কেরালা অভিযান – এক নতুন অধ্যায়

রুণা চৌধুরি (রায়)
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মালাবার কোস্টের গা ঘেঁষা আরবিয়ান সমুদ্রের তীরে অবস্থিত কেরালা অভিযানে মুম্বই বিমানবন্দর থেকে সকাল ৮টার বিস্তারা ফ্লাইটে দু’ঘণ্টা জার্নির পর কোচি এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম৷ চারদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে লক্ষ্য করি এই বিমানবন্দর অন্যান্য সব বিমানবন্দর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ মনে হল জাপানের কোনও বিশাল বাংলোতে প্রবেশ করলাম৷ কটেজ টাইপের এয়ারপোর্ট, সম্পূর্ণ সোলার সিস্টেমে তৈরি, সূর্য থেকে প্যানেল দিয়ে তৈরি কোনও ইলেকট্রনিক্স নেই, অভিনব কায়দায় অপূর্ব সৃষ্টি, ভারতের একমাত্র সোলার তৈরি বিমানবন্দর৷ অবাক বিস্ময়ে বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশংসা করা ছাড়া আর কিছুই বলার ধৃষ্টতা নেই৷ মনটা গুণগুণ করে উঠল৷ উবের বুক করে ছুটে চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে৷ দু’ধারে ঘন সবুজ গাছগাছালিতে ভরা, আম, কাঁঠালের গুচ্ছে ভরা গাছের ঝাড় আর তারই মাঝে নারকেল গাছের সাড়ি৷ হাওয়ার ঝাপটায় এ ওর গায়ে যেন দোল খেয়েই চলেছে৷ সর্পিল কালো রাস্তা ভেদ করে গাড়িগুলি ছুটে চলেছে পিঁপড়ের সাড়িতে যে যার গন্তব্যস্থলে৷ প্রায় ৪০ মিনিট পরে হোটেল ‘কোপস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল’ হোটেলের কাঁচে ঘেরা সুসজ্জিত লবিতে উপনীত হলাম৷ ছিমছাম থ্রি-স্টার হোটেল৷ হোটেলের রুমে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে বেড়িয়ে পড়লাম স্থানীয় কিছু দর্শনীয় স্থান দেখার উদ্দেশ্যে৷ সঙ্গে আমার মেয়ে, জামাই, ছেলের বাবা, ঠাকুরদা, ঠাকুমার পূর্বপুরুষদের বিশাল বাড়ি৷ সবুজ ঘাসে মোড়া লন, চারদিকে প্রকৃতির অনবদ্য ছোঁয়া, দুটো সুন্দর গাড়ি লনে শোভা পাচ্ছে৷ আবার গ্রাম্য স্টাইলে বড় পাতকুয়ো বিদ্যমান৷ সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম৷ ওনাদের শিষ্টাচার, সৌজন্যমূলক ব্যবহার মন জয় করে নিল৷ কথার মাঝেই ধূমায়িত কফির পেয়ালা চলে এল, সঙ্গে ইডলি, সাম্বার, বড়া৷ কিছু তো টেস্ট করতেই হল৷ তবে কফির বিশেষত্ব আজও যেন মুখে লেগে আছে৷
ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট পথ অতিক্রান্ত করে অরণ্যবেষ্টিত মন্দিরের সমাবেশে নিজেদের সমর্পণ করলাম৷ এখানকার প্রধান দেবতা হল কৃষ্ণ এবং শিব ও পার্বতী৷ মনোরম অরণ্যশোভিত নির্জনস্থানে অবস্থিত মনোরম শোভায় বন্দিত দেবদেবীর পুজো নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়৷ ত্রিচূরপল্লীতে এই উৎসব পালিত হয়, একে ত্রিশূলও বলে৷ এখানে যে কোনও মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে ছেলেদের সাদা এবং কালো বর্ডারের ধুতি (mund) পরিধান করতে হয়৷ এই mund পরিচ্ছদ ছেলেদের জন্য অতি আবশ্যক না হলে প্রবেশ নিষেধ৷ আমার জামাই কিনেই নিল ওই ধুতি৷ মেয়েরা শাড়ি, সালোয়ার কামিজ পরে পুজো দিতে পারে৷ মন্দির দর্শন করে পুজোপর্ব শেষ করে মুনিয়ার বায়নায় পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে চললাম৷ খুব সুন্দর লজে ঘেরা এ্যালোপি ব্যাক ওয়াটারস, বোট হাউস, বোটরাসেক নয়নাভিরাম কেহালার সৌন্দর্যকে হূদয়ের ঝাঁপিতে পুরে এগিয়ে চললাম ‘শবরীমালার’ উদ্দেশ্যে৷ এই স্থান ঠাকুরের জায়গা অতি পবিত্র স্থান৷ ভক্তিভরে এই স্থানে উৎসব পালিত হয়৷
পরেরদিন স্নান সেরে আইআপ্পা টেম্পলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম৷ ছেলেরা এখানে নির্দ্ধিধায় প্রবেশ করতে পারে৷ স্ত্রী-পুরুষ সবাই কালো পোশাক পরিধান করে৷ পূজারীর দেওয়া মালা পরে মাটিতে শুয়ে পুজোর নিয়মকানুন সারতে হয়৷ নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে পুজো সেরে কিছুদূরে এক রেস্তরাঁয় ব্রেকফাস্ট সারলাম সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইলে৷ এরপর উবের বুক করে বর্তমান গন্তব্যস্থল অশোকা হোটেলের দিকে রওনা হলাম৷ সামান্য বিশ্রামের পরই ছুটে চললাম কেরালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এক একটা ধাঁচের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকনে৷
পার্বত্য এলাকার কোল ঘেঁষে বিচগুলোর অনবদ্য সৌন্দর্য অবর্ণনীয়৷ কেরালা ছোটরাজ্য হলেও এর সৌন্দর্যে নিয়মশৃঙ্খলায় কোনও খামতি নেই৷ মালায়ালাম ভাষায় এরা কথা বললেও হিন্দি, ইংরেজি ভাষায় খুবই দক্ষ এবং কেরল ভারতের অন্যতম শিক্ষিত রাষ্ট্র৷ ত্রিবান্দ্রাম কেরালার বৃহত্তম শহর এবং ভারতের সর্বাপেক্ষা পরিচ্ছন্ন শহর৷ প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতায় ভরপুর, দেবতাদের দান৷ এরপর গেলাম ভারতের বৃহত্তম মল ‘লুলুমলে’৷ মেয়ে, জামাই ওখানকার বিখ্যাত কাসাভু শাড়ি কিনে আমায় প্রেজেন্ট করল৷ কোনও বারণই মানল না৷ অপূর্ব সুন্দর সেই শাড়ি৷
কেরালিয়ানদের নারকেলের ব্যবসা বিখ্যাত পৃথিবীজুড়ে৷ তাই একে ‘ল্যান্ড অফ কোকোনাটস’ বলে৷ চলার পথে হাতির পাল দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ এদের মাহুতকে ‘পাপান’ বলে৷ কোভালাম বিচ, পেরিয়ার বিচ, ভারকালা বিচ প্রকৃতির বুকে অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন৷ মুন্নারের হিলস্টেশনগুলি একবার দেSলে মন তৃপ্ত হয় না৷ ছবির মতো সে দৃশ্যপট৷ আমাদের সাতদিনের টু্যর নানান সুখময় অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হলেও মন চায় বারংবার ছুটে যাই ওই শান্তির নীরালায়৷ ফেরার পথেও এ বিস্তারা ফ্লাইটে মুম্বই বিমানন্দরে অবতরণ করলাম৷ মেয়ে, জামাই ওদের আত্মীয়-পরিজনদের আদর আপ্যায়নে মন আবেগে পরিপূর্ণ ছিল৷ কেরালা দর্শন আমার জীবনে আর এক নতুন বার্তা বহন করে আনেন৷