কলকাতা ময়দানে একটা প্রবাদ বাক্য আছে মোহনবাগান আজ যা ভাবে, আগামী দিনে অন্য ক্লাবগুলি সেই পথে হাঁটে। সত্যিই তাই। মোহনবাগান ইতিহাস রচনা করেছে ১৯১১ সালের আইএফএ শিল্ড জয়ের মধ্যে দিয়ে। তারপরে আরও অনেক নজির গড়ে মোহনবাগান শতাব্দী প্রাচীন ক্লাব হিসেবে পরিচিতি পায়নি— জাতীয় ক্লাব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
তাই মোহনবাগান সবসময় অনন্য নজির গড়ে একের পর এক কর্মকাণ্ড তৈরি করে। এবারে ময়দানে সবচেয়ে বেশি যাঁদের নিয়ে কাজ করতে হয়, তাঁরা হলেন ক্লাবের মালি। সবাই তো তারকা ফুটবলার বা সেরা কর্মকর্তাদের নামে অনেক কিছু করে থাকেন, কিন্তু কখনওই ভাবা হয়নি, মালিদের জন্য এমন কিছু করা দরকার, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। সেই কাজটি আজকে প্রকাশ্যে চলে এল। মোহনবাগান ক্লাবের পক্ষ থেকে মালিদের জন্য ঝকঝকে ভবন তৈরি হল। এতদিন মালিরা ভাঙা ঘরে যেমন থাকতেন, আবার বৃষ্টি হলে ত্রিপল টাঙিয়ে নিয়ে কোনওরকম ভাবে দিন অতিবাহিত করতেন। কিন্তু মালিদের ছাড়া মাঠ তৈরি করা যাবে না।
তেমনই আবার খেলোয়াড়দের সবরকম পরিষেবা দেওয়ার জন্য মালিদের ডাক পড়ে। তাই মালিদের বিশেষভাবে সম্মান জানাতে মোহনবাগান ক্লাবের পক্ষ থেকে বুধবার ‘ভাসিয়া মালি ভবন’ উপহার দেওয়া হল। এই ভবনের দ্বার উদঘাটন করতে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা, সচিব দেবাশিস দত্ত, ফুটবল সচিব স্বপন ব্যানার্জি, প্রাক্তন ফুটবলার প্রদীপ চৌধুরী, মানস ভট্টাচার্য ও সত্যজিৎ চ্যাটার্জি। এসেছিলেন মন্ত্রী মলয় ঘটক।
হয়তো সেইভাবে জমকালো অনুষ্ঠান না হলেও, প্রতিটি পদক্ষেপে আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল। আবেগ ও ভালোবাসায় পুরো মঞ্চটা মুখর হয়ে উঠেছিল। সচিব দেবাশিস দত্ত বলেন, মালিদের কষ্টের কথা জেনে দীর্ঘদিন একটা ভবন তৈরি করার ভাবনা ছিল। সেই ভাবনার সার্থক রূপ পেল। এটা মনে রাখতে হবে, ক্লাবে যদি মালি না থাকেন, তাহলে কোনও কাজই সঠিকভাবে রূপায়ণ হয় না। তাই মালি যে কোনও ক্লাবের কাছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো আগামী দিনে অন্যান্য ক্লাবের পক্ষ থেকে এই ধরনের ভবন তৈরি হবে। কিন্তু ভারতবর্ষে একমাত্র মোহনবাগান ক্লাবই পারে এমন উদাহরণ রাখতে মালিদের জন্য। হয়তো ভাসিয়া মালি আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর কাজ আমাদের এখনও অনুপ্রাণিত করে।
মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা বলেন, আমি জানি না, কোনও ক্লাব এইভাবে মালিদের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মোহনবাগান সেটা করে দেখিয়ে দিল। আমার খুব ভালো লাগছে, মোহনবাগান ক্লাবের পক্ষ থেকে মালিদের প্রতি যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা, তারই ছবি স্পষ্ট হল। মন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, ফুটবলের ঐতিহ্যের নাম মোহনবাগান। তাই মোহনবাগানের কর্মকর্তারা মালিদের জন্য যে কাজটা করলেন, তা সবার মনে গেঁথে থাকবে।
প্রাক্তন ফুটবলার প্রদীপ চৌধুরী বলেন, আমি চিরদিনই মোহনবাগানেই খেলেছি। আমি জানতাম না, মোহনবাগান ক্লাবে এমন একজন মালি অর্থাৎ ভাসিয়াদা আছেন, যিনি আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ কীভাবে রাখতে হবে, তার নির্দেশ দিতেন। নির্দেশ বলব না, ভালোবাসা দিয়ে খেলোয়াড়দের কাছে টেনে নিতেন। প্রাক্তন ফুটবলার মানস ভট্টাচার্য বলেন, ভাসিয়াদা না থাকলে আমরা এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। আমি প্রথম শুনেছি একটা তুকতাক ছিল ভাসিয়াদার। ভাসিয়াদা যতক্ষণ না জার্সি হাতে তুলে দেবেন, ততক্ষণ আমরা জার্সি গায়ে পরিধান করতে পারতাম না।
এটাই যে আন্তরিকতা, তা বুঝতে পেরেছিলাম। প্রাক্তন ফুটবলার সত্যজিৎ চ্যাটার্জি বলেন, পরিবারের অভিভাবকদের মতো ময়দানে আমাদের পরিচর্যা করতেন ভাসিয়াদা। দিতেন পরিষেবা। তাঁরা যদি না থাকতেন, তাহলে আমরা গর্ব করে বলতে পারতাম না, মোহনবাগান আমাদের ক্লাব।
ফুটবল সচিব স্বপন ব্যানার্জি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে আছি একজন মোহনবাগানের সদস্য হিসেবে। তারপরে অনেক জয় গড়িয়ে গেছে আমাদের জীবনে। মাঠ সচিব থেকে ফুটবল সচিব হয়েছি। তখন ভাসিয়াদের মতো মালিদের কাছে পেয়েছি। তাঁদের কষ্টের জীবন দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময় সচিব দেবাশিস দত্তকে বলেছিলাম, ভাসিয়াদাদের জন্য একটা পাকাপোক্ত থাকার জায়গার ব্যবস্থা করার। সেদিন থেকে সচিব দেবাশিস দত্ত বলেছিলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না। এখন তা বাস্তবে রূপ পেল। তৈরি হয়ে গেল ভাসিয়া মালি ভবন।