪টি সেক্টর ঝুঁসী অঞ্চলে তৈরি করা হবে। বস্তুত ঝুঁসীতে সেক্টর সংখ্যা ১০ থেকে ২২ অবধি থাকবে। এছাড়াও সেক্টর ৫ ঝুঁসী অঞ্চলেই তৈরি করা হবে। এই অঞ্চলেরই হেতাপট্টিতে সেক্টর ১০ স্থাপিত হবে। এখান থেকেই ডাউন স্ট্রিমে সঙ্গমের দিকে এগিয়ে যাবার পথে, সেক্টর ১১ থেকে ২২ অবধি থাকবে। সেক্টর ২২ ছতনাগ স্থিত ডাউন স্ট্রিমে নাগেশ্বর মন্দির অবধি বিস্তৃত করা হবে।


এই স্থলেই গঙ্গার উপর ঝুঁসী ও অরৈল (নৈনি) কুম্ভমেলা অঞ্চলকে একসাথে যুক্ত করার জন্য, গঙ্গার উপর দুটি বড় ব্রিজ তৈরি করার কাজও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অরৈলের দিকে তিনটি সেক্টর ২৩, ২৪ ও ২৫ স্থাপিত হবে।

ঠিক তেমনই প্যারেড ( গঙ্গার পশ্চিম প্রান্তের তট ) অঞ্চলে সেক্টর ১ ও ২ বসানো হচ্ছে। সঙ্গম অঞ্চলকে সেক্টর ৩ নাম দেওয়া হয়েছে। সেক্টর ৪ লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ব্রিজের নিচে দারাগঞ্জের দিকে বসানো হবে। সেক্টর ৬ গড়ে উঠছে নাগবাসুকি মন্দির সংলগ্ন শহরের দিকের ত্রিবেণী তটে। নাগবাসুকি মন্দিরের আপ স্ট্রিমে, শহরের দিকে সেক্টর ৭ এবং ৮ ও ৯ সলোরী অঞ্চলের আপ স্ট্রিম অবধি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
উচ্চ পুলিশ আধিকারিকদের সূত্রে জানতে পারা যাচ্ছে যে, মহাকুম্ভ ২০২৫ উপলক্ষে কেবল স্নানার্থীদের সুরক্ষা খাতে প্রায় ৩৭,৬১১ জন পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হবে। প্রয়োজন বিশেষে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা হবে।

২০২৫ সালের এই মহাকুম্ভে দেখা যাবে আস্থা, আধ্যাত্মিকতার ভাবগম্ভীর বর্ণাঢ্য ও বর্ণময় চিত্র। টানা ৪৫ দিন ধরে প্রতিদিন আয়োজিত হবে ভারতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি তথা পৌরাণিক ও প্রাচীন ইতিহাসের গৌরব গাথা। এই মহাকুম্ভে সারা বিশ্বের ৭৫টি দেশের ২৫ কোটির বেশি পুণ্যার্থী ও স্নানার্থীদের আগমনের পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। সুতরাং এই মহা আয়োজনকে উত্তর প্রদেশের সরকার পাখির চোখ করে, আধুনিক বিজ্ঞাপনের ব্র্যান্ড হিসেবে দেখছে। যে-কারণে সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধার সঙ্গে সঙ্গেই এই মহোৎসবকে সারা বিশ্বের কাছে চিরস্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কাজে নেমেছে । কাজ যত দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে, মহাকুম্ভ-২০২৫ এর রং তত বর্ণময় হয়ে উঠছে।

জানুয়ারি মাসে প্রয়াগরাজে আয়োজিত এই মহাকুম্ভ মেলাকে ত্রিবেণী সঙ্গম-সহ সংলগ্ন নদীতট অঞ্চলে বেশ কয়েকটি আধ্যাত্ম ও সনাতনী ঐতিহ্য সংস্কৃতি আশ্রিত অস্থায়ী গ্রাম বসানো হবে। প্রায় ৫ একর জমির উপর অস্থায়ীভাবে নির্মিত এই গ্রামগুলিতে ৪৫ দিন অবধি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধার্মিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। যার মাধ্যমে সুপ্রাচীন সনাতন ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিষয়গুলি তুলে ধরা হবে মেলায় আগত পুণ্যার্থী ও স্নানার্থী-সহ দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটকদের সম্মুখে। এই সমস্ত সাংস্কৃতিক গ্রামের মধ্যে অগমেন্টেড রিয়েলিটি ( AR ) এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ( VR )-র মাধ্যমে মহাকুম্ভের বিভিন্ন পৌরাণিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক বিষয় ও ঘটনাগুলিকে বর্ণনা করা হবে।
মেলা অঞ্চলে ৩০টি বিশাল সুদৃশ্য থিমভিত্তিক বৈভব্য তোরণ-দ্বার তৈরি করা হবে। সেই তোরণ-দ্বারগুলি যথা ত্রিশূল, স্বস্তিক, কল্পবৃক্ষ, ডমরু-সহ আধ্যাত্মিক ভাবনা-চিন্তার উপরে ভিত্তি করে বিভিন্ন কালখণ্ডে অমৃত মহাকুম্ভ যাত্রা নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে মহাকুম্ভের পৌরাণিক,আধ্যাত্মিক বিষয়গুলিকে মহাকুম্ভে আগত তীর্থযাত্রী-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভ্যাগতদের সম্মুখে তুলে ধরা হবে।
প্রতিদিন মুখ্য মঞ্চে ধ্রুপদী ও লোকনৃত্য, লোকসঙ্গীত এবং ভক্তিসঙ্গীতের দেশ- বিদেশের বিশিষ্ট কলাকুশলী এবং শিল্পীদের অনুষ্ঠান থাকবে। প্রতিদিনের এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথিদের উপস্থিতিও থাকবে। এসব ছাড়াও নাটক, ফুড স্টলস, কুকিং, ক্রাফট ওয়ার্কশপ ও ড্যান্স-মিউজিক ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হবে। বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের জন্য তথ্যকেন্দ্র এবং গাইডেড টুরের সুবিধাও থাকবে।
৩০টি থিম ভিত্তিক তোরণ দ্বার মহাকুম্ভ মেলা অঞ্চলে উত্তর প্রদেশ পর্যটন বিভাগ ৩০টি বৈভব্য তোরণ দ্বার  তৈরি করবে। এই তোরণ দ্বারগুলির নাম যথাক্রমে ১) মহাকুম্ভ (লোগো) ২) ত্রিশূল ৩) স্বস্তিক ৪) ডমরু ৫) শঙ্খ ৬) মহাকুম্ভ ২০২৫ ৭) সূর্য ৮) দেবদল ৯) কমল ১০) গদা ১১) ধনুষ ১২) গঙ্গা ১৩) কৌস্তুভ ১৪) কামধেনু ১৫) লক্ষ্মী ১৬) ওম ১৭) নন্দী ১৮) সঙ্গম ১৯) নাগবাসুকি ২০) শিবলিঙ্গ ২১) চন্দ্র ২২) কলশ ২৩) সুদর্শন চক্র ২৪) ১৪ রত্নকথা ২৫) ঐরাবত ২৬) কচ্ছপ ২৭) কল্পবৃক্ষ ২৮) সমুদ্রমন্থন ২৯) রুদ্রাক্ষ এবং ৩০) অশ্বদ্বার।

তোরণ দ্বারগুলিতে সেলফি পয়েন্ট, ল্যাম্প পোস্ট ও পোর্টেবল টুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারের নির্মাণ করা হবে। এই সমস্ত দ্বার থিমের অনুরূপে তৈরি করা হবে যার মাধ্যমে সমস্ত পৌরাণিক ও আধ্যাত্মিক নামগুলির বৈশিষ্ট তুলে ধরা হবে। এই ৩০টি বৈভব্য তোরণ দ্বার দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে এক বিরাট আকর্ষণের কেন্দ্র হবে।

এই প্রসঙ্গেই আরও যে-তথ্য জানতে পারা যাচ্ছে তা হল, দেবতাদের তথা সমুদ্রমন্থনের উপর ভিত্তি করে তোরণ দ্বারগুলি নির্মিত হবে। সমুদ্র মন্থনের সময়ে ক্ষীরসমুদ্র থেকে যে-১৪টি রত্ন উঠে আসে যথাক্রমে সেই রত্নগুলির নাম হলাহল, কালকূট, ঐরাবত, কামধেনু, উচ্চৈশ্রবা, কৌস্তুভ মণি, কল্পবৃক্ষ, রম্ভাদেবী, মাতা মহালক্ষ্মী, বারুণী, চন্দ্রমা, শারঙ্গ ধনুষ, পাঞ্চজন্য শঙ্খ, ধন্বন্তরি এবং অমৃত।

১৪টি পূর্ণ কুম্ভ পার করে তবে এই মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়। ফলে এই মহোৎসবকে ঘিরে শুধু দেশের মানুষেরই নয়, বিদেশের পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণের কেন্দ্র হতে চলেছে প্রয়াগরাজ। (ক্রমশ)