• facebook
  • twitter
Monday, 31 March, 2025

যোশীমঠ, আউলি, বদ্রীনাথ ধাম, মানাগ্রাম

গ্রামের মধ্যে কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়েগেছে, বাঁদিকে ভীমপুল আর ডানদিকের রাস্তা গণেশ ও ব্যাসগুফার দিকে গিয়েছে।

ফাইল চিত্র

শম্পা চৌধুরী

সুস্থতা হল জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ…

নিজে ভালো আছি, বাড়ির সকলে সুস্থ এই কথাটার মধ্যেই একটা জীবনীশক্তি লুকিয়ে থাকে। এই শরীর-মনকে সুস্থ রাখতে গেলে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়া দরকার। আমি প্রথম যোশীমঠ, মানাগ্রাম গিয়েছিলাম কলেজ excursion-এ, ভূগোলের ছাত্রী হওয়ার জন্য। তবে পরবর্তীকালে গিয়ে যা দেখলাম তার বর্ণনা আজ করব।

হাওড়া স্টেশন থেকে উপাসনা, কুম্ভ বা দুন এক্সপ্রেস এ হরিদ্বার নামতে হবে প্রায় ত্রিশ ঘন্টার জার্নি। বিমানে দেরাদুন এয়ারপোর্ট নেমে গাড়ি ধরে হরিদ্বার যাওয়া যায়, গাড়ি ভাড়া ১০০০/১২০০ টাকা। হরিদ্বার কথার অর্থ হলো ভগবানের দ্বার, সন্ধ্যার সময় হর কি পৌঁরীতে মা গঙ্গার আরতি দর্শন করলাম। পরের দিন ভোরবেলা আমরা হরিদ্বার থেকে যোশীমঠ রওনা হলাম, দূরত্ব ২৪৫ কিমি, গোপেশ্বর পেরিয়ে বদ্রীনাথ হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চললো আমাদের গাড়ি, রাস্তার বাঁদিকে অলকানন্দা নদী। এই নদী সঙ্গ দেবে বদ্রীনাথ পর্যন্ত। কিছুদূর এগিয়ে পড়ল বিরহী গঙ্গা ও অলকনন্দার সঙ্গমস্থল। এই পথে অনেক ছোট ছোট নদী অলকনন্দায় এসে মিশে জলপ্রবাহ বৃদ্ধি করেছে।

বর্তমানে পাহাড়ি পথেও জ্যাম যন্ত্রনা শুরু হয়েছে, আমাদের যোশীমঠ পৌঁছতে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো। একটা কথা বলে রাখি আজ সমগ্র যোশীমঠ কিন্তু বিপর্যস্ত, গোটা এলাকাটাই সিংকিং জোন বলে চিহ্নিত, এইজন্য দায়ী বেআইনি নির্মাণ, নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংস, অলকনন্দার উপর তপোবন ও বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন, বদ্রীনাথের দূরত্ব কমাতে বাইপাস নির্মাণ। এই দেবভূমিতে বিকাশই ডেকে এনেছে বিনাশ। যাহোক, পরের দিন সকালে উঠে যোশীমঠ দর্শনে গেলাম। যোশীমঠ চামোলি জেলায় অবস্থিত, উচ্চতা ৬১৫০ ফুট, যোশীমঠে দাঁড়িয়ে ডানদিকে স্লিপিং লেডি মাউন্টেন ও বামদিকে হাতি পাহাড় অবস্থিত, বদ্রীনাথের দিকে মুখ করে অল্প এগোতেই রাস্তার বাঁদিকে নৃসিংহদেবের মন্দির, এই মন্দিরে রয়েছে ভগবান বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার মূর্তি, বদ্রীনারায়নের শীতকালীন আবাস হলো এই মন্দির।
যোশীমঠ দুটি কারণে বিখ্যাত প্রথমত আদি গুরু শঙ্করাচার্য্য প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১২০০ বছরের পুরাতন নৃসিংহ মন্দির। দ্বিতীয়ত উওর ভারতের অন্যতম জ্যোর্তিমঠ আদি গুরু এখানে স্থাপন করেন।

মন্দিরে স্থাপিত ভগবান নৃসিংহ অবতারের ডান হাতটি চুলের মতো পাতলা হয়েগেছে বর্তমানে, কথিত আছে যেদিন ডানহাতটি খসে পড়বে সেদিন বদ্রীনাথ ধ্বংস হয়ে যাবে তারপর যোশীমঠ থেকে ১০ কিমি দূরে ভবিষ্য বদ্রী মন্দিরে ভগবান বদ্রীবিশাল পূজিত হবেন।

এই মন্দিরের পাশে রয়েছে শ্রী বাসুদেব, অষ্টাদশ গণেশ, নবদূর্গা ও গৌরীশঙ্কর মন্দির। সকল মন্দিরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ।
প্রায় বারোশ বছর আগে আদিগুরু শঙ্করাচার্য্য হিন্দুধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠ স্থাপন করেন,পূর্বদিকে পুরীতে গোবরধন মঠ, পশ্চিমে দ্বারকাতে সারদা মঠ, দক্ষিণে কর্নাটকে শ্রীংগিরি মঠ, উওরদিকে জ্যোর্তিমঠ। প্রকৃত পক্ষে এই জ্যোর্তিমঠ কথাটাই অপভ্রংশ হয়ে যোশীমঠে পরিবর্তিত হয়। মূল জ্যোর্তিমঠ ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই বাঁদিকে রয়েছে শঙ্করাচার্য্যের পুরানো গদিস্থল ও পূর্ণাগিরি দেবীর মন্দির, এর সামনে একটি ফটক পেরিয়েই রয়েছে তূঁত গাছের তলায় প্রায় পঁচিশশো বছরের পুরানো শিব মন্দির। এই মন্দিরের ভেতর রয়েছে সেই অর্নিবাণ জ্যোতি যার জন্য স্থানটির নাম জ্যোর্তিমঠ। এই জ্যোতি হলো জ্ঞানের জ্যোতি, আদি গুরু তূঁত গাছের তলায় জ্ঞান লাভের পর এই স্থানে জ্যোতি জ্বালান, সেই জ্যোতি আজও জ্বলছে।

এরপর দ্বিতীয় দিন আমরা গেলাম আউলি, যোশীমঠ থেকে আউলির দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। গাড়িভাড়া করে যাওয়া যায়, বর্তমানে রোপওয়ে পরিষেবা চালু হয়েছে মাত্র পঁচিশ মিনিটে টপ টেন পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। তবে আউলিতে থাকতে গেলে পয়েন্ট আট-এ নামতে হবে, ওখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। আউলিকে ভারতের সুইটজারল্যান্ড বলা হয়, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বরফে ঢেকে থাকে। আউলি লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম,বরফের উপর অনেকে ক্যাম্পে থাকেন। এইস্থান স্নো বাইকিং, স্কিইং-এর জন্য এখন বিখ্যাত।

তৃতীয় দিন আমারা বদ্রীনাথ দর্শনে গেলাম, যোশীমঠ থেকে বদ্রীনাথের দূরত্ব ৪২ কিমি, বদ্রীনাথের দিকে ১৪ কিমি এগোতেই প্রথমে পঞ্চ প্রয়াগের অন্যতম প্রয়াগ বিষ্ণু প্রয়াগ, অলকনন্দা নদী এখানে ধৌলিগঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে, এখানকার উচ্চতা ৪৫০০ ফুট। কথিত আছে এখানে দেবর্ষি নারদ কঠোর তপস্যা করে ভগবান বিষ্ণুর দর্শন লাভ করেন।
যোশীমঠ থেকে ২৮ কিমি দূরে অলকনন্দার উপর বাঁধ দিয়ে বিষ্ণুপ্রয়াগ হাইড্রোইলেট্রিক প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়, এখানে প্রায় চারশো মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এরপর হনুমান চোটি পার করে গাড়ি বেশ কিছু হেয়ার পিন বাঁক নিয়ে ওপরে উঠতে থাকলো, এই সময় অলকনন্দা নদীকে ওপর থেকে সরু সবুজ ফিতের মতো দেখতে লাগে। গাড়োয়াল হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বিকেলের মধ্যেই বদ্রীনাথ শহরে পৌঁছে গেলাম। পরের দিন সকালে বিশালবদ্রী মন্দির দর্শনে গেলাম, গড়োয়াল হিমালয়ের ১০,১৭০ ফুট উচ্চতায় উওরাখন্ডের চামোলি জেলায় অবস্থিত এই মন্দির। নর ও নারায়ণ এই দুই পর্বতের মধ্যে মন্দিরটি অবস্থিত, মন্দিরের চারপাশের প্রাকৃতিক শোভা খুব সুন্দর, আকাশ মেঘমুক্ত থাকার ফলে নীলকন্ঠ পর্বতের শ্বেত সুভ্র চূড়া দর্শন হলো।

অলকনন্দার ওপর একটি ছোট পুল পেরিয়ে আমরা মন্দিরে প্রবেশ করলাম, মন্দিরের নীচের দিকে বাঁহাতে রয়েছে তপ্তকুণ্ড, এই কুন্ডে স্নান করে সকলে মন্দিরে পূজো দেয়। কুণ্ডের জল শীতকালে অতি ঠান্ডাতেও ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। কথিত আছে আদিগুরু শঙ্করাচার্য্য অলকনন্দা নদীতে বদ্রীনাথের মূর্তি (কালো পাথরের শালগ্রাম শিলা) খুঁজে পান প্রায় ১২০০ বছর আগে। তিনি সেই মূর্তি তপ্তকুণ্ডের পাশে একটি গুহায় স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ষোড়ষ শতাব্দীতে গড়োয়ালের রাজা মূর্তিটিকে বর্তমান মন্দিরে স্থাপন করেন। মন্দিরের বাইরের দ্বারটি নানারঙের বৌদ্ধ বিহারের মতো, ভিতরের গর্ভগৃহে রয়েছেন বদ্রীবিশাল। বদ্রীনাথের প্রধান পুরোহিতরা হলেন দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের নাম্বুদিরি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ। গাড়োয়ালের মোট সাতটি মন্দিরকে একত্রে বলা হয় সপ্তবদ্রী, বদ্রীনাথ হলো মূল মন্দির। পূজো দেওয়ার লাইন দীর্ঘ হলেও পরিচালনা পদ্ধতি বেশ উন্নত, খুব ভালোভাবেই দেবদর্শন হল।

পরের দিন আমাদের শেষ দর্শনীয় স্থান মানাগ্রাম দেখতে গেলাম, যে পথ দিয়ে পাণ্ডবরা দ্রৌপদী সহ মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেছিলেন আমরা সেই পথের উদ্দেশ্যেই রওনা হলাম। ভারত ও চীন সীমান্তের শেষ গ্রাম হলো মানাগ্রাম, বদ্রীনাথ থেকে দূরত্ব চার কিলোমিটার, গাড়িতে পৌঁছতে সময় লাগে তিন ঘণ্টার মতো। মানাগ্রাম থেকে তিব্বত-চীন সীমান্ত মাত্র আঠাশ কিলোমিটার দূরে, এই গ্রামের উচ্চতা ১০,৫০০ ফুট। এখানকার লোকজন ভুটিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত, কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, পশুপালন এদের প্রধান জীবিকা।

উচ্চতা ও জলবায়ুর তারতম্যের কারণে উওরাখণ্ডের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে ওক, ফার, বার্চ প্রভৃতি বৃক্ষ, নিম্ন পার্বত্য অঞ্চলে শাল, খয়ের, রক্তকাঞ্চন প্রভৃতি গাছ দেখা যায়। উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে জুলাই হলো উষ্ণতম মাস, ২১ ডিগ্রি থেকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, নিম্ন অঞ্চলে মে মাস সবচেয়ে উষ্ণতম মাস, উষ্ণতা ২১ ডিগ্রি থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়।
কলেজে পড়ার সময় এই মানা গ্রামে ডোর-টু-ডোর সার্ভে করেছিলাম, তখন এখানে শুধুমাত্র নিম্নমানের আলুর চাষ হতো, এখন গম, সোয়াবিন, চীনাবাদাম, ফলের মধ্যে আপেল, কমলালেবু, ন্যাসপাতির বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।

মানা গ্রামটি খুব পরিষ্কার, বিভিন্ন দোকান ও বাড়ির গায়ে পঞ্চপাণ্ডব, শিব-পার্বতী, হিন্দু দেব-দেবীর ছবি দিয়ে সুন্দর করে সাজান। ২০২২ সালের অক্টোবরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মানা সহ প্রান্তিক গ্রামগুলিকে সীমান্তের দিকথেকে প্রথম গ্রাম বলে উল্লেখ করেন। মানা অতি প্রাচীন গ্রাম। কথিত আছে এই গ্রামের ইতিহাস ৫০০০ বছরের পুরানো। হিন্দু পুরাণে মনিভদ্রপূরম নামক এক স্থানের উল্লেখ আছে, যেখানে বসে বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেন, এছাড়াও রচিত হয়েছিল ১৮ টি পূরাণ, মনে করা হয় এই মনিভদ্রপূরমই হলো আজকের মানাগ্রাম। বেদব্যাস মহাভারত রচনার সময় গনেশজি তা লিপিবদ্ধ করেন।

গ্রামের মধ্যে কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়েগেছে, বাঁদিকে ভীমপুল আর ডানদিকের রাস্তা গণেশ ও ব্যাসগুফার দিকে গিয়েছে। গনেশগুফার বাইরের দিকটা মন্দিরের মতো, এর ওপরের অংশে উচুঁ এক খাঁজকাটা পাথরের নীচেই ব্যাসগুফা।

এই খাঁজকাটা পাথর দেখলে মনে হয় বই এর পাতা পরপর সাজানো, এইজন্য এই পাথরকে বলা হয় ব্যাসপুঁথি। এখানে ভারতের শেষ চায়ের দোকান রয়েছে, কনকনে ঠান্ডাতে সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে বসে ভারতের শেষ প্রান্তের দোকানের চায়ের স্বাদ অনুভব করলাম। হঠাৎ অল্প অল্প বৃষ্টিপাত শুরু হলো, পাহাড়ে এটা হয়েই থাকে তাই ছাতা সঙ্গে রাখা দরকার। দেখলাম ব্যাসগুফা থেকে সোজা একটা রাস্তা নীচের দিকে নেমে ভীমপুল যাওয়ার রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। এখানেই ওপর থেকে প্রবল স্রোতের সঙ্গে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে সরস্বতী নদী, এই নদীর গতিপথে দুপ্রান্তের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী বিশাল শিলাখন্ডটি হলো ভীমপুল। কথিত আছে পান্ডবরা এই পথে স্বর্গে যাওয়ার সময় দ্রৌপদী সরস্বতী নদী অতিক্রম করতে না পারায় ভীম বিশাল শিলাখন্ড নদীর উপর ফেলে রাস্তা তৈরি করেন, যা ভীমপুল নামে পরিচিত। খুব সুন্দর মা সরস্বতীর মন্দির রয়েছে এখানে, এইখানেই একমাত্র সরস্বতী নদী দৃশ্যমান, এরপর নদী ভীমপুলের নীচ দিয়ে সামান্য দূরে প্রবাহিত হয়ে অলকনন্দা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, দুই নদীর মিলনস্থলের নাম কেশবপ্রয়াগ। ভীমপুল পেরিয়ে উপরের রাস্তায় একটি সাদা তোরণ রয়েছে, তাতে লেখা স্বর্গারোহণ মার্গ। এই পথেই পাণ্ডবরা স্বর্গে যাত্রা করেন। এই পথেই ৫ কিলোমিটার গেলে বসুধারা ফলস এবং তার থেকেও দূরে শতোপন্থ লেক।

এইসব স্থানে ট্রেক করে যেতে হয়, সাধারণ ভ্রমনার্থীদের জন্য নয়। তাই আর স্বর্গে যাত্রা না করে মর্তে প্রত্যাবর্তন..

News Hub