গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ

পর্ব ১

কলকাতা ছাড়াও ভারতবর্ষের আর একটা জায়গাকে সিটি অফ জয় বলা হয়। নাম মাণ্ডু বা মাণ্ডবগড়। মাণ্ডু যে শুধু বাজবাহাদুর আর রূপমতির প্রেমকাহিনীর জন্য বিখ্যাত তাই নয়, প্রায় ৮২ কিমি প্রশস্ত ভারতের বৃহত্তম একটি দুর্গও(জাহাজমহল) আছে এখানে। প্রায় ৮-১০ দিনের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম মধ্যপ্রদেশের উদ্দেশে। আমার এবারের গন্ত্যব্য ছিল মাণ্ডু, মাহেশ্বর, ওমকারেশ্বর হনুমান্তিয়া, উজ্জয়িনী আর ইন্দোর।

সকালে চোখ খুলে ট্রেনের বাইরে তাকাতেই দেখি পাহাড়ের সারি, যার মাথাগুলি দেখে মনে হয় যেন রাশি রাশি ঘুলঘুলি দিয়ে তৈরি। চোখের ভ্রম নাকি কেউ তৈরি করেছে! কিন্তু কেন? খোঁজ নিয়ে জানলাম প্রায় ১০,০০০ বছর আগের গভীর জঙ্গল, গিরিখাত এবং জলপ্রপাত দিয়ে ভরা ছিল এই কাইমুর হিল। মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের কাছে কাটঙ্গির থেকে শুরু হয়ে, বিহারের সাসারামের কাছে শেষ হয়েছে রহস্যে ঘেরা বিন্ধ্য রেঞ্জের পূর্বতম অংশ।


সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে জানলাম, মধ্যপ্রদেশের যে-কোনও জায়গাতেই মহিলা টুরিস্ট সব সময় নিরাপদ ও সুরক্ষিত। ট্রেন ইন্দোরে পৌঁছল রাত তখন প্রায় দুটো। বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রচুর অটো ও গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একজন অটো ড্রাইভারকে হোটেলের নাম বলতেই যেতে রাজি। রাস্তাতে প্রচুর লোকজন আর গাড়ি দেখে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম ইন্দোর কখনও ঘুমোয় না।

পরেরদিন প্রাতরাশ সেরে মাণ্ডুর পথে রওনা দিলাম। ইন্দোর শহর যেমন পরিস্কার তেমনই এর দেওয়ালগুলি দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে এক চিত্র প্রদর্শনশালা। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল প্রচুর উট এবং তাদের ছানা। উট তো মরুভূমিতে দেখা যায় কিন্তু এখানে কেন? চালক সিংজি বললেন, সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত বেশিরভাগ উট এখানেই থাকে। শুধু তাই নয় মাসোহারা দিয়ে ধর জেলার খেতি-জমির মালিকরা, উটের অগ্রিম বুকিং করে রাখে। কারণ উট যে-জমিতে থাকে, সেখানে আলাদা সার দিয়ে মাটি তৈরি করতে হয় না। যেতে যেতে রাস্তাতে বেশ কিছু কেল্লা ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আর জলাশয় চোখে পড়ল, যা ওখানে ‘তালাব’ বলে পরিচিত।

চলে এলাম আফগান স্থাপত্যের জন্যে বিখ্যাত মাণ্ডু শহরের সংস্কৃতির আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক মেলবন্ধনের নিদর্শন মাণ্ডু মহোৎসবে। শুনলাম মধ্যপ্রদেশ টুরিজম বোর্ডের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাতে একটা অস্থায়ী ছোট তাঁবুর শহর তৈরি হয়েছে এখানে উৎসবে আসা পর্যটকদের জন্য।

মুগ্ধ হয়ে এদিক ওদিক দেখছি হঠাৎ একজন জিজ্ঞাসা করলেন কিছু প্রয়োজন কিনা। আমার নাম বলতেই একগাল হেসে বললেন আমিও বাঙালি। ফর্মালিটি সেরে আমার তাঁবু দেখিয়ে দিলেন, সঙ্গে দিলেন কিছু পুস্তিকা আর একটা মানচিত্র। জানিয়ে দিলেন খিদে পেলে রেস্টুরেন্ট আছে খাবার পাওয়া যাবে। তাঁবুতে গিয়ে দেখি সুন্দর ও ছিমছামভাবে সাজানো, সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম।

একটু ফ্রেশ হয়ে প্রায় ১৬ শতকের পুরনো ছাপ্পান্ন মহলে গেলাম, বাজ বাহাদুর আর রূপমতির গল্প শোনার আসরে। ভারতী দীক্ষিতের অসাধারণ গল্প বলার ধরন, সঙ্গে অমর সিং বংশী-বাদকের শান্ত বাঁশির মূর্ছনা, যেন সেই ঐতিহাসিক সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আদিবাসী লোকজ সুরে আমি মন্ত্রমুগ্ধ। বেরিয়ে দেখি প্রবেশদ্বারে, মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সাজানো একটি উট অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

পরের দিন সকালে হেরিটেজ ওয়াক শুরু হল, তাঁবুর শহর থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথ জামে মসজিদ থেকে। বিশালাকায় গম্বুজ-যুক্ত খিলান, উচ্চ স্তম্ভ ও চারদিকে বড় বড় তোরণগুলি, স্থাপত্যকে এক অন্য মাত্রা দেয়।

কথিত আছে স্থাপত্যটি হোসাংশার আমলে শুরু হলেও ১৪৫৪ সালে মুহম্মদ খিলজি শেষ করেন। জাহাজ মহল ও হিন্দোলা মহল যাবার সময়ে, গাইড আফ্রিকা থেকে আসা সুউচ্চ বাওবাব গাছ দেখালেন। প্রায় ১৪ শতক আগে মিশরের খলিফাদের মাধ্যমে মাণ্ডুর সুলতানদের কাছে পৌঁছোয় এই কোকুনটি। হাফসি সম্প্রদায় এই বাওবাব গাছের ফলগুলি নিয়ে আসতেন। ফলের নাম খোরাসানি ইমলি। গরমকালে খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে আর অনেকক্ষণ খিদে বা জল তেষ্টা পায় না।

স্থানীয় বাওবাব ফল খেতে খেতে দেখতে গেলাম দুটি জলাশয়- কাপুর এবং মুঞ্জ তালাব, যার উপর ভাসমান, মাণ্ডুর জাহাজ মহল। জাহাজটি যেন যাত্রা করতে প্রস্তুত। পাথর ও মর্টার দিয়ে তৈরি এই শতাব্দী প্রাচীন জাহাজটি, মাণ্ডুর দীর্ঘ, সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বর্ষাকালে, জলস্তর স্মৃতিস্তম্ভের কিনারায় পৌঁছোয়, যার ফলে এটি একটি সত্যিকারের জাহাজের চেহারা নেয়।

সুলতান গিয়াস উদ্দিন খিলজির প্রায় ১৫,০০০ বেগমের জন্য হারেমটি এমনভাবে নির্মিত হয়েছিল যে, যাতে বাদশা তাঁদের স্বাধীনতার উপর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও তাদের সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে পারেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছি কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খিদেটাও বেশ পেয়েছে। মাণ্ডুতে আমার কাছে প্রথম থেকেই বড় আকর্ষণ ছিল গ্রামীণ লাঞ্চের ব্যবস্থা। কলকাতা থেকে এসে আশেপাশের গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে একটি নির্জন জায়গায় বসে আঞ্চলিক খাবারের স্বাদ নিতে চেয়েছিলাম।

যদিও বেশ কিছু খাবারের আইটেম আমাদের মতো, তবে অতিথিদের জন্য বাজরা রোটি এবং মাখি রোটি, আচার, ডাল বাফলা আর দিশি মুরগির ঝোল বড়ই উপাদেয়।

গাইড জানান বাজ বাহাদুর, ১৫৫৫ থেকে ১৫৬২ সাল পর্যন্ত মালওয়ার শেষ স্বাধীন শাসক ছিলেন। একটি শিকারের সময় বাজ বাহাদুর, রানি রূপমতিকে দেখেন। একাধারে কবি, সুগায়িকা ও অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী রানিকে দেখে, তাঁর কণ্ঠ ও সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যান। রূপমতী সকালে প্রথমে পবিত্র নর্মদা নদীতে প্রার্থনা করতেন। বাজ বাহাদুর রূপমতি মণ্ডপে জলপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য একটি জলাধার তৈরি করেছিলেন। যেহেতু, এই কুণ্ডের জল পবিত্র নর্মদা নদী থেকে এসেছে। তাই মাণ্ডুতে রেওয়া কুণ্ড একটি পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি বাজ বাহাদুর এবং রানি রূপমতির প্রেমের গল্পের জীবন্ত ঐতিহ্য।

১৬ শতকের গোড়ার দিকে বাজ বাহাদুর তৈরি করেন বিশাল প্রাসাদ। এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে একটি বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, যা কক্ষ আর উঁচু সিঁড়ি দিয়ে ঘেরা, যার জন্যে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। আকবরের সেনাপতি আদম খান দুর্গের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বাজ বাহাদুর এই ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে তাঁকে প্রতিহত করেন কিন্তু পরাজয়ের সম্মুখীন হন। তখন রূপমতি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। মালওয়ার শেষ সুলতানের সঙ্গে রূপমতির করুণ প্রেমের বর্ণনা শুনতে শুনতে, সূর্য যে কখন শীতের সন্ধ্যার রাস্তা প্রশস্ত করেছে খেয়াল করিনি।

সন্ধেবেলায় তির্যকভাবে হেলানো হিন্দোলা মহলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো খুবই আকর্ষণীয় ও শিক্ষামূলক- না দেখলেই নয়। দুটি শো হয়, ৭টার সময় হিন্দি আর ৮টায় ইংরেজি।

পরের দিন সকালে সংক্ষিপ্ত গাড়ি যাত্রার পর, আমি ও আটজন অতিথিকে নিয়ে দুঃসাহসিক হট এয়ার বেলুনিং শুরু হল। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দুর্গ, সমাধি এবং আশেপাশের গ্রামগুলো টপ শটে দেখার অভিজ্ঞতা অনেকদিন মনে থাকবে। দেখলাম অনেকেই সাইক্লিং, যোগব্যায়াম এবং ধ্যান সেশন করছেন। কিছু লোকজন আবার মালিপুরার পুরনো গ্রামে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছেন। সন্ধেবেলা থেকে লাইভ কনসার্ট এবং বাদ্যযন্ত্র পারফরম্যান্সেও পর্যটকরা যোগদান করছেন। (চলবে )