• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

শীতে চলুন সিংভূমে

মালভূমির পাথুরে ল্যান্ডস্কেপ আর জঙ্গলের মধ্যে পথ হারানো ঝরনা- এমনই অপার্থিব জায়গায় যদি হঠাৎ মিলে যায় ছুটি কাটানোর অবসর! চাইবাসা হয়ে সারান্ডা সার্কিটে বেড়ানোর সুলুকসন্ধান দিলেন অবন্তী সিনহা।

সিংভূম। ফাইল চিত্র

ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলার চাইবাসায়, শীতের রোদ গায়ে মেখে একটি সুন্দর ছুটির দিন কাটাচ্ছি। ঠাঁই মিলেছে সার্কিট হাউসে। ছোট্ট একটি জনপদ, বেশিরভাগই একতলা-দু’তলা বাড়ি, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আদিবাসি গ্রাম। বসন্তে নাকি পলাশে পলাশে ভরে যায় এই অঞ্চল। কিন্তু শীতের সৌন্দর্যটা যেন মৌনী সন্ন্যাসীর মতো। বাদামি আর ফিকে সবুজ শালজঙ্গল, লাল ধুলো ওড়ানো রাস্তা, গোটা শহরটিই ঘন জঙ্গল আর পাহাড় বেষ্টিত। এখানকার প্রধান আকর্ষণ চাইবাসা ফরেস্ট রেঞ্জ।

হাওড়া থেকে টাটানগর এবং চক্রধরপুর পর্যন্ত ট্রেন ছুটছে।  চাইবাসা যাওয়ার জন্য অবশ্য টানগর বা চক্রধরপুর, দুই জায়গা থেকেই গাড়ি পাওয়া যায়। আমরা এসেছি টাটা হয়ে। চাইবাসার পর্যটন স্পটগুলির মধ্যে রয়েছে রুংটা গার্ডেন, জুবিলি লেক, শহিদ পার্ক, মধুবাঁধ এবং রানিবাঁধ। ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে রওনা দিলাম হিরণী নামের এক জলপ্রপাতের উদ্দেশে। যাওয়ার পথে পড়ল এক বিস্তৃত শালবন। আর তার মাঝখান দিয়ে চুলের সিঁথির মতো কিছু জঙ্গুলে রাস্তা। অনেকটা যেন কবি রবার্ট ফ্রস্টের বর্ণনামাফিক সেই ‘ইয়েলো উড’-এর মতো। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করলাম শালের বনে আর তারপর চললাম হিরণী ফলসের দিকে।

কয়েকধাপ খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছতে পারবেন ঝরনার নীচে তৈরি হওয়া কুণ্ডে। আবার উপরে উঠে এলেই দেখবেন পাহাড়ের ধাপ বেয়ে আরও উপরে উঠে গেছে পথ। সে পথের শেষে একটা ওয়াচটাওয়ার রয়েছে। সেখান থেকেই পাখির চোখে দেখতে পাবেন সারান্ডার সবুজ শ্যামলিমা। অচিরেই মন কেড়ে নেবে সিংভূমের পাহাড়তলি।

এরকমই আরও একটি সুন্দর ডেস্টিনেশনে নিয়ে গেলেন আমাদের গাড়ির চালক। যে-পথ কেওনঝাড়ের দিকে গেছে, সেখানেই পাহাড়ের বেষ্টনীর মাঝে রয়েছে মুর্গা মহাদেব জলপ্রপাত আর শিবের মন্দির। এই জায়গাটিতে শ্রাবণ মাসে খুব ভিড় হয় পুণ্যার্থীদের। কিন্তু শীতে ফাঁকা থাকায়, নিবিড় প্রকৃতির কোলে বেশ কিছুটা নিরালা অবকাশ পাওয়া গেল।

চাইবাসা এলে অবশ্যই যা মিস করবেন না তা হল, কিরিবুরু ও লাগোয়া মেঘাতুবুরু। কিরি মানে হাতি আর বুরু মানে বন। আর মেঘাতু হল মেঘে ঢাকা বন যাকে বলে ‘রেইন ফরেস্ট’। নামেই বোঝা যায়, এই অঞ্চলে বৃষ্টিও বেশি। কাছেই রাউরকেল্লা স্টিল প্লান্ট– ফলে এখানে মাটিতে লৌহের পরিমাণ অতিরিক্ত। এছাড়া মিশে আছে নানা খনিজ পদার্থও।

পাশাপাশি হলেও, কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরুর ভৌগলিক অবস্থান কিন্তু দুটি ভিন্ন রাজ্যে। সিংভূম অঞ্চলের কিরিবুরু পড়ে ওড়িশায় আর মেঘাতুবুরু ঝাড়খণ্ডে।

স্টিল অথরিটির গেস্টহাউসে অতিথি হয়ে নিকটবর্তী সানসেট পয়েন্টে যাবার লোভ সামলানো গেল না। মেঘাতুবুরু যারাই আসেন তারা এই সানসেট পয়েন্টে অবশ্যই যান। চারপাশে টিলা পাহাড় আর সেখানে হাতি, হরিণ, ভাল্লুক ও নানা প্রজাতির সাপের বাস। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক আদর্শ জায়গা। ছোট ছোট ঝরনা আর জঙ্গুলে পথ– অচিন পর্যটকের মন কেড়ে নেয় কিরিবুরু।

কিরিবুরুতে এলে সারান্ডা ঘুরে নিতে ভুলবেন না। মনোহরপুর-কে বলা হয় সারান্ডার প্রবেশদ্বার। কোয়েল, কোয়েনা আর কারো – এই তিন নদী নিয়েই মনোহরপুর। মাইনস্ এরিয়া ছাড়িয়ে পথ চলে গেছে সারান্ডার জঙ্গলে। আমাদের গন্তব্য হল সারান্ডার পুণ্ডুল ফলস। আর জঙ্গলের মধ্যে স্বপ্নেশ্বর মন্দির। দিনের বেলাতেও ঝিঁঝির ডাক শোনা যায় এই অরণ্যবাসরে। সেই সঙ্গে ঝরনার কলকল ধ্বণি। বহুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ড্রাইভার বলল সন্ধে না করাই ভালো। হাতির উৎপাত তো আছে, রাজনৈতিক কিছু সমস্যাও আছে। তাই রোদ পড়ার আগেই আমরা গেস্টহাউসের পথ ধরলাম।

ঝরনা দেখে ফিরে এলাম কিরিবুরুর আস্তানায়। পরদিন বারবিল থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে আমাদের কলকাতায় ফেরা। তাই গেস্ট হাউসের হাতায়, জমিয়ে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিলাম সন্ধেটা।