• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

ডেস্টিনেশন যখন লাভা আর রিশপ

চা-বাগানগুলো এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকা এবং পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণের বিষয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গেছে চা-বাগানের সবুজ। ডুয়ার্সের এই সব চা-বাগানে কাজ করা মানুষদের জীবনধারা এবং তাদের অতিথিপরায়ণতা পর্যটকদের মনে এক বিশেষ স্থান করে নেয়।

লাভা ও রিশপ। ফাইল চিত্র

ডুয়ার্স, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এক মোহনীয় এলাকা, যাকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ভাণ্ডার বলা চলে। নদী, অরণ্য, চা-বাগান এবং হিমালয়ের হাতছানি – সব মিলিয়ে ডুয়ার্স হল প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। সুবিশাল সবুজ প্রান্তর ও মেঘে ঘেরা পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। এই ডুয়ার্সের বুকেই অবস্থিত লাভা এবং রিশপ, দুটি শান্ত এবং নিস্তব্ধ স্থান, যেখানে গেলে ভ্রমণপ্রিয় মানুষ সঞ্চয় করতে পারেন এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

লাভা, কালিম্পং জেলার একটি পাহাড়ি গ্রাম, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এই স্থানটি তার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত- যা শুধু পর্যটকদেরই নয়, প্রকৃতিবিদদেরও মুগ্ধ করে তোলে। লাভার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল এর অরণ্য, যা বেশিরভাগই পাইন এবং সাইপ্রেস গাছে ঘেরা। এই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে যখন সূর্যের আলো প্রবেশ করে, তখন এক অপার্থিব মায়াজাল সৃষ্টি হয়! এই দৃশ্য একবার দেখলে সহজে ভুলে যাওয়া যায় না।
লাভায় রয়েছে একটি নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার যা আসলে বহু প্রজাতির পাখির বাসভূমি। বিভিন্ন পাখির ডাকে এই স্থানটি মুখরিত হয়ে থাকে। পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা। বার্ড ফোটোগ্রাফারদের আনাগোনা লেগেই থাকে।

এখানে এলে মিস করা উচিত নয় পাহাড়ের উপরে তৈরি হওয়া লাভা মনাস্ট্রি। বৌদ্ধ শ্রমণদের থাকার জায়গা এটি, সারিবদ্ধভাবে সাদা, নীল, লাল, হলুদ ও সবুজ পতাকায় সাজানো। এখানে নানা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় বছরের নানা সময়ে। একই সঙ্গে ভাবগম্ভীর ও এক মায়াবী পরিবেশ ছড়িয়ে থাকে গোটা মনাস্ট্রি জুড়ে। এই মনাস্ট্রির শান্ত পরিবেশে সময় কাটানো মানে প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় অনুভব করা।

লাভার মূল আকর্ষণ হল এর আবহাওয়া। এই স্থানটিতে বছরের প্রায় সব সময়ই ঠান্ডা থাকে। এখানে মেঘেরা পাহাড়ের গায়ে গা মিশিয়ে দেয়। সন্ধ্যাবেলা লাভার রাস্তা ধরে হাঁটলে মৃদু শীতল বাতাস এবং পাইন গাছের সুঘ্রাণ মনকে অবশ করে দেয়।

লাভা থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রিশপ। এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটির আসল সৌন্দর্য হল এর নির্জনতা। নিস্তব্ধ এই স্থানটি পর্যটকদের কাছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখানে এলে একটি কথা মাথায় রাখা ভালো, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে রিশপে। নিখাদ প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অবশ্য এই কারণেই রিশপ বেশি আকর্ষণীয়। মোবাইলের টাওয়ার প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সব ব্যস্ততা ভুলে, শহরের কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে, প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে চাইলে রিশপ এক অনন্য গন্তব্য।

রিশপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনের গায়ে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের সোনালি আলোর ছটা। সেই সময় পাহাড়ের যে-সৌন্দর্য উপভোগ করবেন, তা শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

রিশপের রাস্তাগুলোতে পায়ে হেঁটে চলার আনন্দই আলাদা। এখানে গাড়ি চলাচল অত্যন্ত সীমিত, ফলে প্রকৃতির নীরবতা বিরাজ করে চারদিকে। এই নীরবতা শুধু মনকে প্রশান্তি দেয় না, বরং প্রকৃতির ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সৃষ্টিকে, খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়।

জঙ্গলের বুক চিরে ইতস্তত পথ, ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গেছে অজানা কোনও গ্রামে। জ্বালানির জন্য কাঠ বা গৃহপালিত পশুদের জন্য ঘাস-পাতা বয়ে নিয়ে যাওয়া আঞ্চলিক মানুষের দেখা মিলবে মাঝেমধ্যেই। দু’দণ্ড গল্প জমান তাদের সঙ্গে। পথের ধারে বসে জঙ্গলের পাখির কিচিরমিচির শুনুন। পাহাড়ি গাছপালা আর ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা চরাচর।

ডুয়ার্স বলতে অবশ্য শুধু পাহাড়ের সৌন্দর্য নয়- এখানে রয়েছে নদী এবং বিস্তীর্ণ চা-বাগান। তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা এবং মহানন্দা নদী এই অঞ্চলের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে। বর্ষাকালে যখন এই নদীগুলি পূর্ণ বেগে প্রবাহিত হয়, তখন মনে হয় প্রকৃতির রাগ এবং মাধুর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় দেখতে পাচ্ছি।

চা-বাগানগুলো এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকা এবং পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণের বিষয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গেছে চা-বাগানের সবুজ। ডুয়ার্সের এই সব চা-বাগানে কাজ করা মানুষদের জীবনধারা এবং তাদের অতিথিপরায়ণতা পর্যটকদের মনে এক বিশেষ স্থান করে নেয়।

যদিও বর্ষাকালে এই জায়গাগুলি খুবই সুন্দর হয়ে ওঠে, তবু বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে ভ্রমণ কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে। লাভা এবং রিশপ ভ্রমণের জন্য তাই শীতকালই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায়। প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়ে জীবনের কোলাহল থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে চান যারা, তাদের জন্য ডুয়ার্সের এই পাহাড়ি গ্রামগুলো যেন প্রকৃতির এক স্নিগ্ধ আশীর্বাদ।