আলবিদা সাকুরা!

পাহাড় হোক বা সমুদ্র বা প্রত্যন্ত গ্রাম যেন পর্যটনের খনি! আমাদের কাছে এখনও লুকিয়ে রয়েছে বহু অজানা ডেস্টিনেশন৷ প্রকৃতির কোলে শায়িত ডেস্টিনেশন৷ দেশ ও বিদেশের সেইসব নয়া ঠিকানা পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতেই আমাদের প্রচেষ্টা ডেস্টিনেশন-মন ভালো৷

রুনা চৌধুরী (রায়)

জাপানে বসন্তের শিশির সিক্ত সকাল৷ চতুর্দিকে এখনও শতের কিঞ্চিৎ আমেজের ছোঁয়ায় রোমান্সের স্পর্শ৷ উপরে মেঘমুক্ত আকাশে পেঁজা তুলোর রাশি, আর তারই মাঝে ভরা উজ্জ্বল যৌবনের ডালি নিয়ে সাকুরার দল আহ্বান জানাচ্ছে বসন্তের রঙিন নতুন দিনগুলিকে৷ সারা বছরের মধ্যে এই একটি মাসের জন্যে সবার আকুলি বিকুলি নিঃসারে সারা বছরের দিন গোনা৷ সমস্ত জাপান জুড়ে এসেছে সেই বহু আকাক্ষ্ণিত বহু অভিলিপ্সিত সাকুরার দিনগুলি৷ জাপানের দক্ষিণ থেকে উত্তর অর্থাৎ কিসসু থেকে হোস্কাইজে পর্যন্ত স্থান জুড়ে সাকুরা তীরে স্থানাধিকারে জমিয়ে রেখেছে৷ সারা বছর গাছগুলি থাকে পত্রহীন৷ শীত বিদায় নেবার পর থেকে ফুল, কুঁড়ি উঁকিঝুঁকি মারে গাছের ডালপালার আনাচে কানাচে৷ সেই সঙ্গে জাপানিদের মনে ভ্রমর গুঞ্জনের নতুন সুর গুনগুন হতে থাকে৷ গাছগুলোকে দেখে মনে হয় ওরা বড় নিঃসঙ্গী, হাওয়ার দমকায় কোমল বৃন্তচু্যত হতে ওদের দেরি লাগে না৷ তাই বুঝি ছুটির সকালে দলে দলে সমব্যথী মানুষ ওদের সমবেদনা জানাতে যায়৷ আদরে ভরিয়ে দেয়৷ উপরের ফ্রেমে জমাটি কালো মেঘ যখন তার কালো বোরখার আবরণ উন্মোচন করে সোনালি ঝলমলে রোদে চকচক করে ওঠ, তখনই কাঁচা সোনালি রোদে কাঞ্চনবর্ণ ধারণ করে সাদা আর আবছা বেগুনি রঙের ঘের দেওয়া সাকুরার দল৷ পত্রহীন গাছে থেকে ভরা ফুলেরই সমাহার৷


সাকুরার ইংরাজি নাম ‘চেরি’৷ জাপানি পরিবেশে সাকুরা নামটাই কিন্ত্ত সকলের পছন্দ এবং জনপ্রিয়৷ প্রথম যেদিন সাকুরার দর্শন পেলাম, সেদিনটার কথাই আজ বেশি মনে পড়ে৷ জাপানি বনকুরা জিন্জাসনে, মায়ুচান আমার দুৃ-হাত ধরে বলে উঠল, আমাদের সাকুরা দেখতে যাবে না? কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করি, সাকুরা? সেটা আবার কী? সাকুরা ওয়াতাসিনো হানা দেসনে, অর্থাৎ আমাদের শ্রেষ্ঠ ফুল৷ অবাক বিস্ময়ে সেদিন সাকুরার মেলা দেখেছিলাম৷ এমনিতেই জাপানিরা ফুল, গাছপালা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন৷ টাইফুনে বা জোরালো হাওয়ায় যাতে না পড়ে যায় কাঠ বা বেড়া দিয়ে গাছগুলিকে সযত্নে ঘিরে রাখে, প্রত্যেক গাছে কীটনাশক ওষুধ দিয়ে ঢেকে রাখে৷ দিনের শেষে হোসপাইপের সাহায্যে গাছগুলিকে স্নান করায়৷ নানান কায়দায় ফুল সাজিয়ে গৃহের শোভাবর্ধন করে৷ ইকেবানা তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ৷ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের থেকে ছাত্রছাত্রীরা এদের ফুল সাজানোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের জন্য আসে৷ আসল কথা সাকুরা জাপানিদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এর বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণ আবির্ভাবের জন্যই হয়তো সাকুরা জাতীয় ফুল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে৷ পত্রহীন গাছে কত রকম সাকুরাই না তার পসার খুলে বসেছে৷ লাল, গোলাপি, সাদা, হালকা হলুদ, আবছা বেগুনি রঙের প্রস্ফুটিত প্রজাপতির মেলা তাদের নয়ন ভোলানো রূপ নিয়ে মানুষকে প্রলোভিত করেই যাচ্ছে৷ বহু দূর থেকে ফুলগুলোর জ্যোতি মানুষকে আকৃষ্ট করে কাছ টেনে নেয়৷ মনে সাড়া জাগিয়ে তোলে৷ সমস্ত পুল একে অন্যের গলা জড়িয়ে উল্লাসের সৃষ্টি করে মন কেড়ে নেয়৷
একক চিন্তাধারার বশবর্তী জাপানিরা সেদিন তাদের কোদোমোসান অর্থাৎ শিশু ছেলেমেয়েদের হাত ধরে, কোলে নিয়ে, কেউ বা ওবাসান টাকুমার পিঠে চড়ে ভাই বোন হাত ধরাধরি করে, সৌখিন ভ্যানিটি কাঁধে বা হাতে ঝুলিয়ে, প্রেমিক-প্রেমিকার যুগল মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাকুরার ঘন আচ্ছাদনের নীচে, পরম শান্তিতে, সুখের দোলায় সাকুরার উদ্দেশ্যে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে মনের নিভৃতে৷ আজ আর কেউ একা নেই৷

থোকা বাঁধা সাকুরার সঙ্গে সঙ্গে মানুষও কেমন থোকা বেঁধে গুঞ্জনে রত৷ ধূমকেতুর মতো ১০-১৫টা দিনের জন্য ক্ষণিক আবির্ভাবের জন্যই হয়তো ওদের ধরে রাখার জন্য মানুষের এত প্রচেষ্টা৷ জাপানের অধিবাসীরা সাকুরাকে তাদের অনেক জায়গায় প্রতীক চিহ্ন রূপে ব্যবহার করে৷ প্রেম আর ভক্তির মূর্ত প্রতীক সাকুরা তার ভরা যৌবনের ডালি সাজিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে আবাহনে রত থাকে৷ এই সাকুরাকে কেন্দ্র করে রচনা হয়েছে গত গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গদ্যগ্রন্থ৷ জাপানিরা জীবনের ইতিহাসের প্রথম পাতাতেই সাকুরা তার স্থান দখল করে নিয়েছে অনেক আগে৷ সৃষ্টির অধীশ্বর সুখ, সৌন্দর্যের ডালির রূপক জাপানকে সাকুরার মতো সৌন্দর্যময়ী ফুলদানে আরও ব্যতিক্রম করে তুলেছে৷ টোকিওর শিনজিকু বাগানে গেলেই দেখা যাবে সারি সারি দণ্ডায়মান ঘন সন্নিবেষ্টিত সাকুরার দল৷ দূর থেকে দেকলে মনে হবে সত্যি যেন আকাশ থেকে মেঘের দল নেমে এসে ধরার বুকে নজরবন্দি হয়ে আছে৷ তারই কোল ঘেঁষে আবাল-বৃদ্ধবনিতা আনন্দোল্লাসের পসরা সাজিয়েছে৷ পরিখা ঘেরা রেইন-বো হোটেলের পাড় দেওয়া উঁচু পাঁচিলের গায়ে গায়ে সাকুরার সারি চলার পথে আপনাকে অন্তঃত একবার থমকে দাঁড় করবেই৷ সাকুরার গান জাপানের প্রত্যেকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়৷ আধফোটা কথা বলা ছেলেমেয়েরাও গেয়ে চলেছে এই গান৷ যেদিন প্রথম জাপানের বিখ্যাত এন.এইচ.কে টেলিভিশনে দেখলাম সাকুরা গাছের তলায় দণ্ডায়মান স্কুলের ছেলেমেয়েরা সাদা পোশাকে সজ্জিত হয়ে সার বেঁধে সাকুরার গান সমবেত কণ্ঠে শোনাচ্ছে সেদিন সত্যিই অভিবূত হলাম৷
আজ স্মৃতিচারণের সময়ে সাকুরা বিদায় নিয়েছে, গাছ ভরে রয়েছে কচি পাতার ভিড়৷ কিন্ত্ত মন থেকে মোছেনি সাকুরার স্মৃতি৷ কে কোথায় চলে যাবে কিন্ত্ত সাকুরা তার নবরূপে সকলকে আহ্বান জানাবে৷