লং ড্রাইভে অযোধ্যা পাহাড়ে

অনেক বছর পরে তিন বন্ধু মিলে বেড়াতে বেরিয়েছি। গাড়ির ছাদে লাগেজ বাঁধার পর বালি থেকে যাত্রা শুরু করলাম সকাল আটটায়। কাছেই এক পেট্রল পাম্প থেকে গাড়িতে তেল ভরা হল। একে একে মসাট, শিয়াখালা পেরিয়ে গেলাম। রাস্তার দু’পাশে ধান ও আলুর খেত। জয়রামপুরে এসে একটি হোটেলে ব্রেড-ওমলেট-চায়ে প্রাতরাশ সারা হল।

কিছু পরে পৌঁছে গেলাম আরামবাগের গৌরহাটি মোড়ে। ভাদুর মোড়, কোতলপুর, চাতরা পেরিয়ে চলে এলাম জয়পুর ফরেস্টের কাছে। রাস্তার দুই পাশে এখন ঘন জঙ্গল – ১২০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে। জঙ্গল শাল, পলাশ, কুসুম, নিম ও সেগুন গাছে সমৃদ্ধ। ধলডাঙা মোড়ে এসে পুরুলিয়ার রাস্তা ধরে নিলাম। দুপুর ১টা বাজে– এসি গাড়ির বাইরে জ্বলন্ত রোদ। পুরুলিয়া বাজার থেকে অযোধ্যা পাহাড় আরও ৪৩ কিমি দূরে।

ব্যস্ত শহরতলি বেগুনকোদর পেরিয়ে, চলে এলাম বড়তলিয়া। পথের দু’পাশে ধান ও সরযে খেত। সামনেই অযোধ্যা পাহাড়। গ্রামের মধ্য দিয়ে সরু পথ। গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে পথ এগোচ্ছি। দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ এসে পৌঁছোলাম মুরগুমার একটি ইকো হাট-এ । বড় গেট দিয়ে ঢুকে সামনে এগোতেই সুন্দর বাগান। তার পিছনে দোতলা কটেজ– নীচে ও উপরে ৬টা করে ঘর। একতলায় পর পর ৩টি ঘর আমাদের জন্য আরক্ষিত। ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে সবাই চলে এলাম লাঞ্চ করতে।


লাঞ্চ সেরে আবার ঘরে ঢুকতে চাইল না কেউ। তাই গাড়িতে চেপে এগোলাম ‘মুরগুমা ভিউ পয়েণ্ট’ বা ‘উকামবুরু’-র পথে। মুরগুমা ড্যামের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছে কম উচ্চতার এক টিলার কাছে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে, ছোট-বড় পাথর টপকে টিলার উঁচু অংশে গিয়ে পৌঁছোলাম। এই জায়গাটাই ‘উকামবুরু’। এখান থেকে নীচে তাকালে পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে মুরগুমা ড্যাম ও পারিপার্শ্বিক অঞ্চলকে ভারি সুন্দর লাগে। অস্তগামী সূর্য আকাশ রাঙিয়ে দিয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই সূর্য অস্ত গেল– আমার ক্যামেরায় ধরা থাকল সেই ছবি।

হঠাৎই চরাচরে আঁধার ঘনিয়ে এল। আমরাও নেমে এলাম টিলা থেকে। গাড়িতে চড়ে ফিরে চললাম ডেরার দিকে। পথের দু’পাশে জঙ্গল। অন্ধকার দ্রুত গ্রাস করছে চরাচর। মুরগুমা ড্যামকে বাঁয়ে রেখে এগোতে লাগলাম। এই ড্যাম তৈরি হয় কংসাবতীর উপনদী সাহারাঝোড় নদীর উপর– পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে আদিবাসী অধ্যুষিত মুরগুমা গ্রামের কাছে। বেশ কয়েকটি জলধারা অযোধ্যা পাহাড় থেকে সরাসরি নেমে এসে মিলিত হয়েছে ড্যামের জলাশয়ে। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এই ড্যামের বুকে রয়েছে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ।

পরদিন সকালে ঘরের বাইরে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেল বাগানের শোভা দেখে। ডালিয়া, ইনকা ও বিভিন্ন বর্ণের পিটুনিয়া বাগান আলো করে রেখেছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে কিচেনে গিয়ে পৌঁছোলাম। গরম লুচি-তরকারি, ডিমসেদ্ধ ও চায়ে প্রাতরাশ সারলাম। সাইট-সিইং করে ফিরতে দেরি হবে।

আমাদের জাইলো-র ইঞ্জিন চালু হল। সরু রাস্তা ধরে মুরগুমা লেকের পাশ দিয়ে এগোতে লাগলাম। লেকের জলে ছোট ছোট দ্বীপগুলি ভারি সুন্দর । ড্যাম পেরিয়ে গতদিন বিকেলের পথেই চলতে লাগল গাড়ি ।

প্রথমে চলেছি ‘ময়ূর পাহাড়’। মুরগুমা রোড এবং অযোধ্যা হিলস রোড ধরে এগোলে, প্রায় ২৫ কিমি দূরত্বে তার অবস্থান। দু’পাশে জঙ্গল– শাল, পলাশ, কুসুম, মহুয়া গাছ। এটা অযোধ্যা পাহাড়ের বাঘমুণ্ডি রেঞ্জ।শালের জঙ্গল পেরনোর পর রাস্তা একটু চওড়া হল। আমরা চলেছি ‘চুনকুটি’ গ্রামের মধ্য দিয়ে। বাঁপাশে চোখে পড়ল বেদান্ত পাঠশালা। মন খারাপ হয়ে গেল, গ্রামগুলির হত-দরিদ্র অবস্থা দেখে। পুরুলিয়া জেলায় বৃষ্টি কম, ঊষর জমি– তাই চাষবাস কম। জেলার বিভিন্ন জায়গায় ড্যামগুলি পানীয় জলের সমস্যা অনেকটা মেটাতে পারলেও, চাষের কাজের পক্ষে তা অপ্রতুল। জেলায় শিল্পের অবস্থাও তথৈবচ।

‘কুশল পল্লী’ ছাড়িয়ে চলে এলাম অযোধ্যা হিল-টপ-এ । এবার পথের দু’পাশে সোনাঝুরি, শাল, আম, মহুয়া, পলাশ ও কুসুমের জঙ্গল। এর কিছু পরেই আমরা ‘ময়ূর পাহাড়’-এর নীচে এসে পৌঁছোলাম। এই ‘ময়ূর পাহাড়’ কম উচ্চতার এক প্রশস্ত টিলা, যা প্রকৃতপক্ষে অযোধ্যা হিলস-এরই প্রসারিত অংশ। একসময় এই অঞ্চলে যথেষ্ট সংখ্যায় ময়ূরের দেখা মিলত– তাই এই নাম। টিলার ওপরে ছোট-বড় গাছ, নীচে তাকালে পুরুলিয়ার অনেকটা অংশ পাখির চোখে দেখে নেওয়া যায়।

এদিক সেদিকে ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেখানে এক বৃদ্ধ আদিবাসী, পাথরের ওপর বসে সাঁওতালি ভাষায় গান গাইছেন একতারা বাজিয়ে। প্রকৃতির উন্মুক্ত পটভূমিতে, আশ্চর্য সুন্দর এক অনুভূতি হল।

এরপর বাঁদিকে কিছুটা এগোলে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড়ের আরও উঁচু অংশে। সামনেই একটি ওয়াচ টাওয়ার নৈস্বর্গিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। পিছনে একটি ছোট মন্দির। কিছুক্ষণ পরে সকলেই ধীরে ধীরে নেমে পৌঁছে গেলাম নীচে অপেক্ষারত গাড়ির কাছে।
এবার চলেছি অযোধ্যা পাহাড়ের ‘আপার ড্যাম’-এর পথে– দূরত্ব আরও ৫ কিমি। চারপাশের দৃশ্য অতি মনোরম। প্রায় ২০ মিনিট পরে আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছোল এক বিশাল লেকের কাছে। আপার ড্যাম তৈরির সময় সৃষ্ট এই লেক, লম্বায় প্রায় ১ কিমি, প্রস্থেও কয়েক শত ফুট। পানীয় জলের যোগান দেওয়া ছাড়াও এই লেকের জল, চাষের কাজেও লাগে। লেকের দৃশ্য এতই সুন্দর যা ভাষায় প্রকাশ করা বেশ কঠিন। অযোধ্যা পাহাড় হিল-টপে নিঃসন্দেহে এটাই সেরা জায়গা। অযোধ্যা পাহাড়ের উচ্চতম শৃঙ্গ চামতাবুরু আরও ১৭ কিমি দূরে।
আমরা গাড়িতে চেপে দ্রুত নেমে আসতে লাগলাম। প্রায় ১০-১২ মিনিট পরে এসে পৌঁছোলাম লোয়ার ড্যামের কাছে। আকারে ছোট হলেও দু’পাশে পাহাড় সমেত লোয়ার ড্যাম লেকের সৌন্দর্যও কম নয়। ড্যামের কাছেই ছোট্ট এক শিব মন্দির। জানলাম, আপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যামের লেক দুটির মধ্যে, প্রয়োজনে জমা জলের আদান-প্রদান করা হয়।

এবার গাড়িতে চড়ে এগোলাম বামনি ফলস দেখতে। বামনি ফলস আরও ৯ কিমি দূরে। প্রায় ২০ মিনিট গাড়ি চলার পরে আমরা এসে পৌঁছোলাম অযোধ্যা পাহাড়ের সেরা জলপ্রপাতের কাছে। গাড়ি থেকে নেমে দেখি বহু পর্যটকের সমাগম সেখানে।

কয়েকটা দোকান সমেত জায়গাটা বেশ জমজমাট। বেশ কিছুটা নীচে নামতে হবে ঝর্ণার প্রকৃত রূপ দেখার জন্য। সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে জলপ্রপাতের পতনস্থলে। একটা সঙ্কীর্ণ পথ ধরে কিছুটা নেমে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে স্ফীত ঝরনার উচ্ছাস দেখতে পেলাম। পাহাড়ের মাঝে পুরো জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে। পাথরে মস ও শ্যাওলা জমে রয়েছে। এবার জলপ্রপাতকে আরও ভালো করে দেখতে পেলাম। স্ফীত জলধারা সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে– তৈরি হচ্ছে অজস্র জলকণা।

এরপর গাড়িতে চড়ে মার্বেল লেকের কাছে পৌঁছোলাম কয়েক মিনিট পরেই। কয়েক পা এগিয়ে সামনে দেখি এক নীলবর্ণ লেক। স্থানীয় লোকেরা একে ‘নীল বাঁধ’ বা ‘পাতাল বাঁধ’ বলে থাকেন। যখন রাজ্যের চতুর্থ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পারিপার্শ্বিক পাহাড়গুলিতে বিস্ফোরণ করা হয়, তখনই হঠাৎ এই প্রাকৃতিক লেকের সৃষ্টি হয়। সম্ভবত, পাথরে বিস্ফোরণের ফলেই ভূগর্ভস্থ জল উপরে উঠে এসে এই সুন্দর লেকটির সৃষ্টি হয়।

পাহাড়-জঙ্গলের পথে দুপুর দুপুর ফিরে এলাম আমাদের আস্তানায়। হাত-মুখ ধুয়েই সকলে খেতে বসে গেলাম। সেদিনটা বিশ্রামেই কাটল।
পরদিন সকালে উঠে ইকো-হাট ছেড়ে যেতে, সবারই মন খারাপ। চা-প্রাতরাশ সেরেই গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়ি এগিয়ে চলল জয়চণ্ডী পাহাড়ের উদ্দেশে।