একটা নির্জন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা পরিবেশে মনের অবসন্নতা কাটানোর জন্য চলে গেলাম মেঘালয়ে। এরাজ্যের প্রাণকেন্দ্র শিলং যেন নিসর্গের ক্যানভাসে কোনও এক চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঁকা এক অপূর্ব ছবি। আঁকাবাঁকা পথের একদিকে অতল খাদ, আরেক দিকে খাড়া পাহাড়ের গায়ে সবজে ইস্তেহার। পথের মাঝেই পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে অজানা ভয়। কিন্তু প্রাণঘাতী পথও যে অনেকসময় নতুন সম্পর্কের সূচনা করে তা দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই পথের বাঁকেই হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল অমিত আর লাবণ্যর। বাংলা সাহিত্যের চিরন্তন প্রেমের কাব্যগাথা ‘শেষের কবিতা’, যার প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত ছিল শিলংয়ের মেঘমাখা মায়াবী পথ, রংবেরঙের পাহাড়ি ফুল, ঝর্না- যেন মেঘদূতের কল্পলোকের অলকাপুরী। এই সৌন্দর্য আগেও কয়েকবার প্রত্যক্ষ করেছি। তাই একে একটু অন্যভাবে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম আবার।
মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টির রাজ্যকে রবি ঠাকুর সার্থক নামই রেখেছিলেন। বর্ষা ও তার পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে শরৎকালের শেষপর্বে এই অপরূপ রাজ্য তার পূর্ণযৌবন কীভাবে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরে সেটা দেখতে চেয়েছিলাম। তাই আগের বার শিলং-চেরাপুঞ্জিতে এসে যে জায়গাগুলোতে গিয়েছিলাম এবারের ভ্রমণসূচিতে সেই জায়গাগুলো বাদ দিয়েছিলাম। পরিবর্তে ভ্রমণসূচিতে ছিল কিছু স্বল্পপরিচিত জায়গা যার মধ্যে অন্যতম ছিল মেঘালয়ের প্রধান আকর্ষণ ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। মেঘালয়ে অনেকগুলো লিভিং রুট ব্রিজ রয়েছে। তাদের মধ্যে মাওলিনংয়ের সিঙ্গেল রুট ব্রিজ পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়। কিন্তু পূর্ব খাসি পাহাড়ে চেরাপুঞ্জির নংরিয়াত গ্রামে একটি ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ আছে, যেখানে ট্রেকিং করে পৌঁছতে হয়। একটু কষ্টসাধ্য হলেও এখানকার চারপাশের দৃশ্য সারাজীবন মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে।
আগের দিনই বিকেলে এসে পৌঁছেছি চেরাপুঞ্জিতে। পরদিন হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে সকালের হালকা হিমেল হাওয়া আর মিঠে রোদ মেখে সবুজ সতেজ পাহাড়, ছোট ছোট ঝোরা, দোকান আর ঘর-বসতি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই সেই গ্রামে যেখান থেকে ট্রেকিং শুরু হবে। গ্রামের নাম ‘তিরনা’ শুনে, ছোট্ট একটি মিষ্টি মেয়ের মতোই সুন্দর বলে মনে হয়েছিল। সোহরা বাজার থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গ্রামটিতে এসে, ভাবনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়ায়, মনের পালে খুশির হাওয়া লাগল।
প্রায় ৩৬০০টি সিঁড়ি হেঁটে মূল জায়গায় পৌঁছনোর জন্য প্রবেশমূল্য নিল মাথাপ্রতি ৫০টাকা। স্থানীয় লোকেরাই এখানে গাইডের কাজ করে। যদিও সেভাবে গাইডের প্রয়োজন পড়ে না ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ পৌঁছতে। তবে প্রাকৃতিক সুইমিংপুল রেইনবো ওয়াটার ফলসে যেতে গেলে গাইডের প্রয়োজন। আমরাও দরদাম করে একজন গাইড নিয়ে নিলাম। আসলে পর্যটকদের আগমনে এও এক রোজগারের পন্থা। যেহেতু এখানে উপার্জন করার অন্য কোনও উপায় নেই, তাই এই মরশুমে এই রোজগারই তাদের একমাত্র সম্বল। গাইড কথায় কথায় জানালেন সকাল সকাল যদি কেউ ট্রেক করতে আসেন তাহলে তারা দিনে দু’বার ট্রিপ পেয়ে যান। আজ যেহেতু অনেকটা বেলায় উনি গাইডের কাজ শুরু করেছেন তাই শুধু আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।
পথে যেতে যেতে দু-একটি ছোটখাটো ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে যাত্রা শুরু করলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম আমাদের গাইডের নাম বর সিং। উমসিয়াং নদীর খাতে অবস্থিত এখানে ছোট্ট দুটি গ্রাম আছে। গাইডের খাসি উচ্চারণে একটির নাম লাকিনসিউ আর অপরটি নংরিয়াত। এই দুটো জায়গারই নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু আনতে গেলে নিকটবর্তী শহর চেরাপুঞ্জিতে যেতে হয় অথবা শিলং বাজারে। তাদের জীবন এতটাই কষ্টের যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও নিচের সেই গ্রাম থেকে চারজনের কাঁধে চেপে ‘ডোলি’তে করে আসতে হয়। তবে ডোলি বলতে আমরা যে ধরনের জিনিস উত্তরাখন্ডে দেখেছি এ ব্যবস্থা কিন্তু সেরকম নয়। শুধুমাত্র বাঁশের দুটো দন্ডের মাঝখানে একটি চাদর লাগিয়ে সেটাকেই ‘ডোলি’ নাম দেওয়া হয়েছে।
তিরনা গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পৃথিবীর বিস্ময়কর এই ব্রিজ। সেটা দেখতেই এবার আসা। উৎরাইয়ের রাস্তায় চলা শুরু করলাম। যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছি তখন দু’পাশের সারি সারি ঘন চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি দাঁড়িয়ে যেন গার্ড অফ অনার দিচ্ছে তার এলাকায় আসা পর্যটকদের। পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি, নৃত্যরত রংবেরঙের প্রজাপতি আর মেঘালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরোহিত পোকার ঘন্টাধ্বনির অনবরত শব্দতরঙ্গ। সিঁড়ি কোথাও খুবই খাড়াই, কোথাও খুব সরু, এক পা সোজাসুজি সঠিকভাবে রাখা যায় না। ডান-পা কিংবা বাঁ-পা পাশাপাশি রেখে এদিক-ওদিক করে নামতে হয়। নামার সময় খুব একটা অসুবিধা না হলেও সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে এগোতে হয়। আর বৃষ্টি হলে তো কোনও কথাই নেই। সিঁড়ি প্রচন্ড পিচ্ছিল তো হয়ই তার সঙ্গে প্রতি পদে পদে থাকে বিপদের সম্ভাবনা। এদিক থেকে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। অতিরিক্ত গরমে কষ্ট হয়েছে ঠিকই তবে বৃষ্টির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যে একদিকে ভালোই হয়েছে সেটা বলতেই হয়।
তবে ডাবল ডেকার ব্রিজের অর্থ দুটো তলার ব্রিজ। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতানুযায়ী সারাপৃথিবীতে এরকম ব্রিজ একমাত্র মেঘালয়েই আছে। নির্মাণের অভিনবত্বের জন্য ইউনেস্কো থেকে হেরিটেজ তকমাও দেওয়া হয়েছে একে। ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়া পৃথিবীর সর্বাধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হওয়া সেই বিখ্যাত জায়গা চেরাপুঞ্জি। বর্তমানে মৌসিনরাম সেই স্থান দখল করলেও চেরাপুঞ্জির এই জায়গা অত্যধিক বৃষ্টিপাত এবং ট্রপিকাল ফরেস্টের জন্য প্রাকৃতিকভাবেই অত্যন্ত দুর্গম। এই কারণে এখানে বসবাসকারীদের পক্ষে নদীর ওপর দিয়ে যাতায়াত করা অত্যন্ত অসুবিধাজনক। কিন্তু যেখানে অসুবিধা সেখানেই প্রকৃতি বোধহয় স্বয়ং হাজির হয়ে যায় ত্রাতা হিসেবে। এখানে উমসিয়ং নদীপ্রবাহকে ঘিরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক বিশেষ প্রজাতির ভারতীয় রবারগাছ তার শিকড় ছড়িয়ে প্রায় ২০ মিটার লম্বা আর ২৪০০ ফুট উচ্চতায় মনুষ্য প্রজাতির অলক্ষেই এক বিস্ময়কর জিনিস তৈরি করে রেখেছিল। নানারকম পদ্ধতিতে এই রবারগাছের মোটা শিকড়গুলিকে স্থানীয় গ্রামবাসীরা একটি বিশেষ দিক নির্দেশ করে বেঁধে দেয়। সেই অনুসারে শিকড়গুলি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে মানুষের উপযোগী যাতায়াত করার জন্য ব্রিজগুলো তৈরি হতে সময় নেয় প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর।
তথ্য অনুযায়ী এই ব্রিজটি প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। এ পথে ডাবল ডেকার ছাড়াও আরও কয়েকটি সিঙ্গেল রুট ব্রিজ দেখা যায়। উমনোই, রিতম্মেন, উমকার এবং মাওইয়াসাও রুট ব্রিজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৪ মিটার লম্বা আর ১৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত উমনোই ব্রিজটি একটি কাঠের পাঠাতনের সঙ্গে রবার গাছের মোটা শিকড় বেঁধে তৈরি করা হয়েছে। এখানে প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ৪০ টাকা। একসঙ্গে তিনজনের বেশি যাওয়া যায় না। নিচে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর একদম কাছে চলে যাওয়া যায়। রাস্তায় চলার পথেই পড়ল লোহার তারের তৈরি সরু সাসপেনশন ব্রিজ। এটি পার হওয়ার সময় এমন ভয়ংকরভাবে দুলতে থাকে মনে তখন ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীর চারপাশে বড় বড় বোল্ডার ছড়িয়ে রয়েছে। এরপর আরও একটি লোহার ব্রিজ পেরোতে হয়। তবে সেটা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই চওড়া।
মাঝে মাঝে ক্ষণিকের বিরতি নিচ্ছিলাম চা-কফি-ম্যাগি খাওয়ার জন্য। একসময় পথের ক্লান্তি শেষে পৌঁছে গেলাম সেই অপরূপ সুন্দর রুট ব্রিজের সামনে। দূর থেকে তার একটু ঝলক দেখতে পেয়ে বুকের মধ্যে এক অনাবিল আনন্দের বুজকুড়ি কাটতে থাকে। এত কষ্ট করে এসে চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আর ভাবতে থাকি প্রকৃতি-মানুষের মেলবন্ধনে এই আশ্চর্যকর সৃষ্টির কথা। ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে সুন্দর জলপ্রবাহ। দোতলা প্রাকৃতিক ব্রিজ আর জলাধারের এক দুর্দান্ত কোলাজ একসঙ্গে দেখতে পেয়ে শরীরের ক্লান্তি যেন একমুহূর্তে কোথায় উধাও হয়ে যায়।
শরীর পরিশ্রান্ত হলেও জল দেখে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আমার শিশুমন উদ্বেল হয়ে ওঠে। অনেকেই জলের মধ্যে নেমে সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। মোবাইলবন্দি করলাম চারপাশের বিভিন্ন দৃশ্য। জলের মধ্যে মাছেদের সঙ্গে খেলা করার দৃশ্য দেখে মনে হল এ-ও যেন এক প্রাকৃতিক জাকুজি। তবে মনে রাখতে হবে জল থেকে উঠে ফেরার সময় কিন্তু চড়াইয়ের কঠিন রাস্তা। এখানে বেশ কয়েকটা হোমস্টে আছে। অনেকে রাত্রিবাস করেন। আমাদের রেইনবো ফলসের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কিছুদিন আগে বর্ষায় রাস্তা অতিরিক্ত খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্য গাইড যেতে না করলেন। তাই কিছুক্ষণ এখানে থেকে ফেরার জন্য রওনা দিই।
শুরু হল কঠিন চড়াইয়ের সিঁড়ি ভাঙা। নামার সময় যতটা সময় লেগেছিল খুব স্বাভাবিকভাবেই ওঠার সময় অনেকটা বেশি সময় লাগছে। অত্যন্ত মানসিক জোর এবং স্ট্যামিনার প্রয়োজন এই ডাবলডেকার রুট ব্রিজ ট্রেকিংয়ের জন্য। কিন্তু প্রকৃতির কাছেই তো প্রতিমুহূর্তে সহনশীলতার সহজপাঠ নিয়েছি। তাই মনের মধ্যে আবার শক্তি সঞ্চয় করে নতুন উদ্যমে এগোতে থাকি। উপরে এসে যখন পৌঁছলাম তখন পিছন ফিরে সেই যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে, প্রকৃতি আর মানুষের আশ্চর্য মেলবন্ধনে সেই অপূর্বসুন্দর সৃষ্টিকে মনে মনে আরও একবার কুর্নিশ জানালাম। এখানে আসার কিছু মুহুর্ত চিরকালীন সঞ্চয় হয়ে থাকল।