• facebook
  • twitter
Friday, 17 January, 2025

স্মৃতির শহর অমৃতসর

অমৃতসরের পর্যটন কেন্দ্রের একেবারে শীর্ষস্থানে রয়েছে স্বর্ণ মন্দির। আরও আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মস্পর্শী কাহিনী বিজড়িত স্মৃতিসৌধ জালিয়ানওয়ালাবাগ। আছে ওয়াঘা সড়ক সীমান্ত, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াত হয়। ঘুরে এলেন শ্রীপর্ণা দে।

ফাইল চিত্র

ইতিহাসের ধূলিধুসরিত অতীত অধ্যায়গুলোর প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ আমার ছোট থেকেই। তাই অক্টোবরে পাঁচ দিনের ঝটিকা সফরে বেরিয়ে পড়েছিলাম অমৃতসর দেখার অভিপ্রায়ে।  অমৃতসর যাওয়ার জন্য কলকাতা স্টেশন থেকে দুপুর বারোটা দশে আমাদের ট্রেন রওনা দিল। দুর্গিয়ানা এক্সপ্রেসে একদিনের বেশি সময় কাটিয়ে আমরা অমৃতসর স্টেশনে পৌঁছলাম সন্ধ্যে ছ’টায়।

স্টেশনের বাইরে এসে অটো ধরে হোটেলে পৌঁছলাম। হোটেল থেকে স্টেশনের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। ফ্রেশ হয়ে একটু চা-পকোড়া খেলাম। অমৃতসর ঘুরে দেখার জন্য হোটেল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে জানাল। সেদিনের মতো আমরা ডিনার সেরে ঘরে চলে এলাম। আমাদের প্ল্যান ড্রাইভারকে ফোনে সংক্ষেপে বলে দিলাম। ড্রাইভার বলল সকাল ন’টায় রেডি থাকতে। বিছানায় টানটান হয়ে শুতেই ঘুম এসে গেল।

বেশ মনোরম আবহাওয়া অমৃতসরের। ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়লাম। এদিন আমাদের পরিকল্পনা ছিল স্বর্ণ মন্দির এবং পার্টিশন মিউজিয়াম দেখার। তবে দিনের প্রথম গন্তব্য ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ। হোটেল থেকে প্রায় দেড় কিমি দূরত্বে পার্টিশন মিউজিয়মের কাছাকাছি গাড়ি থামল। ব্যস্ত শহর, লোকজনও ব্যস্ত। গাড়ি থেকে নেমে জালিয়ানওয়ালাবাগের উদ্দেশ্যে আমরা পা বাড়ালাম। জালিয়ানওয়ালাবাগ ও স্বর্ণ মন্দিরের একদম সামনে পর্যন্ত কোনও গাড়ি যায় না। প্রায় এক কিমি পথ হেঁটে সকলে জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশ করলাম।

স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মস্পর্শী কাহিনী বিজড়িত স্মৃতিসৌধ জালিয়ানওয়ালাবাগ। ৬.৫ একর জুড়ে এই বিস্তৃত উদ্যানে প্রবেশ করতেই শিরায় শিরায় রক্তের উতপ্ত স্রোত বয়ে গেল। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে এই উদ্যানে পুরুষ, মহিলা, শিশুদের একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল। নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর এই জঘন্য গণহত্যা সারা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। উদ্যানে বিশাল পাথরের স্মারকটি ইতিহাসের ওই কালো অধ্যায়কে বারবার মনে করিয়ে দেয়। এই উদ্যানে বিভিন্ন গ্যালারিতে পূর্বে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনা, ভিডিওগ্রাফির মাধ্যমে দেখানো হচ্ছিল। সমসাময়িক নানা তথ্যও সংরক্ষণ করা হয়েছে ওই গ্যালারিগুলিতে। শহিদদের প্রতি সমবেদনা ও শ্রদ্ধা জানাতে এখানে পর্যটকদের ভিড়। বাগানের একটি অংশের দেওয়ালে বুলেটের চিহ্ন ও অভিশপ্ত কূপ সেই পরাধীন ভারতবাসীর জ্বালাকে স্মরণ করায়। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা স্বর্ণ মন্দিরের পথ ধরলাম।

জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে স্বর্ণ মন্দির পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। আমাদের অজান্তেই স্বর্ণ মন্দিরে সেদিন গুরু পুরব (গুরু নানক জয়ন্তী) পালন হচ্ছিল। শিখ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষজন ছাড়াও পর্যটকরা ভিড় করেছেন পবিত্র মন্দির প্রাঙ্গণে। শিখদের উপাসনার এই স্থানটি শ্রী হরমন্দির সাহেব বা দরবার সাহিব নামেও পরিচিত।

অমৃতসরের পর্যটনকেন্দ্রের একেবারে শীর্ষস্থানে রয়েছে স্বর্ণ মন্দির। এই মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী এককথায় অতুলনীয়। এখানে যেন হিন্দু ও ইসলামিক শিল্পরীতির সমন্বয় ঘটেছে। খাঁটি সোনায় মোড়া মন্দিরের চূড়া। মন্দিরের অভ্যন্তরের দেওয়ালগুলির মূল্যবান পাথর, মীনাকারি ও কাচের কাজ দেখবার মতো। একটি কৃত্রিম হ্রদের শান্ত জল গোল্ডেন টেম্পেলের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়।

গোল্ডেন টেম্পেলে প্রবেশের সময় মাথা কাপড় দিয়ে আবৃত করলাম। আমাদের জুতোগুলো নির্দিষ্ট স্থানে খুলে, পা ধুয়ে মার্বেলের মেঝের উপর হেঁটে গুরুদ্বারে প্রবেশ করলাম। অন্যদিনের তুলনায় প্রচণ্ড ভিড়। মন্দিরের ভিতরে ভক্তরা গান গাইছে। জনসমুদ্র ঠেলে আমরা প্রসাদ গ্রহণ করলাম। আমরা লঙ্গর (নিরামিষ খাবার) গ্রহণ করে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এলাম।

স্বর্ণ মন্দির থেকে সাত-আট মিনিট হেঁটে পার্টিশন মিউজিয়মে এলাম। টাউন হলে অবস্থিত এই মিউজিয়মটিতে প্রবেশ মূল্য দশ টাকা। দেশভাগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ছবি, তাদের জিনিসপত্র, তাদের বাসনপত্র, মুদ্রা, তাঁবু প্রভৃতি এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। মিউজিয়মটি বেশ সুসজ্জিত। দেশভাগের দগদগে ক্ষত যেন মিউজিয়মের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা মিউজিয়ম দেখে হোটেলে ফিরলাম।

পরের দিন সকাল এগারোটায় আমরা দুর্গিয়ানা মন্দির, খালসা কলেজ, আত্তারি বর্ডার যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল দুর্গিয়ানা মন্দির। অমৃতসর শহর পবিত্র হিন্দু ধর্মস্থান। হোটেল থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় দেড় কিমি। হিন্দু মন্দির হলেও এটি স্বর্ণ মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেছে শিল্প শৈলীতে। মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তদের ভিড়। ভক্তিমূলক গান হচ্ছিল অদূরেই। দেবী দুর্গা এখানে পূজিত হন। এছাড়া লক্ষ্মী ও বিষ্ণুর মূর্তিরও পূজা করা হয়। মন্দিরটি একটি পবিত্র হ্রদের মাঝখানে অবস্থিত। মন্দিরের উপরিভাগ সোনালি। সাদা মার্বেলের মেঝের উপর হাঁটতে হাঁটতে প্রশান্তি অনুভব হয়। মন্দিরটিতে অপূর্ব কারুকার্য খচিত বৃহৎ রুপোলি একটি দরজা রয়েছে বলে, স্থানীয়রা একে সিলভার টেম্পেল বলেন। আমরা ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে এলাম।

দুর্গিয়ানা মন্দির থেকে প্রায় দশ মিনিট গাড়িতে করে আমরা পৌঁছলাম খালসা কলেজ। বিভিন্ন সিনেমার শুটিংয়ের জন্য অমৃতসরের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই কলেজ। কলেজটির বিস্তৃত ক্যাম্পাস আমাদের মুগ্ধ করেছিল। সবুজ ঘাসের গালিচার উপর গম্বুজ-যুক্ত লাল বেলেপাথরের অপূর্ব বিল্ডিংটি বেশ সুন্দর। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য ছোট একটি জাদুঘরও রয়েছে।

লাঞ্চ করে এবার এগোলাম আত্তারি বর্ডারের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার আমাদের জানাল যে, প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগবে আত্তারি-ওয়াঘা বর্ডার পৌঁছতে। রাস্তার জ্যাম কাটিয়ে গাড়ি ছুটল। বিকাল ঠিক চারটে পনেরোয় পৌঁছলাম। প্রচুর লোকজনের সমাগম এখানে। পার্কিং-এ গাড়ি থামতেই আমাদের কপালে গালে ভারতের জাতীয় পতাকা আঁকার জন্য বেশ কয়েকজন অনুরোধ করল। আমরা শরীরে জাতীয় পতাকার ছবি আঁকালাম।

পার্কিং থেকে এক মিনিট হেঁটে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ালাম, ভিতরে প্রবেশের জন্য। পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা লাইন পড়ে এখানে। চেকিং হওয়ার পর ভিতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে। চেকিং হয়ে যাবার পর আমরা ‘বিটিং রিট্রিট’ বর্ডার অনুষ্ঠান দেখার জন্য ঢুকলাম। বিকাল পাঁচটায় এখানে প্রতিদিন অনুষ্ঠান হয়। শত শত ভারতীয় দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে এই অনুষ্ঠানে সামিল হন। এটিই একমাত্র সড়ক সীমান্ত, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াত হয়। আমরা সাক্ষী রইলাম সীমান্ত পেরিয়ে এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যাওয়া আসা করছে সেটা দেখার। পাকিস্তানে ওয়াঘা গ্রাম সীমান্ত থেকে ছয় শত মিটার দূরে এবং ভারতের আত্তারি গ্রাম চারশো মিটার দূরে বলেই এটিকে কেউ আত্তারি বর্ডার বলেন, কেউ আবার ওয়াঘা বর্ডার বলেন।

যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা চলল। উভয় দেশের সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করে দ্রুত সামরিক মহড়া দেয়, দুই দেশের বর্ডার উন্মুক্ত করা হয় কিছুক্ষণের জন্য। উভয় দেশের পতাকা নামানো হয় অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে। আগত দর্শকদের উৎসাহিত করার জন্যই দেশপ্রেমমূলক সংগীত বাজানো হয়। এ যেন দর্শকদের কাছে এক বর্ণিল ট্রিট। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স দ্বারা আয়োজিত এই অনুষ্ঠান আমাদের ভালো লেগেছিল।

সন্ধে সাতটার পর আমরা হোটেলে ফিরলাম। পথে লাহোর ২২ কিমি লেখা একটি মাইলস্টোন চোখে পড়ল। লেন্সবন্দী করলাম অমৃতসরের পথের নানা দ্রষ্টব্য। অমৃতসরকে বিদায় জানিয়ে আমরা পরের দিন দুপুরে জালিয়ানওয়ালাবাগ এক্সপ্রেস ধরলাম কলকাতা ফেরার জন্য।