ধর্ম আর ইতিহাসের হাতছানিতে আদি সপ্তগ্রাম 

অরিন্দম ঘোষ 
(১)
হঠাৎ করে স্থির করলাম হুগলি জেলায় অবস্থিত আদি সপ্তগ্রামে যাব৷হঠাৎ করে বলাটা ভুল,মনের মধ্যে অনেকদিন ধরেই ইচ্ছেটা সুপ্ত অবস্থায় ছিল৷কিন্ত্ত বিভিন্ন কারণে সেটাকে রূপায়িত করতে পারছিলাম না৷ এখন প্রশ্ন,কেন যেতে চাইছিলাম এই জায়গায়? এর কারণ পশ্চিমবঙ্গের টেরাকোটার মন্দির অনেক দেখেছি৷কিন্ত্ত টেরাকোটার কারুকার্যখচিত মসজিদ সচরাচর কখনও চোখে পডে়নি৷ তাই সেই লোভ সম্বরণ করতে পারিনি৷ সাথে উপরি পাওনা সরস্বতী নদী, যাকে কেন্দ্র করে একসময় এখানে গডে় উঠেছিল সম্বৃদ্ধ বন্দর৷ ‘সপ্তগ্রাম’ বা সাতগাঁও ছিল মধ্যযুগীয় বাংলার এক অন্যতম প্রধান বন্দর৷ শুধু তাই নয়, দক্ষিণ বঙ্গের প্রধান নগরী হিসাবেও এর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল৷ সপ্তগ্রাম আসলে ছিল সাতটি গ্রামের সমষ্টি৷ এই সাতটি গ্রাম ছিল- বাঁশবেডি়য়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বচোরা ও বলদঘাটি৷
‘সপ্তগ্রাম’ নামের বু্যৎপত্তি সম্পর্কে একটি পৌরাণিক কাহিনী অনেককাল ধরেই প্রচলিত৷ কনৌজের রাজা প্রিয়বন্তর সাতজন পুত্র ছিল- অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুস্মান, জ্যতিস্মান, দু্যতিস্মান, সবন ও ভব্য৷ এই সাত ভাই রাজকীয় জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে নিভৃতে ধ্যান করার জন্য তাঁরা উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে বের হন৷ শেষ পর্যন্ত গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত স্থানের সন্ধানে বের হন৷ শেষ পর্যন্ত গঙ্গা,যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত স্থানের সন্ধান পান ও সেখানকার সাতটি গ্রামে  নিজ নিজ আশ্রম স্থাপন করেন৷ আর এইভাবেই সেই সাতটি গ্রামকে ঘিরে গডে় ওঠে সপ্তগ্রাম নগরী৷
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সপ্তগ্রামের উল্লেখ থেকে এই বন্দরের খ্যাতি সম্পর্কে অনেক কথাই জানা যায়৷ পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিপ্রদাস পিপলাইয়র ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে দেখা যায় চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তগ্রাম বন্দর হয়ে সাগরের উদ্দেশে পাডি় জমাত৷ ষোড়শ শতাব্দীতে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন যে এই সপ্তগ্রাম বন্দর থেকে বনিকরা বিভিন্ন পথেও বিভিন্ন দিকে পাডি় দিতেন৷ ১৩৫০ সালে বাংলায় তুঘলকী আমলে ইবন বতুতা সপ্তগ্রামে এসেছিলেন৷ ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পর্তুগীজ বণিকরা সপ্তগ্রামে যাতায়াত করতে শুরু করেন৷

(২)
আদি সপ্তগ্রামে পৌঁছে আমরা প্রথমেই একটি টোটো ভাড়া করে নিলাম৷ দেখতে দেখতে দাশপাড়া পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য উদ্ধরণ দত্তর ঠাকুরবাডি়তে৷ ভীষণই নির্জন, নিরিবিলি-জপ-ধ্যানের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান৷ মন্দিরটি বহু শতাব্দী প্রাচীন হলেও একটি নাম ফলকে দেখলাম ১৩১১ সালের শুভ ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে এই মন্দিরটি নবনির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে অপূর্ব তিন দৈব মূর্তি – ‘দক্ষিণে নিত্যানন্দ বামে গদাধর৷ মধ্যে ষড়ভূজ মূর্ত্তি শ্রী গৌরাঙ্গ সুন্দর৷ ‘মন্দির চত্বরে শ্বেতপাথর নির্মিত শ্রী শ্রীমদ উদ্ধরণ দত্ত ঠাকুরের সমাধি মন্দির, শ্রী শ্রী নামব্রম্ভ মন্দির আর শতাব্দী প্রাচীন ঝাঁকড়া মাধবীলতা গাছ৷ আর এই গাছকে ঘিরে মন্দিরের যাবতীয় মাহাত্ম্য৷
চলে আসি সেই লোককথায়৷ দিবাকর দত্ত নামে এক ধনী বেনে জাতির লোক ত্রিবেণীতে গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর সাক্ষাৎ পান৷ তাঁকে সঙ্গে করে বাডি় নিয়ে এসে তাঁর জন্য একটা ভজন কুটির বানিয়ে দেন, যেটি বর্তমানে ঠাকুরবাডি় নামে পরিচিত৷ নিত্যানন্দ প্রভুর নির্দেশে তিনি গোবিন্দর জন্য ভোগ রান্না করতে শুরু করেন৷ একদিন তিনি নিত্যানন্দ প্রভুর নির্দেশমত সকলকে নিমন্ত্রণ করেন ভোগ গ্রহণ করার জন্য৷ কিন্ত্ত নিমন্ত্রিত সকলে যখন দেখলেন বেনে জাতির এক ব্যক্তি ভোগ রান্না করছেন, তখন তাঁরা প্রসাদ গ্রহণে অসম্মত হলেন৷ নিত্যানন্দ প্রভু সকলকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও কিছুতেই তাঁরা প্রসাদ গ্রহণে রাজি হলেন না৷ দিবাকর রান্না করার সময়ে অরহর ডালের লাঠিকে খুন্তি হিসাবে ব্যবহার করছিলেন৷ নিত্যানন্দ প্রভু সেটা দিবাকরের কাছ থেকে নিয়ে মাটিতে এক জায়গায় পুঁতে দিলেন৷ আর কী আশ্চর্য! তাঁর অলৌকিক মহিমায় সেই লাঠিটি সাথে সাথেই মাধবীলতা গাছে পরিণত হল৷ উপস্থিত ভক্তগণ এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সকলেই চমকিত হলেন এবং প্রসাদ নিয়ে বাডি় ফিরলেন৷ এরপর নিত্যানন্দ প্রভু দিবাকর দত্তর এক নতুন নামকরণ করলেন উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর,কারণ তাঁর হাতের রান্না খেয়েই সকলে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন৷ এই অলৌকিক ঘটনার পর থেকেই দৈব মহিমা চারপাশে ছডি়য়ে পডে় ও মাধবীলতা গাছ সযত্নে ঠাঁই পায় দেবালয় চত্বরে৷ মন্দিরের এক সেবাইত জানালেন যে, মন্দিরের দেবসেবার জন্য চারবার ভোগ নিবেদন করা হয়৷ সকালে বাল্যভোগ, দুপুরে অন্নভোগ, সন্ধায় সন্ধ্যারতি আর রাত্রে সেবা দিয়ে সেবা৷
(৩)
এরপর আমরা উপস্থিত হলাম সৈয়দ জামালুদ্দিন মসজিদে৷ এই স্থাপত্য কীর্তি প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি প্রাচীন৷ এটি বাংলার পোড়ামাটির অলঙ্করণে সজ্জিত এক অনন্য ইঁটের মসজিদ৷ ১৮৭০ সালে গবেষক হায়েনরিখ ব্লকম্যান সপ্তগ্রামে আসেন আর এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য মসজিদের পুব দিকের দেওয়ালের প্রস্তরলিপির তর্জমা করেন৷ কালো ব্যাসল্ট পাথরে খোদাই করা সেই প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায় যে, সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের রাজত্বকালে কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী আমোল শহর নিবাসী সৈয়দ ফকরুদ্দিন আমুলীর ছেলে জনৈক বিদ্বান সৈয়দ জামালুদ্দিন ৯৩৬ হিজরিতে অর্থাৎ ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে রমজান মাসে এই মসজিদ নির্মান করেন৷ উল্লিখিত আমোল শহরটি ইরানে অবস্থিত বলে একদল পণ্ডিতের অভিমত৷ অন্য আর একদল বিদগ্ধ পণ্ডিতের মতে এই আমোল আসলে তুর্কিস্তানের শহর তুর্কমেনাবাদ৷ সে বিতর্ক দূরে থাক৷ আসা যাক মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে৷ মসজিদটি আকারে আয়তাক্ষেত্রাকার, লম্বায় প্রায় ১৪ মিটার এবং  চওড়ায় প্রায় ৯ মিটার৷ মসজিদের উত্তর – পশ্চিম কোণে একটি মিনার৷ অনুমান করা যায় যে, কোনো এক সময়ে মসজিদের চারকোণে চারটি মিনারই ছিল, যা মসজিদের গঠনকার্যকে আরও শৌখিন করে তুলত৷ মসজিদের সামনে অর্থাৎ পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশদ্বার আর উত্তর -দক্ষিণ দিকে দু’টি করে প্রবেশদ্বার৷ মসজিদের পশ্চিমদিকের অর্থাৎ কিবলার দিকের দেওয়ালে অনবদ্য টেরাকোটার কাজ করা তিনটি মিনহার৷ ইসলাম মতে, মক্কার দিক হল কিবলা দিক আর সেই দিকেই মুখ করেই প্রার্থনা করার নিয়ম৷ সেই দেওয়ালের ভিতরের দিকে ঢোকানো অংশই হল মিহরাব৷ আগেকার দিনে যেহেতু মাইক ছিল না, সেই কারণে এই ব্যবস্থা৷ এই মিরহাবের ভিতর বসে ইমাম সাহেব আজান পাঠ করতেন, যাতে সমস্ত মসজিদ প্রাঙ্গণে তা প্রতিধ্বনিত হয়৷ মসজিদটি ছাদবিহীন৷ মনে করা হয় অনেকদিন আগেই সেটা ধ্বসে পডে়ছে৷ প্রার্থনাকক্ষের অভ্যন্তরে দু’টি পাথরের থামের ভগ্নাংশ রয়েছে৷ মসজিদের আশেপাশেও ছডি়য়ে-ছিটিয়ে পডে় রয়েছে আরও অনেক ভাঙা থামের টুকরো৷ এরকম ধরনের থাম ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজির মসজিদের ভিতরেও দেখতে পাওয়া যায়৷ মসজিদের দক্ষিণ – পূর্ব কোণের কাছে একটি উঁচু বেদীর ওপরে রয়েছে তিনটি কবর৷ এই তিনটি উন্মুক্ত সমাধি সৈয়দ ফকরুদ্দিন, তাঁর বেগম এবং খোজার বলেই কথিত৷ তদানীন্তন সময়ে বাডি়তে মহিলাদের কাজে সহায়তা করার জন্য এবং তাঁদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য খোজাদের নিয়োগ করা হত৷ এখানেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি৷ মসজিদটি বর্তমানে পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ বিভাগের অন্তর্গত৷ পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন টেরাকোটার অলংকরণ সম্বৃদ্ধ এই মসজিদ দর্শনের পর আমরা গেলাম সরস্বতী নদী দর্শনে৷ বর্তমানে এই মজে যাওয়া নদী প্রায় খালে পরিণত৷ অতীতের সম্বৃদ্ধশালী সপ্তগ্রাম আর একুশ শতকের আদি সপ্তগ্রামকে মেলানো বড়ই মুশকিল৷ অতীতের সেই গৌরবগাথাকে সঙ্গে নিয়ে প্রবাহহীন, নিস্তরঙ্গ জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে বর্তমান সময়ের আদি সপ্তগ্রাম৷য়
(৪)
পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয় যে, প্রতি বছর এখানে পয়লা মাঘ মাছের মেলা বসে৷ এই মেলা উত্তরায়ণ মেলা নামে পরিচিত৷ নানা রকমের মাছ, কাঁকড়া এই মেলায় আসে৷ মাত্র একদিনের জন্যই এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ দূর – দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এই মৎস্য মেলার টানে ছুটে আসেন৷ বৈষ্ণবদের কাছে এই মেলার ধর্মীয় গুরুত্বও অপরিসীম৷
কিভাবে যাবেন: হাওড়া জংশন থেকে বর্ধমানগামী যেকোনো ট্রেনে আদি সপ্তগ্রাম স্টেশনে নেমে সেখান থেকে টোটো রিজার্ভ করে খুব সহজেই কাঙ্ক্ষিত স্থান গুলি ঘুরে নেওয়া যায়৷
কোথায় থাকবেন: আদি সপ্তগ্রামের কাছে ব্যান্ডেলে থাকার জন্য অজস্র হোটেল আছে৷সেখানে থাকুন৷