প্রথাগত ধর্ম নিয়ে আমাদের বোধ ও বোধির প্রকৃত উন্মেষ ঘটবে কবে?

বরুণ দাস

সম্প্রতি বাংলার একটি প্রথমশ্রেণির সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে (ধর্মের নামে বিষ, আত্মঘাতী ভারত…, ঈশানী দত্তরায়, আবাপ, ১৩ মে, ২০২৪) স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘খুব পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া ভাল যে, ধর্ম দিয়ে আপনার ঘরের উনুন জ্বলবে না, ছেলেময়ের চাকরি হবে না…।’ কথাগুলোর সারবত্তা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তবুও গোটা বিশ্বের সিংহভাগ মানুষই প্রথাগত ধর্মকে ত্যাগ করার কথা ভাবতে পারেনি। এখনও পারছেন না। যারা পেরেছেন, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। শতাংশের হিসেবে আসে না।

উল্লেখ্য, রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের চার্চের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নব্বই দশকের পর সে দেশের সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর দলে দলে মানুষ ছুটে গিয়েছেন ওই চার্চের দিকেই। মানুষের দাবিতে (যে দাবিকে এতোকাল রাজনৈতিক মতবাদ ও সরকারি নির্দেশে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল) চার্চের বন্ধ দরজা আবার খুলেছে। অর্থাৎ জোর করে কোনও সাবেকি ও সনাতন বিশ্বাসকে ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলা যায় না। যার জ্বলন্ত নজির খণ্ডিত রাশিয়া। তাহলে কী আপামর মানুষ ধর্মকেই আঁকড়ে থাকবেন? অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস চিরকাল তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে? ধর্মীয় গণ্ডি থেকে তারা কী কোনওদিনই বাইরে বেরতে পারবেন না?


যে অন্ধ ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আটকে থেকে এক ধর্মের মানু, অন্য ধর্মের মানুষকে শত্রু হিসেবে গণ্য করেছেন; অকারণে আজও একে অপরের প্রতি তীব্র হিংসা-বিভেদ-বিদ্বেষ প্রকাশ করছেন; সুযোগ পেলে হেনস্থা-হয়রানিই শুধু নয়, হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছেন না। ভারতীয় উপমহাদেশেই শুধু নয়, পৃথিবীর অন্যত্রও এই অন্ধ ধর্মীয় বিভেদ-বিদ্বেষ ক্রমশঃ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যারা আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা-সভ্যতা-সচেতনতা তথা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অনেকটাই এগিয়ে আছেন বলে দাবি করেন। উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের মধ্যে তাহলে ফারাকটা রইলো কোথায়? স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, প্রথাগত ধর্মীয় বিশ্বাসে কী আমরা সবাই আক্ষরিক এবং বাস্তবিক অর্থেই এককাট্টা? তথাকথিত ধর্মের অসারতা নিয়ে বিশ্বের অনেক মনীষীই অনেক মূল্যবান কথা বলে গেছেন। আমরা সেসব কথা উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করি। বক্তব্যে কিংবা লেখায়। কিন্তু নিজেদের ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর কোনও প্রয়োজন বোধ করি না। অর্থাৎ তা যেন শুধুই ‘কথার কথা’ বাস্তবে প্রয়োগের জন্য নয়। ঠিক এই হিসেবেই মনে করি। আসলে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা আমরা অনেকেই জানি না বা বুঝি না। এমন কি, জানা-বোঝার ন্যূনতম চেষ্টাও করি না। যদি জানা-বোঝার ন্যূনতম চেষ্টাটুকু করতাম, তাহলে ধর্ম নিয়ে আমাদের মধ্যে অবস্থিত বিভেদ-বিদ্বেষ বা হানাহানি হতো না। আমাদের আপসোস কিংবা আক্ষেপ ঠিক এখানেই।

বলাবাহুল্য, গোটা বিশ্বজুড়েই চলছে ইসলাম আর খৃষ্টধর্মের মধ্যে তীব্র বিরোধ। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলির মধ্যে, চলছে ইসলাম আর হিন্দুধর্মের (পড়ুন সনাতনধর্ম) বিরোধ। কোথাওবা বৌদ্ধ আর ইসলাম ধর্মের মধ্যে বিরোধ (এ প্রসঙ্গে মায়ানমার-এর সাম্প্রতিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। সেদেশের ৩৫ লক্ষ রোহিঙ্গা জনজাতির মধ্যে প্রায় অর্ধেকই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। শুধুমাত্র আমাদের পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় দশ-বারো লক্ষ রোহিঙ্গা জনজাতি)। ভারতেও ঢুকেছেন কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা জনজাতি। আর বিদেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন অনেকে। যাদের নিয়ে খোদ রাষ্ট্রসংঘও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।

প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সংঘাতের কথাও আমরা কমবেশি সবাই জানি। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে এই অবাঞ্ছিত সংঘাত। যে সংঘাতে প্রাণ যাচ্ছে প্রচুর সংখ্যক সাধারণ নিরপরাধ মানুষের। মানবসম্পদের পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে শিক্ষা-স্বাস্থ কেন্দ্রের মতো জরুরি প্রাঙ্গণ। অত্যাধুনিক অস্ত্রের সৌজন্যে রাতারাতি ধুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে উন্নত সভ্যতার সিগনেচার হিসেবে ঘোষিত যাবতীয় সৌধ-নির্মাণ। নিষ্পাপ শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না যুদ্ধের ভায়বহ তান্ডব থেকে। দু’পক্ষই আগ্রাসী। যুযুধান দু’পক্ষই একে অপরের ওপর হিংসাত্মক তাণ্ডবনৃত্য তথা নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে যেতে অনঢ়-অটল। উন্নত বিশ্বের একপক্ষ প্যালেস্তাইনের দিকে তো অন্যপক্ষ ইজরায়েলের দিকে।

আমরা ধর্ম বলতে কী বুঝি? ধর্ম বলতে আমরা এক কল্পিত ঈশ্বরকে মেনে নিয়েছি। তাঁকে মনের মধ্যে নয়, মন্দির-মসজিদ-গির্জা নামক উপাসনালয়ে স্থান দিয়েছি। আমরা ভেবেই নিয়েছি, সেখানেই তিনি আছেন। সেখানেই তিনি থাকেন। তাই কেউ কেউ নিয়ম করে সেখানে দৌড়ঝাঁপও করি। ঘটা করে পুজো-নামাজ-প্রার্থনা জানাই। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য অর্থও ঢালি সেখানে। তাঁকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে নিজেদের যাবতীয় কামনা-বাসনা হাসিল করার জন্য প্রাণপাত করি। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে কেবল আকুলি-ব্যাকুলি করি। যাঁকে দেখা যায় না, জানা যায় না-তাঁকে নিয়েই আমাদের যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা আবর্তিত হয়।

প্রায় সব ধর্মের মানুষেরাই মুখে বলি, তিনিই জগতের সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ জগতের পিতা। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি অযথা বিদ্বেষ কেন? ধর্ম যার যাই হোক না কেন, সব মানুষই তো তাঁর সন্তান। সন্তানের সঙ্গে সন্তানের তবে কেন এমন বিভেদ-বিদ্বেষ? একে অপরকে কেন ঘৃণার চোখে দেখবে? বিশ্বপিতা কী এতে ক্ষুব্ধ হবেন না? প্রিয় সন্তানের সঙ্গে সন্তানের হানাহানি-খুনোখুনি কোন পিতা মেনে নিতে পারেন? আমরা কেন সচেতনভাবে বিশ্বপিতার বিরাগভাজন হবো? [বিশ্ব মানবতার অন্যতম প্রধান কবি কাজি নজরুল ইসলামের কথায়, “হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী বলো, সন্তান ডুবিছে মোর মা’র। ]

আসলে আমাদের কথার সঙ্গে আচরণের কোনও মিল নেই। আমাদের বিশ্বাসের সংগে কাজের কোনও সাজুয্য নেই। এমন কি, আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে ধর্মাচারণেরও কোনও মিল নেই। সমস্যাটা আসলে এখানেই। ধর্মীয় মৌলবাদ আমাদেরকে শেখায়, আমার ধর্মই সব থেকে সেরা। বাকি সব ধর্ম নিকৃষ্ট। সুতরাং অন্য ধর্মের সংগে কদাপি সহাবস্থান নয়। তারা সব বিধর্মী। বিধর্মী থেকে সাবধান। বিভেদ-বিদ্বেষের সূত্রপাত সম্ভবতঃ এখান থেকেই। আমরা বেমালুম ভুলে যাই- ‘বিশ্বপিতা’র গৌরবময় স্থান আমরাই তাঁকে দিয়েছি। সেই বিশ্বপিতাকে অসম্মান করার কোনও অধিকারই আমাদের নেই। থাকেতে পারে না। কিন্তু তাঁকে অপমান করে চলেছি আমরা।

প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি কখনও অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করতে পারেন না। অন্য ধর্মের মানুষকে শত্রু ভাবতে পারেন না। তাঁকে অকারণে হেনস্থা বা হয়রানি করতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন, অন্যধর্মের মানুষকে ঘৃণা বা অসম্মান করা মানে তো বিশ্বপিতাকেই অসম্মান বা অগ্রাহ্য করা। বিশ্বপিতার সন্তান হয়ে তিনি পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শন করেন কিভাবে? কথায় ও কাজে যথাযথ সমন্বয় না ঘটালে বিশ্বপিতা ক্ষুব্ধ হবেন। এই চেতনার উন্মেষ না হলে এক ধর্মের মানুষের প্রতি অন্য ধর্মের মানুষের বিভেদ-বিদ্বেষ কখনই ঘুচবে না। একে অপরকে শত্রু হিসেবেই দেখবে। তাই আমাদের বোধ ও বোধির দ্রুত উন্মোচন ঘটানো দরকার। কিন্তু কিভাবে? কথাগুলো মুখে বলা যতোটা সহজ, কাজের ক্ষেত্রে ততোটা সহজ নয় একথা বলাইবাহুল্য। কিন্তু ‘কাজে সহজ নয়’ বলেই পিছিয়ে থাকলেও চলবে না।

আমরা জানি, মানুষের চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই। হয়তো রাতারাতি আশানুরূপ কিছু হবেনা। কিন্তু লেগে থাকলে কাঙ্ক্ষিত ফল একদিন নিশ্চিত পাওয়া যাবেই। মানুষ জীবনের বিনিময়েও এভারেস্ট থেকে ভিন গ্রহ জয় করতে সমর্থ হয়েছে। সুতরাং নিজেদের মধ্যে হিমায়িত অবস্থায় থাকা মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা বোধের জাগরণ ঘটাতে পারবে না- এটা কখনও হয় নাকি? আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, সেই ছোটোবেলায় পড়া কবিতার অমোঘ কথাগুলো, ‘… একবার না পারিলে দেখ শতবার…।’ তাহলে কী ধর্মকে বর্জন? ব্যাপারটা হয়তো মোটেই সহজ নয়। কেন সহজ নয়, তা রাশিয়ার উদাহরণ দিয়ে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আপাততঃ ধর্মকে বর্জন করে নয়, বরং ধর্মকে সঙ্গে নিয়েই আমরা এগোতে পারি। তবে প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে কিছুটা দূরে থাকাটাই বোধহয় বাঞ্ছনীয়। মঠ-মন্দির-মসজিদ-গির্জা সহ অন্যান্য পবিত্র উপাসনালয় থেকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ঈশ্বর-দেবতা তথা বিশ্ব বা পরমপিতাকে সরিয়ে নিয়ে এসে নিজেদের মনের মন্দিরে বসাতে হবে। কারণ এটাই হলো বিশ্বপিতার উপযুক্ত স্থান। তাঁকে শুধু লোকদেখানো শ্রদ্ধা-ভক্তি নয়, তাঁর যাতে কোনও ভাবেই ন্যূনতম অমর্যাদা না হয়, সেদিকে আমাদেরকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।

ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বপিতার প্রতিটি সন্তানের ভালোর দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। প্রতিটি সন্তানের যাতে কল্যাণ হয়, সাধ্যমতো সে চেষ্টা করতে হবে। সবার কল্যাণ হয়তো একা করা যাবে না; করা সম্ভবও নয়। কিন্তু আমাদের আশপাশে যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, প্রতিদিন যাদের সঙ্গে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়, আমাদের ভালোমন্দের সংগে তাদের ভালোমন্দকে মিশিয়ে দিতে হবে। বার বার স্মরণে আনতে হবে, আমরা যে ধর্মের মানুষই হই না কেন, সবাই কিন্তু একই বিশ্বপিতার সন্তান। সেই পরমপিতা বা বিশ্বপিতা তাঁর প্রিয় সন্তানের সামান্যতম অমর্যাদাও কিন্তু সহ্য করতে পারেন না। তিনি রুষ্ট হবেন এমন কাজ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে হবে। আজকের পণ্যবাদী সময়ও আমাদেরকে বিপথে চালিত করছে। লোভ আর ভোগ-সর্বস্ব জীবন নিজের ছাড়া অন্যকিছু বুঝতে একান্তই অপারগ। আমরা পরস্পর বিছিন্ন হয়ে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই ব্যক্তিগত সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিয়েছি। আমাদের মানবিক চেতনা দ্রুত লোপ পাচ্ছে। মনুষ্যত্ববোধও ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে।

অন্যের দুঃখে, অন্যের যন্ত্রণায়, অন্যের বিপদে আমাদের হৃদয় আন্দোলিত হয়না। এমন কি, অন্যের ভালোর মধ্যেও আমরা নিজেরা কেমন যেন বিব্রত বোধ করি। ভালোকে মেনে নিতে অস্বস্তি বোধ করি। এ বড়ো সুখের সময় নয়। এই দুঃসময়ের অবসান কবে হবে জানা নেই। বিশ্বপিতার সন্তান হয়ে আমাদের এই দুর্গতি কখনও কাম্য নয়। বিশ্বপিতার কাছে ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা হোক, আমাদের চোখ দিয়েছ; কিন্তু দেখার দৃষ্টি দাওনি। আমাদের দৃষ্টি দাও, আমাদের পর্যাপ্ত আলো দাও। যে আলোর সরণি বেয়ে আমরা সবাই ধর্মের কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। তোমার অবুঝ সন্তানের জন্য এটুকু যদি করতে পারো তো এই বিশ্বটা মানুষের বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তা নাহলে ধর্মকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব জুড়ে মানুষে মানুষে যে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভেদ- বিদ্বেষের উচ্চ ফলনশীল চাষ হচ্ছে- তার বিষাক্ত ফসলে মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটাই ধাক্কা খাবে এই বিশ্বে। বিশ্বপিতা হিসেবে তোমার অগণিত সন্তানের সার্বিক মঙ্গল কামনায় এটুকু অন্ততঃ করো।