• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

প্যারিস অলিম্পিক আর কৃত্রিম বুদ্ধি

প্রতিযোগীদের জলের মধ্যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন গতিবিধি খুব সুন্দরভাবে টিভির সামনে বসে দর্শকরা উপলব্ধি করতে পারবেন

এমন যদি হতো,আমি পাখির মত উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ…… বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দের একটি বিখ্যাত গানের শুরুর কথা। আমরা সবাই মনে মনে পরিযায়ী পাখির মত উড়ে উড়ে বিশ্ব ভ্রমণ করতে চাই। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সত্যি আমরা তো আর পাখি নই। চিড়িয়াখানাতে শীতকালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ধরনের, বহু রংয়ের,বহু বৈচিত্র্যের পাখি বিশ্ব ভ্রমণ করতে করতে কলকাতা চিড়িয়াখানায় আসে। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে চিড়িয়াখানায় এসে যখন এদের দেখলাম তখন মনে হতো এরা বাড়ি থেকে কতদূর কিভাবে চিনে এলো? এতগুলো পাখি একসঙ্গে কিচির মিচির করছে সবাই কি সবার ভাষা বুঝতে পারছে? এরা কি জানে তার পাশের পাখিটার জন্ম বৃত্তান্ত? এরকম বহু প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরতো কিন্তু সঠিক উত্তরটা কখনই পেতাম না।

খেলাধুলার জগতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতা হল অলিম্পিক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আসেন। পরিযায়ী পাখিদের মতো তাদের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উঠে আসে। এই প্রশ্নের একটাই উত্তর কৃত্রিম বুদ্ধি। সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর কৃত্রিম বুদ্ধি দিতে পারে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেন যে, অলিম্পিক হবে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধি প্রযুক্তির অনবদ্য মেলবন্ধন।প্যারিস ২০২৪ অলিম্পিক এক যুগান্তকারী অনুষ্ঠান হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। ক্রীড়াবিদদের উৎসাহ বাড়ানো থেকে শুরু করে দর্শকদের অভিজ্ঞতার মধ্যে বিপ্লব ঘটিয়ে সমস্ত অনুষ্ঠানটিকে ত্রুটিমুক্ত করার প্রয়াসে কৃত্রিম বুদ্ধি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

শিল্পী মনের কল্পনা আর শিশুমনের প্রশ্ন জগতের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা ভাবনা চিন্তা শুরু করেন। আর ভাবনাচিন্তার সফল বাস্তবায়ন করেন প্রযুক্তি বিজ্ঞানের কুশিলবেরা। নতুন আর উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে অলিম্পিকের প্রতিটি মুহূর্ত এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, যা দেখে মনে হবে যা দেখছি সেটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য? আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির এত বড় স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ কে করবে? আমেরিকার স্বনামধন্য সেমিকন্ডাক্টর প্রতিষ্ঠান ইন্টেল এর প্রযুক্তিবিদ্যা এগিয়ে এসে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে যেসব নতুন ধরনের প্রযুক্তির আবিষ্কার করেছেন তার বিস্তারিত আলোচনা।

২৬ শে জুলাই ২০২৪, ভারতীয় সময় রাত এগারোটা – প্যারিসের সিয়েন নদীর চার পাশ ঘিরে ৩৩ তম অলিম্পিকের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হলো। সাধারণত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্টেডিয়ামের মধ্যেই হয়। কিন্তু এবছর শুরুতেই ব্যতিক্রম। প্যারিসের পন্ট দে অস্তারলিটজ থেকে আইফেল টাওয়ার ৬ কিলোমিটার পথ নদীর বুকে ২১৫টি দেশের প্রতিযোগীদের নাচ গান আর শারীরিক কলা কৌশলের অসাধারণ প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে অলিম্পিক ২০২৪ এ সূচনা হল। শুরুতেই দেখা গেল একটা ধাতব ঘোড়ার পিঠে চড়ে একজন মহিলা তার হাতে রয়েছে অলিম্পিকের পতাকা – সিয়েন নদী পাড়ি দিচ্ছেন। প্রযুক্তির সাহায্যে ঘোড়াটিকে অস্বাভাবিক গতিতে ছোটানো হচ্ছে নদীর ওপর দিয়ে নয় – লাফ দিচ্ছে একটি নৌকা থেকে অপর নৌকা! ঘোড়সওয়ারী ছিলেন একজন মহিলা। তিনি হলেন সামরিক বিভাগের নন-কমিশনড অফিসার ফ্লোরাইন ইজার্ট। এভাবেই শুরু হল অভিনব প্রযুক্তির প্রাথমিক সূচনা। নদীর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন লক্ষ মানুষ আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলাপ্রেমিক উৎসাহী কয়েক কোটি মানুষ টেলিভিশন বা কম্পিউটারের পর্দায় উপভোগ করলেন।

কৃত্রিম বুদ্ধির সাহায্যে তৈরি হয়েছে ‘ক্রীড়াবিদ ৩৬৫ চ্যাটবট ‘। এই চ্যাটবটের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী এগারো হাজার প্রতিযোগীর জন্ম বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অসামান্য সাফল্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। যেকোনো প্রতিযোগীর যেকোনো তথ্য, মুহূর্তের মধ্যে আপনার হাতের মুঠোর মধ্যে চলে আসবে। যে সব তথ্য ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়া বিশ্লেষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রীড়াবিদরা তাদের নিজস্ব মোবাইল ফোন থেকে চ্যাটবটে প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। অলিম্পিক ভিলেজ এর কোথাও যেতে হলে কিভাবে যেতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখতে গেলে তার সম্বন্ধে নির্দেশাবলী, অ্যান্টি ডোপিং এর নিয়ম ইত্যাদি এই ধরনের বিভিন্ন বিষয়ের তৎক্ষণাৎ উত্তর এই চ্যাটবটে পাওয়া যাবে। কোন ক্রীড়াবিদ যদি অলিম্পিকের কোন অনুষ্ঠানের ছবি তুলে বাইরে পাঠাতে চান, সেটা অলিম্পিক কমিটির নিয়মানুযায়ী না নিয়মিত বহির্ভূত,সেটাও জানিয়ে দেবে চাটবট। অনেক সময় এইসব ছোটখাটো ব্যাপার থেকে অনেক ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়, সেটা যাতে না হয়।

“অনলাইন অ্যাবিউজ মনিটরিং” হল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধির একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অনেক সময় দেখা গেছে কোন ক্রীড়াবিদ যদি ঠিকমত অংশগ্রহণ করতে না পারেন তাহলে তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমানজনক কথাবার্তায় ভরিয়ে দেওয়া হয়। এতে ক্রীড়াবিদদের মনোবল ভেঙে যায় আর মনো সংযোগের ব্যাঘাত ঘটে। তাই এই সিস্টেমটি সমস্ত এই ধরনের কথাবার্তা ফিল্টার করে দেবে। অসামাজিক কিছু থাকলে সেটাকে আর ঢুকতেই দেবে না।

অনেক সময় দর্শক আসনে বসে থেকে আপনার ইচ্ছে হতেই পারে আপনি যদি মাঠে নেমে ওদের সঙ্গে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন। ‘ইন্টারেক্টিভ অন সাইট অভিজ্ঞতা ‘ এই পদ্ধতির সাহায্যে আপনি ভার্চুয়ালি একজন প্রতিযোগী হয়ে মাঠে নামতে পারবেন। তারপর কৃত্রিম বুদ্ধি চালিত ফ্যান এক্টিভিশনের সাহায্যে আপনার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে যেন মনে হবে আপনি একজন সত্যিকারের খেলোয়াড়। খেলার মাঠে নিজের খেলার অভিজ্ঞতা উপভোগ করবেন আর সেটা কম্পিউটার বা টিভির পর্দায় দেখতে পাবেন। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর বুঝতে পারবেন আপনার দক্ষতা কোন প্রতিযোগিতায় সব থেকে বেশি।

অলিম্পিক সম্প্রচারের পদ্ধতিতেও কৃত্রিম বুদ্ধির একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অলিম্পিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, ইন্টেল আর আলিবাবার সহযোগিতায় কৃত্রিম বুদ্ধি প্রয়োগের সাহায্যে মাল্টি ক্যামেরা রিপ্লেস সিস্টেম উন্নত করে, ত্রিমাত্রিক মডেল এর সাহায্যে মুহূর্তের ক্ষুদ্রতম অংশের ঘটনাটি সুন্দরভাবে সম্প্রচার করা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ড্রাইভিং এর ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধি যে ধরনের উন্নত ডাটা গ্রাফিক্স তৈরি করবে যা বাতাসে ভাসমান অবস্থায় আর জলের মধ্যে ডুবে যাওয়ার পরে একজন ক্রীড়াবিদের শারীরিক পরিবর্তনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি ফ্রেমের মধ্যে ভেসে উঠবে। এর সাহায্যে বায়োমেকানিক্স এর তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হবে।

পর্দার আড়ালে কৃত্রিম বুদ্ধি ডিজিটাল টুইনিং এর সাহায্যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আরো ত্রুটিমুক্ত হবে। অলিম্পিকের বিভিন্ন আয়োজন ক্ষেত্র গুলির ডিজিটাল প্রতিলিপি তৈরি করে আয়োজকদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা গুলো নির্ভুলভাবে পরিকল্পনা আর পরিচালনা করতে সাহায্য করবে। এরপরে সময় আর অতিরিক্ত মানব সম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেকটা সাশ্রয় হবে। এই সিমুলেশন এর সাহায্যে যে তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হবে, সেগুলো পরবর্তী অলিম্পিক প্রতিযোগিতায়- পরিকল্পনায় আর তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধির সাহায্যে প্যারিস অলিম্পিক ২০২৪ এর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জ্বালানি শক্তি খরচের পরিমাণ জানা যাবে। সঠিকভাবে কিভাবে ব্যবহার করা দরকার সেটা বোঝা যাবে। তাছাড়া প্রতিযোগিতা গুলি প্রযুক্তিগত ভাবে কতটা উন্নত করা যায় সেটা যেমন বোঝা যাবে আর ঠিক সেরকম কিভাবে পরিবেশ বান্ধব করা যায় সে ব্যাপারে আলোকপাত করবে। এক কথায় বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতিতে কার্বন পদচিহ্ন কমাতে সাহায্য করবে। প্যারিস অলিম্পিকে পর্যটকদের আর প্রতিযোগীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে কৃত্রিম বুদ্ধি নির্ভর অনুবাদ যন্ত্র (ট্রান্সলেটর ) তৈরি করা হয়েছে। এর নাম হল ‘ত্রিদেবিয়া’। এর সাহায্যে বিভিন্ন স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথনির্দেশিকা যেমন পাওয়া যাবে সঙ্গে মান্দারীন, হিন্দি সহ ১৬ টি ভাষায় অনুবাদ করা সম্ভব হবে। সুইমিং পুলের জলের মধ্যে চারটে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। যার ফলে প্রতিযোগীদের জলের মধ্যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন গতিবিধি খুব সুন্দরভাবে টিভির সামনে বসে দর্শকেরা উপলব্ধি করতে পারবেন। এই পদ্ধতির নাম হল ‘কম্পিউটার ভিশন’। এর সাহায্যে টিভির পর্দায় দর্শকেরা প্রতিযোগী ক্রীড়াবিদদের গতিবিধি বিশ্লেষণের সঙ্গে পাশাপাশি দুই প্রতিযোগী সেকেন্ডে কে কতটা দূরত্ব অতিক্রম করল, তখন তাদের হৃদস্পন্দনের মাত্রা কত ছিল সব তথ্যই মুহূর্তের মধ্যে জানা যাবে।

ধরা যাক সাঁতার প্রতিযোগিতায় সাত জন সাতারু প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। যিনি প্রথমে আছেন তার সঙ্গে সপ্তম জনের দূরত্ব কতটা? সপ্তম জন যে গতিবেগের সাঁতার কাটছে তার গতিবেগ কতটা বাড়ালে প্রথম জন কে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন? এটা শুধু প্রথম বা শেষ জনের জন্য নয়, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের গতিবেগের পার্থক্য আর সে সঙ্গে ঐ জাতীয় তথ্য সবই পাওয়া যাবে। টিভির পর্দায় দর্শকদের কাছে প্রতিযোগিতাটা রোমাঞ্চকর ও উপভোগ্য বলে মনে হবে।

অলিম্পিকের গুরুত্বপূর্ণ একটা ইভেন্ট হলো ডাইভিং। ডাইভ দেওয়ার সময় বোর্ড থেকে মাথা দূরে রাখা হলো নিয়ম। এতদিন খালি চোখে বিচারকেরা বিচার করতেন, বোর্ডের সঙ্গে মাথাটা স্পর্শ করছে কিনা? কিন্তু এখন কম্পিউটারাইজড ক্যামেরার সাহায্যে খুব সহজেই বোঝা যাবে মাথা আর বোর্ড স্পর্শ হলো কিনা?

একবিংশ শতাব্দীর যুগান্তকারী আবিষ্কার হল কৃত্রিম বুদ্ধি। এর প্রয়োগ সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে। অলিম্পিকের প্রতিযোগিতায় প্রথম সূচনা হল এই প্যারিসে। কৃত্রিম বুদ্ধির ক্ষমতা যে কত সুদূরপ্রসারী তা মানুষ আজ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে।