কলকাতার খুব কাছেই, তাই অল্প খরচে প্রায়-জীবন্ত এক ইতিহাসের অংশ হতে পারবেন। শীতের সকালে ভ্রমণে চলুন ‘ফরাসডাঙ্গা’ বা চন্দননগরে। হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে কলকাতা থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ৮ বর্গ কিলোমিটার জোড়া সমতলভূমি এটি। ভারতের দীর্ঘতম নদীটির বুকে এটি একটি মুক্তো, তা নাহলে এইটুকু জমির জন্য প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজ আর ফরাসি সাম্রাজ্যের মধ্যে বারবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কেন হবে?
মুঘল আমলে তদানীন্তন বাংলার নবাব ইব্রাহিম খাঁ’র কাছ থেকে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে এখানে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পেয়েছিল ফরাসি সরকার। পনেরো বছরের মধ্যেই এটি পুরাপুরি একটি ফরাসি অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়ে যায় এবং জোসেফ ফ্রাঙ্কইস ডুপ্লেক্স প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই চন্দননগর ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। হুগলি নদী বেষ্টিত স্থানটি আসলে তিনটি অঞ্চল ‘খলিসানি’,’গোন্দল-পাড়া’,আর ‘বোড়ো’র একীকরণ।
স্থানটির নাম চন্দননগর কী করে হ’ল সে ব্যাপারে ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়। তবে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. সুকুমার সেনের মতে, একসময় এই জনপদে একটি বিখ্যাত চণ্ডী মন্দির ছিল। একে বলা হতো চণ্ডী-নগর। এই থেকেই পরবর্তীকালে চন্দননগর নামের উৎপত্তি ঘটেছে। আবার নদীপথে এখানে প্রচুর পরিমাণে চন্দন কাঠের চলাচল আর ব্যবসা হতো। তাই কারও কারও মতে সেই থেকেই এর নাম চন্দননগর। আর এক মহলের মতে হুগলি নদী শহরটির পশ্চিম পাড় দিয়ে অর্ধ-চন্দ্রাকারে বেঁকে গেছে, তাই কালক্রমে এর নাম চন্দ্র নগর বা চন্দননগর হয়েছে। নাম যেভাবেই আসুক না কেন, কলকাতার মতো এখানেও আছে স্ট্র্যান্ড, বড়বাজার, বাগবাজার, বৌবাজার ইত্যাদি। ফরাসি আমলে কিন্তু চন্দননগরের প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল। শিক্ষা-সংস্থান, রাস্তাঘাট, বাগ-বাগিচা,পার্ক,স্ট্র্যান্ড, ফরাসি স্থাপত্য,অট্টালিকা, উন্নত জল নিকাশি ব্যবস্থা- সবেতেই ফরাসি সৌন্দর্যবোধ আর কারিগরি দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ, ব্রিটিশ পুলিশকেও অনুমতি নিয়ে চন্দননগরে ঢুকতে হতো। তাই চন্দননগর ছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল আর প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্য বিপ্লবীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক,বিপ্লবী গণেশ ঘোষ,অনন্ত সিংহ,শহিদ জীবন ঘোষালও এখানে আত্মগোপন করে ছিলেন। শহিদ কানাইলাল দত্তের শৈশব কেটেছে এই শহরে। এখানেই আছে তাঁর ভিটে আর তাঁর নামধন্য বিখ্যাত বিদ্যালয় (কানাইলাল বিদ্যামন্দির), ক্রীড়াঙ্গন ইত্যাদি।
বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈতৃক ভিটেও রয়েছে শহরের ‘ফটক-গোড়া’ অঞ্চলে। এখানেই ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত, মতিলাল রায়ের প্রবর্তক সংঘের ভিতরেই প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল রাসবিহারী বসুর তৈরি বিপ্লবী-বোমা যা পরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ‘বড়লাট’ হার্ডিঞ্জ-এর ওপর। ঋষি অরবিন্দও পণ্ডিচেরি যাওয়ার আগে, কিছুকাল এখানে অজ্ঞাতবাস করেছিলেন।
ছোট শহর কিন্তু হাওড়া-বর্ধমান মেইন লাইনের উপর দুটি বড় রেল স্টেশন আছে, মানকুণ্ডু আর চন্দননগর জংশন। গঙ্গার পাড়ে গড়ে উঠেছে বিবেকানন্দ মন্দির। স্ট্র্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্তে ‘পাতাল-বাড়ি’ এই শহরের একটি বিশেষ ল্যান্ড-মার্ক। এই বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,সত্যেন্দ্র নাথ বোস-সহ আরও অনেক মনীষী ভ্রমণ করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ এই পাতাল-বাড়িতেই ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের অংশ রচনা করেছিলেন। নদীর পাড়-ঘেঁষা এই বাড়ির কতকগুলো ঘর পাড়ের নিচে অবস্থিত বলেই ওই নাম। বর্ষায় নদীতে জল বাড়লে ওই ঘরগুলি ভেসে যায়। চন্দননগরের সুপুষ্ট মর্তমান কলা,লিচু আর ‘চ্যাটার্জি আম’ ভারত-বিখ্যাত। ফরাসি আমলে দূর দূরান্ত থেকে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে আর ফরাসি মদের স্বাদ নিতে ‘ফরাসডাঙ্গায়’ আসতেন সাহেবরা।
ফরাসিরা এই অঞ্চলে আসা আরম্ভ করেছিল ১৬৭০ খৃষ্টাব্দ থেকে,সঙ্গে এসেছিল ধর্ম-যাজকের দল। কয়েকটি বড় গির্জা গড়ে উঠেছিল, যার মধ্যে প্রধান ছিল সেক্রেড হার্ট চার্চ, যা আজও অসংখ্য পর্যটকের প্রধান দর্শনীয় স্থান। এই সুদৃশ্য গির্জাটি ভারতে ফরাসি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। অনতিদূরে,চন্দননগর লেক বা লালদীঘির সামনে আছে একটি বিখ্যাত ফরাসিদের কবর-স্থান সেক্রেড হার্ট সিমেট্রি। এই লালদীঘির সামনেই ছিল সুদৃশ্য ফরাসি দুর্গ, ‘ফোর্ট অর্লিয়েন্স’। ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেক্রেড হার্ট সিমেট্রি যদিও বর্তমানে অনেকাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত তবুও রাজ্য সরকার আংশিক পুনরুদ্ধার করেছে। সিমেট্রির ভিতরে আছে একটি সুদৃশ্য চ্যাপেল। এই সমাধিস্থলে চন্দননগরের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিস ডুপ্লেক্স, আবহাওয়াবিদ হেনরি পেডিংটন-সহ ১৫০টি কবরে শায়িত আছেন সেদিনের দৌর্দণ্ডপ্রতাপ ফরাসি প্রশাসনের গণ্যমান্যরা।
১৭৫৬ সালে ব্রিটিশ নৌবহর চন্দননগর আক্রমণ করে, ২৩ মার্চ ১৭৫৭-তে চন্দননগর দখল করল। ছ’বছর পরে সন্ধির শেষে ফরাসিরা স্থানটি ফেরত পেল। আবার ১৭৯৪-তে ব্রিটিশ নৌবহর পুনরায় চন্দননগর দখল করল, ফেরত দিল বাইশ বছর পরে। হুগলি নদীর তীরে এক-ফালি স্থানটি এতই মূল্যবান ছিল ব্রিটিশ আর ফরাসি সাম্রাজ্যের কাছে যে, এর জন্য বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল তারা। ভারত স্বাধীন হবার পরেও চন্দননগর ছিল ফরাসি সাম্রাজ্যের অংশ। স্বাধীন ভারতের বুকে বিষফোঁড়ার মতোই চন্দননগর ছিল বিদেশি সাম্রাজ্যের অধীন।
ভারত সরকারের চাপে ১৯৪৮ সালে ফরাসি সরকার, এক গণমত বা ‘প্লেবিসাইট’ অভিযান করে হস্তান্তর বন্ধ করার চেষ্টাও করেছিল কিন্তু চন্দননগরের ৯৭ শতাংশ জনগণ ভারতের সঙ্গে যোগ দেবার পক্ষেই ভোট দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৯ জুন ১৯৫২ সালে চন্দননগর আইনানুগ ভারতের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যায় এবং ২ অক্টোবর, ১৯৫৪-তে একে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
চন্দননগরের অন্যতম প্রধান স্কুল আর কলেজ ছিল কলেজ ডুপ্লেক্স (এখন কানাইলাল বিদ্যামন্দির আর চন্দননগর কলেজ)। শহরের প্রবেশ মুখে, ১৯৩৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল চন্দননগর গেট। গেটে চব্বিশ ঘণ্টা মোতায়েন থাকত উর্দি-পরা রাইফেলধারী প্রহরী। ফরাসি বিদ্রোহের অবসানে কুখ্যাত ‘বেস্টিল’ কারাগারের গেট খোলার স্মারক হিসাবেই তৈরি হয়েছিল এই গেট। পিলারে খোদাই করা ছিল, ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্র্যাটারনিটি’। আজও এই গেটের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
ফরাসিদের প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী-গঞ্জ বাজার ছিল তখনকার দিনের সবচেয়ে বড় চালের গুদাম আর পাইকারি বাজার। রবার্ট ক্লাইভ একে ‘গ্র্যানারি অফ বেঙ্গল’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এই বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আছে বিখ্যাত রথতলা, যেখানে রথের দিনে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা শুরু হয় আর বিশাল মেলা বসে।
এখানে আছে বহু পুরনো নন্দদুলাল মন্দির, নৃত্য-গোপাল স্মৃতি মন্দির, বিশালাক্ষী মন্দির, ইত্যাদি। নৃত্য-গোপাল স্মৃতিমন্দিরে পুস্তকাগার ছাড়াও আছে একটি নাট্যমঞ্চ। পুস্তকাগারে আছে বাংলা, ইংরাজি ও ফরাসি বইয়ের সংগ্রহ। কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ২০০২ সালে একটি সুন্দর পার্ক ও পিকনিক উদ্যান বানিয়ে দিয়ে শহরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়েছে। শীতের দিনে এটি জনপ্রিয় ভ্রমণ ও বন-ভোজন বা পিকনিক গার্ডেন হওয়ায়, দূর দূর থেকে পর্যটক আকর্ষণ করে।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীপুজো এখন ভারতের সীমা অতিক্রম করে আশেপাশের দেশগুলিতেও প্রচলিত হয়েছে। এই পুজো প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। দুর্গাপুজোর মতোই পাঁচদিন পুজোর পর বিশাল মিছিল করে প্রতিমাগুলি নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। ব্রাজিলের রিও ডি জেনাইরোর পরেই এই মিছিল, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম।
এই শহরেই বাস করতেন কিছু প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ। রাধানাথ শিকদার যিনি গণিতের সাহায্যে প্রথম মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয় করেছিলেন, মতিলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মণীন্দ্র নাথ নায়ক, বাসবি পাল, ঈশান পোড়েল প্রমুখ।
চন্দননগরের একটি অতি আপন এবং আদিম ছানার মিষ্টি আছে। সেটি হল জলভরা সন্দেশ। একবার নাকি অভিনেতা বিকাশ রায় এসেছিলেন স্থানীয় জ্যোতি সিনেমা হলে কোনও ছবির উদ্বোধনে। স্বভাবতই ওঁকে জলভরা সন্দেশ খেতে দেওয়া হয়েছিল। উনি না জেনে সন্দেশে একটা বড়সড়ো কামড় দিতেই, রস পড়ে ওনার জামাকাপড় নষ্ট হয়েছিল। অভিনেতা নাকি খুশি হয়ে মন্তব্য করেছিলেন,‘চন্দননগরের লোকেরা বড় সাংঘাতিক মশাই, এরা সন্দেশের ভিতরেও জল ভরে রাখে!’
শীতে একটি বেলার ভ্রমণের জন্য তুলনা নেই চন্দননগরের। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল/বর্ধমানগামী ট্রেনে ৪৫/৫০ মিনিটে মানকুন্ডু বা চন্দননগর স্টেশনে পৌঁছে, টোটোতে স্ট্র্যান্ডে চলে আসুন। অথবা শিয়ালদহ থেকেও ট্রেনে শ্যামনগর/জগদ্দল পৌঁছে অটো/টোটো করে লঞ্চঘাটে নদী পেরিয়ে সোজা স্ট্র্যান্ডে পৌঁছনো যায়।