১৯৯৫ সাল। সদ্য কলেজ ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে। বুকের মধ্যে তখন টলটলে প্রেমের দিঘি। সেই সময় সিনেমা হল কাঁপিয়ে চলছে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’। একদিন কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গেলাম সিনেমা হলে ‘ডিডিএলজি’ দেখতে। রাজ সিমরণের প্রেমে মন জারিত হলেও, স্বপ্ন বীজ বুনল সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে ঘুরে বেড়ানোর। সবুজ গালিচার মতো উপত্যকার মাথার উপর তুষারমৌলি পর্বত শিখর, নীলকান্ত মণি কিংবা পান্না সবুজ হ্রদ। মাউন্ট টিটলিস হোক বা ম্যাটার্নহর্ন, হৃদয়ের গভীরে চিরকালীন স্থান নিল সুন্দরী সুইজারল্যান্ড। নাহ্, আজও সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি তবে, ‘যা সিমরন জি লে আপনি জিন্দেগি’কে আপ্ত বাক্য ধরে নিয়ে, সারা বছর ঘুরে বেড়াই।
ইউরোপ ঘোরার সাধ্য নেই, তাই আমার বিদেশ নেপাল। সারা পৃথিবীর মানুষ হিমালয়ের টানে হাজির হয় নেপালে। এখানে গাড়ি নিয়ে কিংবা ট্রেকে গেলে, ঘাড়ের উপর ৭০০০- ৮০০০ মিটার উচ্চতার শৃঙ্গগুলি যেন সারদিন নিশ্বাস ফেলে। মেঘ বালিকারা খেলে বেড়ায় এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের বুকে। সবুজ বনানীর মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো পড়ে যখন দেহে উষ্ণতার পরশ ছড়িয়ে দেবে, তখন জানালায় উঁকি দিয়ে কিরীটি রাজ বলবে ‘দেখো আমার সোনালি রাজ মুকুট!’ স্বল্প সময়ে, অল্প খরচে এমন অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমির কথাই আজ বলব।
ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজের ছুটি কিংবা পরীক্ষা পরবর্তী সময়ে, সবাই বেড়ানোর পরিকল্পনা করে রেখেছেন। লাদাখ,কাশ্মীর, হিমাচল, গাড়ওয়াল নিশ্চয়ই পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে। কিন্তু নেপালের কথা ভাবছেন না কেন? চৌদ্দটি আট হাজারি শৃঙ্গের মধ্যে দশটি শৃঙ্গই তো নেপালে রয়েছে। গাড়ি নিয়ে কিংবা সামান্য হাঁটলেই তার দোর গোড়ায় পৌঁছে যাওয়া যায়। সারা পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসে এই অপার্থিব সৌন্দর্যের টানে। এখানে বেড়ানোর খরচ কুলু মানালি, কাশ্মীরের থেকেও কম এবং প্রাপ্তি অনেক বেশি।
নেপালের এমন একটি জায়গা হল মানাং, যাকে মর্ত্যলোকের স্বর্গ বললেও অত্যুক্তি হবে না। মধ্য নেপালে অবস্থিত ৫৫ কিমি দীর্ঘ পর্বতমালা অন্নপূর্ণা। পৃথিবীর দশম উচ্চতম শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা -১। এই পর্বতমালায় আরও ৭টি ৭০০০ মিটার উচ্চ শৃঙ্গ রয়েছে। এই পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে অবস্থিত ছোট্ট নেপালি গ্রাম মানাং। এটি সুইজারল্যান্ডের বিকল্প নয় বরং আরও আকর্ষণীয়। সেখানে জীবনের সেরা সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে! না কষ্ট করে ট্রেক করে যেতে হবে না, গাড়ি চলে আসে এই স্বর্গের দুয়ারে।
হাওড়া থেকে বিকেলে মিথিলা এক্সপ্রেস ধরলে সকালেই রক্সৌল পৌঁছে যাবেন। এখান থেকে টাঙা কিংবা অটোতে বর্ডার পেরিয়ে চলে আসুন নেপালের বীরগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে। বাসে কিংবা শেয়ার গাড়িতে ডুমরে। ডুমরে থেকে পৌঁছতে হবে বেসি শহর। এছাড়া বাসে কিংবা শেয়ার গাড়িতে পোখরা। পরের দিন সকালে পোখরা লেকের ধারে নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড অফিস থেকে আধার কার্ড কিংবা পাসপোর্ট দেখিয়ে অন্নপূর্ণা কনজার্ভেশন এরিয়ার অনুমতিপত্র সংগ্রহ নিন। সারাদিন পোখরা ঘোরার ফাঁকে, পরের দিনের জন্য বাসের সিট বুকিং করে রাখতে পারেন। কিংবা নিতে পারেন শেয়ার জিপ। নিজস্ব গাড়ি বুক করলে সময়ের সাশ্রয় হবে।
পরের দিন পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছে যান লামজুন জেলার সদর বেসি শহরে। এই বেসি শহরে পৌঁছলেই দেখা যায় তিনটি বিখ্যাত শৃঙ্গের শিখরদেশ- মানাসলু, অন্নপূর্ণা ও ধৌলাগিরি। যারা বেসি শহরে সরাসরি যাবেন, ওখান থেকেই অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন।
পরের দিন আবার শেয়ার গাড়ি করে থাকুন চামে কিংবা পিসাং-এ। সারা পথ জুড়েই সঙ্গে থাকবে কুলকুল করে বয়ে চলা নীলবসনা মার্সিয়াংদি নদী। থাকবে সবুজে ঢাকা পাহাড়ের বুক বেয়ে আসা অসংখ্য ঝরনা। একটার পর একটা আপেল বাগান পড়ে এই পথে। অপূর্ব সুন্দর জায়গা এই পিসাং। বাঁদিকে প্রায় হাত ছুঁয়ে থাকা দুরত্বে অন্নপূর্ণা -২ আর ডান দিকে পিসাং শৃঙ্গ।
পিসাং দেখে পরের দিন চলুন মানাং। পিসাং অতিক্রম করলেই দৃশ্যপটের বদল ঘটতে শুরু করে। সবুজ ছেড়ে ধূসর রঙের জগতে আপনাকে স্বাগত জানাবে প্রকৃতি। তুষার আর বাতাস মিলিতভাবে সারা পথ জুড়েই তৈরি করেছে অপরূপ সব দৃশ্যপট। বিখ্যাত কিছু পর্বত শিখর সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে উপত্যকার দুই পাশে। আর অন্নপূর্ণা পর্বত শ্রেণী বাঁদিকে মাথার উপর সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে এই ভূখণ্ডের প্রহরীর মতো। সারি সারি তুষার মুকুটপরা অন্নপূর্ণা ১,২,৩,৪, গঙ্গাপূর্না, পিসাং, তিলিচো পিক, চোলু পূর্ব, ধৌলাগিরি, মানাসলু ,গ্রেট ব্যারিয়ার ওয়াল- দাঁড়িয়ে আছে হাতের নাগালে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে উচ্ছ্বল মার্গশায়ান্দি নদী।
গণ্ডকি প্রভিন্সের মানাং জেলার সদর হল মানাং। বাজেট থেকে স্টার কোয়ালিটির সব রকম হোটেল রয়েছে। সাড়ে তিন হাজার মিটার উচ্চতার এই ছোট্ট শহরে, দু-তিন দিন চোখের নিমেষেই কেটে যাবে।
তিব্বতীয় মালভূমির ল্যান্ডস্কেপ ধরা পড়বে চোখে। মানাং থেকেই ঘুরে নেওয়া যায় আইস লেক, গঙ্গাপূর্ণ লেক, ৫০০ বছরের পুরনো ব্রাগা গুম্ফা, মিলরাপা গুহা। একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হলে তিনদিনের হাঁটা পথে ঘুরে আসতে পারেন পৃথিবীর উচ্চতম এবং স্বর্গীয় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ তিলিচো লেক। নেপালকে আবিষ্কার করুন নতুন চোখে। সারা জীবন মনের মণিকোঠায় স্থান পেয়ে যাবে এই ভ্রমণ!