সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে হোটেলেই জলখাবার সেরে বের হলাম৷ গন্তব্য ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজার৷ এটি বিশ্বের অন্যতম বড় ও পুরোনো বাজার৷ গ্র্যান্ড বাজার তুর্কি ভাষায় ‘কাপালিকারসি’ হিসেবে পরিচিত৷ স্থানীয়দের কাছে এটি শুধু বাজার নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের শাসনামলে কনস্ট্যান্টিনোপলে উসমানীয় বিজয়ের পরপরই ১৪৫৫ সালে এর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল৷ মূলত শহরের বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তা করে বাজারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ এই বাজারে ৬০টির মতো রাস্তা রয়েছে, যার মধ্যে দোকান আছে প্রায় ৪ হাজার৷
বাজারের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বিক্রি হয়৷ টার্কিশ মসলা, চামড়ার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, টার্কিশ ডিলাইট (মিষ্টিজাতীয় খাবার), ঝাড়বাতি, সিরামিক থেকে শুরু করে স্থানীয় নকশার আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক—কী নেই৷ প্রায় সব দোকানেই বেড়াতে আসা লোকজনের ভিড়৷ চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার দর-কষাকষি৷ দেখে বুঝলাম বেচা-বিক্রি এখানে বেশ ভালো৷ আমি সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি এখানকার ঝাড়বাতির দোকানগুলো দেখে৷ এত সুন্দর করে সাজানো, শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে৷ এখানে আপ্যায়নে চা খাওয়ার বেশ চল৷ চায়ের কাপ নিয়ে বিক্রেতাদের বিভিন্ন দোকানে ছোটাছুটি দেখলেই সেটা বোঝা যায়৷ আমাদেরও এক দোকানি চা খাওয়ালেন৷ বাজারের সবচেয়ে পুরোনো অংশের নাম সেভাহির বেদেস্টেনি৷ এখানে মূলত দামি ও প্রাচীন অ্যান্টিক জিনিসপত্র কেনাবেচা হয়৷ এই অংশের দেয়াল বেশ পুরু, ঢোকার জন্য আলাদা গেট আছে৷ এটি একসময় বাজারের কোষাগার ও ধনী ব্যবসায়ীদের মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো৷ এখানে উসমানীয় আমলের বেশ কিছু পুরোনো পয়সা ও নোট দেখলাম৷ দাম বেশ চড়া না হলে সংরক্ষণের জন্য কেনা যেত দু-একটা৷
গ্র্যান্ড বাজারের প্রতিটি কোণ যেন একেকটি গল্প৷ পুরোনো দোকানগুলো হাতে আঁকা প্রাচীন টাইলস দিয়ে সাজানো৷ দেওয়ালে মেরুন আর হলুদ রং৷ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে জল খাওয়ার জন্য পুরোনো জলের কল, নামাজের জন্য মসজিদ আর খাবারের দোকান৷ সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক বাজারই বটে৷ বেশ হাঁটাহাঁটির পর বাজারের একটি ক্যাফেতে বসলাম৷ টার্কিশ কফি আর বাকলাভা অর্ডার করলাম৷ এখানকার কফিতে সাধারণত দুধ বা চিনি দেওয়া হয় না, খেতেও বেশ কড়া৷ আমরা যেহেতু বিদেশি, তাই আমাদের আলাদা করে চিনি দিল৷ এখানকার বাকলাভা বেশ নামকরা, তাই সেটা আগ্রহ নিয়ে অর্ডার করেছিলাম৷ টেবিলে আসার পর বুঝলাম কেন সেটা এত জনপ্রিয়৷ পরিমিত মিষ্টি খাবারটি এখানে এলেই নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন যে কেউ৷ ক্যাফেতে খেতে বসে জিরিয়ে নেওয়া ছাড়াও বাজারে চলাচল করা মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল৷
গ্র্যান্ড বাজার থেকে বের হয়ে ট্রামে চড়ে বসলাম, এবার যাব গালাটা টাওয়ার৷ কারাকোয় স্টেশনে নেমে প্রায় ১৫ মিনিট হেঁটে গালাটা টাওয়ারে পৌঁছালাম৷ এই এলাকা পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা৷ চারপাশের বাড়িগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো৷ এই টাওয়ারটি তৈরি হয়েছে ১৪ শতকে, জেনোইস (জেনোয়া) উপনিবেশের আমলে৷ একসময় এটি ছিল ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা৷ যা জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো৷ আমরা টিকিট কেটে ওপরে উঠলাম৷ এখন থেকে পুরো ইস্তাম্বুল দেখা যায়৷ টাওয়ারটার ব্যাপারে একটা গল্প চালু আছে, ১৭ শতকে হেজারফেন নামের এক ব্যক্তি তাঁর শরীরে পাখির মতো ডানা লাগিয়ে গালাটা টাওয়ার থেকে বসফরাস পেরিয়ে উসকুদার এলাকায় উডে় গিয়েছিলেন, যা ইতিহাসের প্রাচীনতম রেকর্ড করা ফ্লাইটগুলোর একটি৷ তবে কেউ কেউ বলেন, সে আসলে পুরো বসফরাস পার হতে পারেননি৷
গালাটা থেকে বের হয়ে দুপুরের খাবারের সন্ধানে নেমে পড়া গেল৷ ইস্তাম্বুলের ব্যাপারে আমার একটা পর্যবেক্ষণ হলো, যেখানেই খেয়েছি, খাবার ভালো লেগেছে৷ ঠিক জানি না কাবাব খুব পছন্দ বলেও এমনটা মনে হতে পারে৷ তবে এটাও তো সত্য এ দেশের কাবাব পৃথিবী বিখ্যাত৷ কিছুটা হেঁটেই একটা কাবাবের দোকান পেয়ে গেলাম৷ এখানে ওরা কেগ কাবাব বিক্রি করে৷ এটা ডোনার কাবাবের মতোই কিন্ত্ত কাবাবের স্ট্যান্ডটা অনুভূমিক৷ সেখান থেকে ছোট শিকে করে কাবাব নিয়ে কয়লার মধ্যে ঝলসে পরিবেশন করা হচ্ছে৷ কাবাবের সঙ্গে থাকে যত খুশি রুটি আর সালাদের ব্যবস্থা৷ কাবার-রুটির পর চা দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম৷ এবার যাব ইস্তাম্বুলের রোমান ইতিহাসের অংশ বাসিলিকা সিস্টার্ন দেখতে৷
ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর একটি বাসিলিকা সিস্টার্ন৷ এখানকার মাটির নিচের জলাধারটি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উন্নত প্রকৌশল প্রযুক্তির প্রমাণ হিসেবে টিকে আছে৷ এই জলাধারটি সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত৷ কনস্ট্যান্টিনোপল শহরে ব্যবহারের জল সংরক্ষণ করার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল, যাতে শহর কোনো কারণে জলের সংকট তৈরি না হয়৷ ড্যান ব্রাউনের দা ভিঞ্চি কোড বইতে এই জলাধারের বর্ণনা পড়েছিলাম৷ তাই সামনাসামনি দেখার বেশ আগ্রহ ছিল৷ টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম৷
দর্শনার্থীদের দেখার জন্য সিঁড়ি তৈরি করা আছে, যা দিয়ে নিচে নেমে মোটামুটি হতবাক হয়ে গেলাম৷ বহু কলাম দিয়ে তৈরি জলাধারটি দেখার মতো একটি জিনিস৷ প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর আগে তৈরি, এখনো কী দারুণভাবে টিকে আছে৷ জলাধারের উত্তর-পশ্চিম কোণে মেডুসার মাথা-সংবলিত দুটি কলাম৷ এই মাথাগুলো এভাবে কেন বসানো, তার কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা পেলাম না৷ গ্রিক পুরাণে আছে মেডুসার দিকে কেউ তাকালে সে পাথর হয়ে যায়, তাই হয়তো এই ব্যবস্থা৷ আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, এখনো এখানে যে সামান্য জল আছে, অনেকে তাতে পয়সা ফেলছে৷ পয়সাগুলোয় আলো পড়লে মনে হবে কোনো গুপ্তধন লুকানো আছে৷ আবার মাঝেমধ্যে প্রজেক্টর দিয়ে গ্রিক পুরাণের গল্পের অংশ দেখানো হচ্ছে৷ বিস্ময় আর ঘোর নিয়েই একসময় বের হয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলাম৷