মালঙ্গী পাড়ের বৃত্তান্ত

রোজনামচার কোলাহল থেকে দূরে অনেকখানি সবুজ, অনেকখানি নির্জনতাকে সাক্ষ্য করি– নিসর্গের কাছে হাঁটু গেড়ে উদাত্ত গলায় বলতে ইচ্ছে করে ‘অসাধারণ’! আলতো পরশ রেখে যায় অরণ্যভূমের মজলিস। ক্ষীণকায়া মালঙ্গীর নদীজল ও সবুজ গাছেদের গরিমা। তরাইয়ের জঙ্গল যতটা গভীর,ততটা নিবিড়ও। কতবার যে ছুটে ছুটে চলে আসি উত্তরবঙ্গের অফুরন্ত সবুজের বিস্তারে, চাবাগানের সবজে সোহাগ আঁকা মধুর পথে, নদীসমুহের জালবোনা অরণ্যভূমে! মালঙ্গী নদীর লাবণ্যঘেঁষা প্রকৃতিসম্ভার। জঙ্গলের নিজস্ব ঠমক ও চিরহরিৎ ক্যানভাস, পাখির ঠোঁটে সারাক্ষণ রঙিন কূজন আর মালঙ্গী নদীজলে আনন্দ খোঁজার বাড়তি কৌতুহল। বন আবাস, বৃংহণ, ঝিঁঝিরঁ ডাক, লতাগুল্মের বুনো গন্ধ, শ্বাপদের আনাগোনা – এসবই আমার ডায়েরির পাতায় টুকে রাখার কিছু প্রেরণা ও প্রয়াসমাত্র।

দু’রাতের জিরেন নিই মালঙ্গী বন আবাসে। রোজনামচা ছেড়ে চমৎকার বিশ্রাম। জলের বাহার খেলছে মালঙ্গী নদীতে। দু’দিনের নিশিযাপন। সূর্যটা জঙ্গলের শেষে ডুবকি লাগায়। গাছে গাছে ফিরে আসে কোলাহলমুখর পাখির ঝাঁক। ডানা ঝাপটায়। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে জঙ্গুলে বাতাবরণের মৌতাত নিচ্ছি তারিয়ে তারিয়ে। ক্রমে যে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে টের পাইনি। পা ঝুলিয়ে বসে আছি বন আবাসের হাতার কিছুটা বাইরে, পোষা হাতির পিঠে চড়ার জন্য সিমেন্টের সিঁড়িতে। বেশ লাগছে। এমন মনমৌজিতে বুঁদ হয়ে কাটাব বলেই তো আসা এই অরণ্যছায়ায়। সন্ধ্যে আরও খানিকটা গড়াতেই বন আবাসের দায়িত্বে থাকা চৌকিদার হাজির হয়ে, মৃদু ধমকে ঘরে তৎক্ষনাৎ ফেরত পাঠালেন। ভয়ও দেখালেন, গণ্ডার, হাতি, বাইসন প্রভৃতি বৃহৎ আকারের তৃণভোজীরা, বন আবাসের হাতায় প্রায়ই নাকি চলে আসে। তামাম জঙ্গলই ওদের নিশ্চিন্ত বিচরণভূমি। বন আবাসটি যথেষ্ট নিরাপদ হলেও, সন্ধেরাতে এখানে থাকা ঠিক নয়। আমি কেবল নিরিবিলিটুকু উপভোগ করছিলাম। চৌকিদারের কথা শুনে শিরদাঁড়া চুঁইয়ে বয়ে গেল অপ্রাকৃত শিরশিরানি। সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসি। ঘরের ব্যালকনিতে কফিমগ নিয়ে জমিয়ে বসি। সান্ধ্য-কুয়াশার আবছায়ায় মালঙ্গীর পরিশীলিত বাগিচা। ফাঁকা দোলনা, শুন্য বেঞ্চ, টালি বিছানো পথ, তদারকি করে গোছানো মখমলি সবুজ ঘাসের লন- সব কেমন মায়াবী হয়ে আছে। সুদূরে ওই মালঙ্গী নদী, গাছের ফাঁক গলে নেশাতুর করে তুলেছে জঙ্গলটাকে।

৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক চলে গেছে আলিপুরদুয়ারের দিকে। সকালে আসার সময়ে, পথে এক চমক জমেছিল। এখন সেকথা লিখতে গিয়ে ‘চমক’ শব্দটা ব্যবহার করলাম বটে, কিন্তু সেই মুহুর্তে সেটা ছিল আলটপকা এক অভিজ্ঞতা। চাপা উৎকন্ঠা আর রোমাঞ্চের জগাখিচুড়ি আর কী! আসলে হয়েছিল কী, নাগরাকাটা পেরিয়ে বানারহাট রোড। সেখানেই জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রেখেছিল এক পেল্লাই মাকনা হাতি। এই মাকনা হাতিরা রেগে গেলে কিন্তু বেজায় ভয়ানক। জাতীয় সড়কে গাড়িগুলির অপেক্ষা চলছে সার দিয়ে। গাড়ি ঘোরানোর জায়গা নেই। গজপতির ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এক কান্ড বটে। ড্রাইভারদের জটলায় কানাঘুষো শুনলাম, গতরাতে কাছের বস্তিতে হাতিদের একপ্রস্থ তাণ্ডব হয়ে গেছে। গাঁয়ের মানুষ ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, পটকা ফাটিয়ে তখনকার মতো তাদের ভাগায়। এইসব এলাকায় হাতিরা খাবারের সন্ধানে খেতখামার বা বনবস্তিতে ঢুকে পড়ে। খানিক তছনছ চালিয়ে শান্ত হয়ে ফিরেও যায়। দলবদ্ধ হাতিরা রাস্তা পারাপার করে যখন তখন।


লালি, টুন, শাল, খয়ের, বয়েরা, গামার, শিশু এসব গাছপালা নিয়েই জলদাপাড়ার রাজত্ব শুরু। মাদারিহাট থেকে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের সঙ্গে চিলাপাতা ও খয়েরবাড়ি বেড়ানো সুবিধাজনক। দক্ষিণ খয়েরবাড়ি ‘টাইগার অ্যান্ড লেপার্ড রেসকিউ সেন্টার’, মূলত রয়্যালবেঙ্গল টাইগার ও লেপার্ডের জন্যই খ্যাত। সার্কাস থেকে বন্যপ্রাণীদের খেলা দেখানো বন্ধ হওয়ার পর, বনদপ্তর কিছু প্রাণীকে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। কিছু বন্যপ্রাণীকে এখানে চিকিৎসা ও পূণর্বাসনের জন্য এনে, এই পার্কটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। জলদাপাড়া থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার, মাদারিহাট থেকে ১২ কিলোমিটার- ফলে এদিকে আসা পর্যটকরা এই পার্কটি ভ্রমণতালিকায় রাখেন। খয়েরবাড়ি অরণ্য চিরে বয়ে গেছে বুড়িতোর্সা নদী। তাতে নৌবিহারের ব্যাবস্থাও মজুত। ব্যাটারিচালিত গাড়ি খয়েরবাড়ি জঙ্গল পরিদর্শন করায়। শুধুমাত্র পার্কটি বেড়িয়েই কেটে যাবে সময়। ব্যবস্থা আছে মাদলের দ্রিম্‌ দ্রিম্‌ তালে আদিবাসী নাচ দেখার। বুড়িতোর্সা নদী বাড়তি কৌতুহল জিইয়ে রাখে।

তোর্সা নদীর সেতুর এপারে জলদাপাড়া ওপারে চিলাপাতা। তুখোড় জঙ্গল দুটোই। তোর্সার নুড়ি বিছানো জলরেখা পেরিয়ে বন্যপ্রাণীদের যাওয়া-আসা আকচার। দূরে নীলদিগন্তে গা এলিয়ে সবুজ ভুটানপাহাড়। সেখান থেকে ফুন্টশোলিং প্রবেশপথ টপকে ভুটান রাজ্যের ঠিকানা। আমাদের গন্তব্য ওপথে নয়, খানিক এসে বরদাবাড়ি। সামনেই বায়ুসেনার ঘাঁটি। এখান থেকে পথটা ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে গুয়াহাটি। অন্য পথটি পৌঁছে দিয়েছে মালঙ্গী বন আবাসের একেবারে দোরগোড়ায়। দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু জিরিয়ে বেরোব খয়েরবাড়ি। কাল সকালে যাব চিলাপাতা জঙ্গলে আর দুপুরের পর জলদাপাড়া অভ্যারণ্য।

এখানে একটা ব্যাপার আছে। জলদাপাড়া জঙ্গল সাফারির যে-নির্ঘন্ট, তার প্রথম অগ্রাধিকার জলদাপাড়া অরণ্যের সেরা ঠিকানা হলং বন আবাসের আবাসিকদের। দ্বিতীয় মাদারিহাট লজের আবাসিকদের জন্য বরাদ্দ। আর সবার শেষে সে সুযোগ মেলে মালঙ্গী লজের পর্যটকদের। হাতে গোনা ওই ক’টি তো জিপ ও হাতি। পর্যটক বেশি থাকলে, বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। মালঙ্গী বন আবাসের ম্যানেজার আশ্বস্ত করেছিলেন, গণ্ডার কিন্তু মালঙ্গীর জঙ্গল থেকেও দেখা অসম্ভব নয়। আমরা এসেছি একশৃঙ্গী গণ্ডার দেখার অভিলাষে। মালঙ্গী নদীপাড়ে পূর্ণবয়স্ক গণ্ডাররা শাবক নিয়ে প্রায়েই চলে আসে।

জলদাপাড়া হলং-এর দিকে না গিয়ে, ভিন্নপথে মেঠোপথ ধরে জিপ সাফারিতে এলাম নজরমিনারে। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে চোখ মেলে পরখ করতে থাকি অরণ্যের বানজারা রূপ। আলোড়িত পাতাদের আকস্মিক ছায়ায়, জলা পেরিয়ে একটা গণ্ডার দম্পতি কিছুটা কাছে এল। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরই ওই জলার কাদায় শরীর ডুবিয়ে দিল। ছায়া-রোদের নিরালায় সে এক অকাতর দৃশ্য।

ঈষৎ হলদেরঙা বৃক্ষ ও বন্যজীবন নিয়ে অরণ্যসম্ভার। অমল তরুছায়ায় ভোর ভুলিয়ে দিচ্ছে পাখির ডাক। ঝিরঝিরে একটা হাওয়া বইছিল। নিপাট বুনো গন্ধের নির্যাস আর ভোরের লুকোচুরি মেখে অরণ্য। রোদের ধার নেই তেমন যে কুয়াশা উবে যাবে। মালঙ্গী নদী-জঙ্গল-কুয়াশা-বনজ গন্ধ মৌতাতে সুক্ষ্ম এক একটি অধ্যায়। গাছেরা চুপিসারে কথা বলছে। যথেচ্ছ তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠল একটা ময়ূর। লাজুক মোড়ক সরিয়ে যেন একটু একটু করে প্রকাশিত হতে থাকল মালঙ্গী জঙ্গলের মুগ্ধ করা দৃশ্যপট!