• facebook
  • twitter
Wednesday, 19 February, 2025

গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ

ওঁকারেশ্বর সেরে এবারের সফর উজ্জয়িনী আর ইন্দোরে এসে থামবে। মধ্যপ্রদেশের শিল্প, সংস্কৃতি আর সুখাদ্যের স্বাদ নিয়ে এলেন মন্দিরা মিত্র।

পর্ব ৩

স্বাধীনতার পরে ওঁকারেশ্বর মধ্যপ্রদেশের অধীনে চলে আসে। মন্দির ঘুরে চললাম প্রাসাদ দেখতে। বেশ সরু রাস্তা ধরে যেতে যেতে ঘাটের কাছেই ফুলের বাজারে এসে পড়লাম। সেখান থেকে শুরু প্রাসাদের দরজা। মজার কথা হল বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বোধহয় একটাই বাড়ি। কিন্তু ভিতরে গেলে বোঝা যায়, এটি দুটি স্তরের কক্ষ বিশিষ্ট ৩টি বড় উঠোন দিয়ে ঘেরা একটি প্রাসাদ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটি হল কেন্দ্রীয় কক্ষ দরবার। এখানে রাজা অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে সভাপতিত্ব করতেন। এই হলের বৃত্তাকার সিলিংটি ছোট ছোট রঙিন কাচ দিয়ে সাজানো।

দরবার হলের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে ৩টি ঝারোখা আছে। এই বারান্দাগুলি থেকে নিখুঁতভাবে দেখা যায় মন্দির। শহরের চমৎকার দৃশ্য ও সেই সঙ্গে শহরের জনজীবন পর্যবেক্ষণের জন্য একটি অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। সেই রাতটা থাকলাম ওঁকারেশ্বরে। পরের দিন সকালে প্রাতরাশ সেরে বেরোলাম প্রাচীন মামলেশ্বর মন্দির দেখতে। দুটি সেতু এখানে নর্মদাকে খিলানের মতো করে জুড়ে রেখেছে। বাঁদিকের ক্যান্টিলিভার ব্রিজটি ১৯৭৯ সালে তৈরি। ডানদিকের সেতুটি ২০০৩ সালে বড় উৎসবের সময় যাত্রীদের যাওয়া আসার সুবিধার জন্যে ২৩৫ মিটার লম্বা সাসপেনশন ব্রিজ হিসাবে নির্মিত হয়েছিল।

দুপুরে বোটে করে চললাম তিন দিক দিয়ে পবিত্র নর্মদার জল দ্বারা বেষ্টিত এবং ৫ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত সৈলিনি টাপু তে। নিরালায় প্রকৃতিকে উপভোগ করা এবং শান্তিপূর্ণ সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা। অবশ্য রিসোর্টটিকে মধ্যপ্রদেশের একটি জল-অ্যাডভেঞ্চার পর্যটনকেন্দ্র বলা যায়। এখানে স্পিড বোটিং, সার্ফিং, প্যাডেল বোটিং, জেট স্কি এবং মোটর বোটের মতো জল-ভিত্তিক বিনোদনমূলক ক্রিয়াকলাপের সুযোগ আছে। কী অপরূপ মনোরম দৃশ্য! দু’পাশে নর্মদার অনন্ত জলরাশি, সঙ্গে সূর্যের ছটা- যেন মনে হয় কেউ সোনা ঢেলে দিয়েছে! সেই অসাধারণ রাতটা কাটালাম সৈলিনি টাপুতে। পূর্ণিমার রাত, ছাদ থেকে চারপাশ দেখতে দেখতে মনে হল চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো! চারিদিক জ্যোৎস্নাতে আলকিত। সুমন্দ বাতাস সঙ্গে হালকা সুরের মূর্ছনা- সারাজীবনের মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকবে।

পরের দিন ওঁকারেশ্বর থেকে বেরিয়ে পড়লাম মধ্যপ্রদেশের প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে একটির উদ্দেশে। উজ্জয়িনীকে মন্দিরের শহরও বলা হয়, কারণ ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে আরও একটি জ্যোতির্লিঙ্গ হল এই মহাকালেশ্বর মন্দির। এছাড়াও বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ কুম্ভ মেলা- যা প্রতি ১২ বছরে একবার শিপ্রা নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। শেষ কুম্ভ মেলা হয়েছিল ২০১৬ সালে এবং পরবর্তীটি ২০২৮ সালে অনুষ্ঠিত হবে। এই মহাকালেশ্বরের ভস্ম আরতি সারা বিশ্বে অতি জনপ্রিয়। আরতিতে অংশ নেওয়ার জন্য, আপনি যদি গর্ভগৃহের ভিতরে যেতে এবং অভিষেকে অংশ নিতে চান, তবে পোশাকের কোড অনুসরণ করতে ভুলবেন না।

পুরাণে আছে মহাকালেশ্বর মন্দিরটি প্রজাপতি ব্রহ্মা তৈরি করেন। মন্দিরটি পরে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর শাসনকালে পুনর্নির্মাণ করেন। শতাব্দী ধরে মন্দিরটির অনেকেই সংস্কার ও সংযোজন করেছেন এবং বিভিন্ন শাসক তাঁদের স্থাপত্যর চিহ্ন রেখে গেছেন।

জ্যোতির্লিঙ্গগুলিকে ভগবান শিবের মহাজাগতিক শক্তি এবং সৃজনশীল শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে পূজা করা হয়। ‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ- সময় ও মৃত্যু। বিশ্বাস অনুসারে ভগবান শিব মৃত্যু ও সময়ের দেবতা, তাই তাঁকে মহাকালেশ্বর বলা হয়। এর দক্ষিণমুখী বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি ‘দক্ষিণ মূর্তি’ নামেও পরিচিত। এই শহরটিকে ভারতের গ্রিনউইচ বলে বিবেচনা করা হয় কারণ এর মধ্য দিয়েই দ্রাঘিমাংশের প্রথম মেরিডিয়ানটি চলে গেছে। ওখানে পৌঁছে দেখি অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন কপালে মহাজাগতিক শক্তিকে এঁকে দেবেন বলে।

এরপর চললাম পুরাতন রুদ্র সাগর লেক দিয়ে ঘেরা উজ্জয়িনীর বিখ্যাত মহাকালেশ্বর মন্দির দেখতে। এই মহাকাল করিডোরের মোট দৈর্ঘ্য ৯০০ মিটারেরও বেশি। করিডোরে দুটি বড় প্রবেশপথ রয়েছে নন্দী ও পিনাকী আর ১০৪টি পিলার রয়েছে, যার উপর শিবের বিভিন্ন ভঙ্গি তৈরি করা হয়েছে। রাতের রঙিন আলোতে এটি অত্যাশ্চর্য দেখায়। এখানের সুবিধে হল আরতি বা শৃঙ্গারের সময় ছাড়া নিয়ম মেনে গর্ভগৃহতে গিয়ে জ্যোতিরলিঙ্গ স্পর্শ করা সম্ভব।

অসাধারণ মন্দির ও বিগ্রহ দর্শন করে বেরোলাম। উজ্জয়িনীতে দেখার মতো আরও কিছু মন্দির— হরসিদ্ধি মন্দির, গোপাল মন্দির, চিন্তামন গণেশ মন্দির, চারধাম মন্দির, মঙ্গলনাথ মন্দির, বড় গণপতি মন্দির, নবগ্রহ মন্দির এবং কাল ভৈরব মন্দিরের রয়েছে। ওখানে কথা বলে জানতে পারলাম যে, কালভৈরব মন্দিরে ভক্তরা প্রসাদ হিসাবে দেবতাকে মদ নিবেদন করে।

দুপুরের খাওয়া সারলাম ডাল বাফলে, আসাধারণ লাড্ডু, খাস্তা সেভ আর চাল দিয়ে বানানো পোহা দিয়ে। সেদিনই সন্ধ্যেবেলা ফিরে এলাম মধ্যপ্রদেশের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল শহর ইন্দোরে।

ইন্দোর শুধু যে ১৯ শতকের ঐতিহাসিক হোলকার রাজবংশের সদর দফতর হিসাবেই বিখ্যাত তাই নয়, দ্রুত শিল্পায়ন সঙ্গে তুলো ও তাঁত শিল্প, প্রাসাদ, ছাপ্পান্ন দোকানের খাবার এবং রাতের সারাফা বাজারের জন্যও এর খ্যাতি। একটা রাত ইন্দোরে ছিলাম এই শহরটিকে উপভোগ করার জন্য।

পরের দিন সকালে হোটেলে প্রাতরাশ সেরে বেরলাম মিনি মুম্বাইকে(ইন্দোর) ভালো করে দেখতে। যদিও বাস আছে, তবু একটা গাড়ি ভাড়া করে গিয়েছিলাম পুরনো ইন্দোরের রাজওয়াড়া প্রাসাদে। এই প্রাসাদে ঢুকতে কোনও বাইরের প্রাচীর পেরতে হয় না। অন্য হোলকার রাজবংশের প্রাসাদগুলির মতোই, এই সাততলা রাজওয়াড়ার সম্মুখভাগটি খুব জাঁকজমক পূর্ণ। খানিকটা ঢুকেই একটি বিস্তীর্ণ উঠান ও তোরণযুক্ত গণেশ হল, যেটি একসময় রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক কার্যক্রমের সাক্ষী ছিল। এরপর প্রথম তলায় নতুনভাবে মার্বেলের মেঝে দিয়ে সাজানো দরবার হল। পিছনের অংশটি তুলসী কুণ্ড এবং গণেশ কুণ্ড দিয়ে ঘেরা। ১৮৩২ সালে কৃষ্ণ বারি হোলকার দ্বারা নির্মিত পারিবারিক দেবতা মলহারি মার্তন্ডের একটি ছোট মন্দিরও রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগছিল এক সময়ের রাজমাতা অহল্যাবাইয়ের সদর দফতর বা মারাঠা আর্মিদের আস্তানা এখন কিছু মানুষের দুপুরের ঘুমের জায়গা।

ওখান থেকে বেরিয়ে চললাম রাজ ওয়াদার ঠিক পিছনে সারাফা বাজারে। এখানে কিন্তু যেতেই হবে। এই সারাফা বাজারটির মজার ব্যাপার হল জায়গাটি রুপোর গহনা আর ইন্দোরি সেভের জন্য বিখ্যাত। ওখানে মাহেশ্বরী, চান্দেরি বা বাঘ প্রিন্টের শাড়ির দোকানও চোখে পড়ল। কিন্তু রাস্তাগুলি এতটাই সরু যে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। এই বাজারে আটটার পর জিভে জল আনা বিভিন্ন ধরনের চাট ও সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যায়। সেই সময় এটি খাদ্যরসিকদের আড্ডাস্থল হয়ে ওঠে। রাতভর চলে আড্ডা। ওই যে লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ইন্দোর কখনও ঘুমোয় না। পরের দিন ইন্দোর থেকে সরাসরি বিমানে কলকাতা পৌঁছলাম।
(সমাপ্ত)