‘ডুয়ার্স’ শব্দটা যেন একটা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। তাই দু-একদিনের অবকাশ পেলেই ওখানে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে বারবার। এবারও রাতের কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে পাড়ি দিলাম ডুয়ার্সে। সারারাত ট্রেনের দুলুনির মধ্যে নদী-অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার ডাক শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। পরদিন ভোরবেলা প্রিয় সিট, সাইড লোয়ারের জানালার পাশে বসেই দিগন্তজোড়া ধানখেতের ওপর সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখে দিনের শুভ সূচনা হল। চায়ের কাপের উষ্ণতা নিতে নিতে পেরিয়ে যেতে থাকি কিষাণগঞ্জ, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন।
নিউ মাল জংশন পেরনোর পর থেকেই দৃশ্যপটের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। তখন ধানখেতের জায়গা দখল করছে চা-বাগান আর ঘন অরণ্য। দু’দিকের ঘন সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে ট্রেন লাইন চলে গেছে। এই রেলপথের মাঝেই পড়ে চাপড়ামারি, গরুমারা, লাটাগুড়ি, চিলাপাতা, বক্সা-জয়ন্তী, রাজাভাতখাওয়া ইত্যাদি নানা অভয়ারণ্য। যেতে যেতেই পার হয়ে যায় স্রোতস্বিনী তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, কালচিনি-সহ অনেক নদী। নীল আকাশের সঙ্গে সবুজ চা-বাগানের অপূর্ব মেলবন্ধন। চারিদিক সবুজঘেরা এক বিরাট জংশন স্টেশন আলিপুরদুয়ার। আমাদের এবারের গন্তব্য জয়ন্তী।
সবুজ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে কালো পিচের চওড়া রাস্তা। কুয়াশামাখা সদ্য বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ, শ্যাওলাধরা নানা বৃক্ষরাজির বাকলের গন্ধ। ড্রাইভার দাদার কথা অনুযায়ী যে-কোনও সময় বেরিয়ে আসতে পারে কোনও বন্যপ্রাণী। এ পথে কয়েকদিন আগেই নাকি এক বন্য বাইসন হত্যা করেছিল স্থানীয় আদিবাসীকে। ভয়ে আর আতঙ্কে শিহরিত হয়ে উঠি আমরা। আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার বাকি। চারিদিকে অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক শোভার সঙ্গে হঠাৎ দূর থেকেই দেখা যায় স্রোতহীন, শুষ্ক, শীর্ণকায় জয়ন্তী নদী। ভুটান থেকে আসা কাটলুং ও সাচি-ফু নামের দুই মিলিত জলধারাই এখানে জয়ন্তী নদী নামে প্রবাহিত হয়েছে।
আলিপুরদুয়ার জেলার সীমান্তে ভারত-ভুটানের গা ঘেঁষে অবস্থিত জয়ন্তী। এর পূর্ব দিকের পাহাড় ও পশ্চিমদিকের ছোট্ট একটি বসতি কুমারগ্রাম নিয়েই জয়ন্তী পাহাড় এবং জয়ন্তী গ্রাম গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের কাছেই শুনলাম কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো এই জয়ন্তী গ্রাম আর থাকবে না। প্রশাসনের প্রচেষ্টা চলছে এখানকার অধিবাসীদের পুনর্বাসন দিয়ে সমগ্র অঞ্চল ‘বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প’-র আওতায় নিয়ে আসবে।
দূর থেকে দেখা যায় ভুটান সীমান্ত। জয়ন্তী নদীর ধারেই বেশ কয়েকটি সরকারি এবং বেসরকারি টুরিস্ট লজ গড়ে উঠেছে। একইসঙ্গে পাহাড়-অরণ্য-নদী এমন অপরূপ সৌন্দর্যের জন্যই জয়ন্তীকে বলা হয় ‘ডুয়ার্সের রানী’। জয়ন্তী নদীর ওপারে ভুটিয়া বস্তি। নদীপথের নুড়ি পাথর ধরে বেশ কিছুটা ট্রেকিং করে যেতে হয়, এখানকার অতি জাগ্রত শিবমন্দির ‘ছোট মহাকালগুহা’। আরও প্রায় চার কিলোমিটার ট্রেকিং করে পৌঁছতে হয় ‘বড় মহাকালগুহা’।
এবার আমাদের গন্তব্য পুকুরি লেক। জয়ন্তী থেকে দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া হল। গাড়ির সাথেই দিয়ে দেওয়া হয় বনবিভাগের অনুমোদনপ্রাপ্ত একজন গাইড। আগে পুরো রাস্তাই হেঁটে যেতে হতো। কিন্তু বর্তমানে হাতির উপদ্রব এতটাই বেশি যে, একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত গাড়ি যেতে পারে। তারপর প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার চড়াই পথ হেঁটে উঠতে হয়। এ পথে চলার আগেই গাইড প্রদীপ ভাই বলল মুড়ির প্যাকেট নিয়ে নিতে। কারণটা জিজ্ঞাসা করলে মুচকি হেসে বলল, ওপরে গেলেই বুঝতে পারবেন। নুড়িপাথরেপূর্ণ পুরো রাস্তাই জঙ্গলে ঘেরা।
দূর থেকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়। এইসব পাহাড় পেরিয়ে গেলেই শুরু হয় ভুটান পাহাড় আর তার ওপাশে আসাম রাজ্য। গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছি। একটু অন্যমনস্ক হলেই পাথুরে রাস্তায় পা পিছলে অথবা শিকড়ে আটকে গিয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অক্টোবরের শেষের দিক, তাই কিছু কিছু জায়গায় ঝরে পড়া শুকনো পাতা স্তূপাকারে রয়েছে। একপাশে খাদ আরেক পাশে জঙ্গল, বড় বড় গাছপালা। চারপাশে নানা ধরনের পাখির কিচিরমিচির শব্দ, খসখস করে আওয়াজ তুলে চলে যাওয়া কোন সরীসৃপের চলাচল, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক- সব মিলে যেন এক আরণ্যক সিম্ফনি সৃষ্টি করেছে।
পথে সঙ্গী হল রোমযুক্ত এক ভুটানি সারমেয়। একটানা চড়াই ভাঙা সম্ভব নয়। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছি আর সেই সঙ্গে চলছে ফটোসেশন। এই অঞ্চলে স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ৭০-৮০, সরীসৃপ প্রজাতির সংখ্যা ৫০, নানা প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি-সহ ছোট বড়ো পোকামাকড় মিলিয়ে প্রজাতির সংখ্যা ৫০০-রও বেশি।
এক সময় পৌঁছে যাই লেকের ধারে। একসময় এই এলাকা দিয়ে ভুটান পাহাড় থেকে ব্যবসায়ীরা ভারতে আসত পশম, লেবু ইত্যাদি নানা উপকরণ নিয়ে। রেশম পথেরই মতো এমনই একটা পথ তারা আবিষ্কার করেছিল, সেই সঙ্গে খুঁজে পেয়েছিল এই লেক। স্থানীয়দের কাছে অতি পবিত্র এই লেক ‘পুকুরি মাতা’ নামে সুপরিচিত। আশ্চর্যের বিষয় হল নিচের গ্রামগুলোয় প্রায় ২৫০-৩০০ ফুট খুঁড়েও যখন জল পাওয়া যায় না, তখন এত উপরে কীভাবে এই লেকের সৃষ্টি হল!
এই জল সারাবছর থাকে। এখানে রয়েছে বড় বড় আকৃতির মাগুরমাছ আর কচ্ছপ। স্থানীয় মানুষদের কাছে এই মাগুরমাছ আর কচ্ছপরাও অতি পবিত্র প্রাণী। এবার প্রদীপ ভাই জানাল এদের দেওয়ার জন্যই মুড়ির প্যাকেট নিয়ে আসতে বলেছিল। মুড়ি দিতেই ঝাঁকে ঝাঁকে মাগুরমাছ এসে এক জায়গায় জড়ো হল। লম্বায় প্রায় দেড় থেকে দু’ফুট এবং তাদের ওজন প্রায় পাঁচ থেকে দশ কিলোগ্রাম।
এখানে বছরে দু’বার উৎসব হয়–মাঘীপূর্ণিমা এবং বুদ্ধপূর্ণিমার সময়। তাই হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই এই স্থান খুবই পবিত্র। তবে অন্যান্য স্থানের মতো এখানে কোনও নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা কিছুটা এলাকা জুড়ে রয়েছে কয়েকটা সিমেন্টের বেদী। তার মধ্যেই শিবের ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে। পাথরের কালী, গণেশ-সহ কয়েকটি দেব-দেবী আছে। পুজোর নানা উপকরণও চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। তার পাশেই বড় বড় গাছের এমাথা ওমাথা জুড়ে রঙ-বেরঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ হাওয়ায় উড়ছে।
বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে দূর-দূরান্ত থেকে বৌদ্ধরা এখানে পায়ে হেঁটে পুজো দিতে আসেন। আগের দিন মশাল জ্বালিয়ে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, সারারাত ধরে পুজো করা হয়। সূর্যোদয়ের পূর্বেই যাতে পুজো সম্পন্ন হয়ে যায়, সেদিকে তাঁদের সজাগ দৃষ্টি থাকে। আবার মাঘীপূর্ণিমার দিন মূলত হিন্দু ধর্মের মানুষেরা আসেন। এই দু’দিন অতিরিক্ত কোলাহলের জন্য বন্যপ্রাণীরা সাধারণত জলের ধারে কাছে আসে না। দুই ধর্মের মানুষের কাছেই এ এক ইচ্ছেপূরণের রাত। তাঁদের বিশ্বাস হ্রদের জলে ভক্তি করে অন্তর থেকে যা চাওয়া যায়, তা-ই পূরণ হয়।
চারিদিকের আলো ক্রমশই নিভে আসতে থাকে। এক অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছি আমরা ছ’জন। প্রদীপ ভাই তাড়া দিতে লাগল। নিচে নামতে নামতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাই খুব সাবধানে ফেরার পথে পা বাড়ালাম।
কীভাবে যাবেন: জয়ন্তী যেতে গেলে হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে ট্রেনে আলিপুরদুয়ার। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন: রাত্রিবাস করার জন্য এখানে বেশ ভালো কয়েকটি ট্যুরিস্ট লজ এবং হোমস্টে আছে।